বিসিসিআই যখন ধারাবাহিকভাবে জোর দিচ্ছে যে সিনিয়র ক্রিকেটারদের ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশ নেওয়া উচিত, ঠিক তখনই বিরাট কোহলির মন্তব্য নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে কোহলি বলেন, তিনি কখনোই অতিরিক্ত প্রস্তুতির বড় সমর্থক ছিলেন না। তাঁর মতে, একজন ক্রিকেটারের মানসিক প্রস্তুতি, অভিজ্ঞতা এবং ম্যাচ পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ঘন্টার প্র্যাকটিস বা বাড়তি প্রস্তুতি নয়। কোহলি ব্যাখ্যা করেন, তাঁর সফলতার পেছনে বড় কারণ হলো নিজেকে তাজা রাখা, শরীরকে প্রয়োজনমতো বিশ্রাম দেওয়া এবং ম্যাচের সময় সর্বোচ্চ মনোযোগ ধরে রাখা। তিনি বলেন, অতিরিক্ত প্রস্তুতি অনেক সময় শরীর ও মনের উপর চাপ তৈরি করে, যা পারফরম্যান্স কমিয়ে দেয়। বিসিসিআইয়ের সাম্প্রতিক নীতিমালা অনুযায়ী, সিনিয়র খেলোয়াড়দের রঞ্জি ট্রফি ও অন্য ঘরোয়া টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে প্রতিযোগিতা ও টিম কম্বিনেশন আরও শক্তিশালী হয়। কোহলির এই মন্তব্য তাই ক্রিকেট মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে একদিকে কেউ কেউ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলা কথাকে সমর্থন করছেন, অন্যদিকে অনেকেই মনে করছেন ঘরোয়া ক্রিকেটই খেলোয়াড়দের ধার বজায় রাখার মূল ভিত্তি। এই বিতর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও তীব্র হতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।
ভারতীয় ক্রিকেটে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো—বিসিসিআইয়ের নতুন নির্দেশ যে সিনিয়র ক্রিকেটারদের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট, বিশেষত রঞ্জি ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফি ও সৈয়দ মোশতাক আলি ট্রফিতে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। বোর্ডের এই জোরালো পদক্ষেপের লক্ষ্য স্পষ্ট—ঘরোয়া ক্রিকেটকে আরও শক্তিশালী করা, প্রতিযোগিতার মান বাড়ানো এবং দেশের সেরা ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
ঠিক এই সময়েই বিরাট কোহলির একটি মন্তব্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। তাঁর বক্তব্য—
“আমি কখনোই প্রচুর প্রস্তুতির বড় সমর্থক ছিলাম না। আমার কাছে প্রস্তুতি মানে মানসিক সতেজতা ও ম্যাচ রিডিং।”
এই বক্তব্য ভারতীয় ক্রিকেট মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। দেশের অন্যতম সফল, ফিটনেস-সচেতন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্রিকেটার কোহলি যখন এমন বার্তা দেন, তা স্বভাবতই বিতর্কের জন্ম দেয়—বিশেষত তখনই যখন বোর্ড সিনিয়রদের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট খেলতে বাধ্য করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে: কোহলির মন্তব্য কি বোর্ডের নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, নাকি এটি আন্তর্জাতিক স্তরের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন?
এবার এই সংবেদনশীল বিষয়টির গভীরে যাই—বিসিসিআই কী চায়, কোহলি কী বলছেন, এবং ভারতীয় ক্রিকেটে এই 'নীতি বনাম দর্শন' বিতর্কের প্রভাব কী হতে পারে।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আচমকা ঘরোয়া ক্রিকেটে সিনিয়রদের অংশগ্রহণ নিয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া তারই একটি অংশ। বোর্ডের এই পদক্ষেপটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ এবং এর নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট যুক্তি রয়েছে।
১. ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়ানো:
* রঞ্জি ট্রফি ভারতের ক্রিকেটের মূল ভিত্তি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে, অনেক সিনিয়র খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক সূচির চাপ বা আইপিএলের জন্য বিশ্রামের অজুহাতে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছেন না।
* বোর্ড চায় তরুণরা তাদের আইডলদের (যেমন কোহলি, রোহিত) সঙ্গে খেলুক। এর ফলে টুর্নামেন্টের প্রতিযোগিতার মান (Intensity of Competition) বাড়বে।
২. সিনিয়রদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা (Match Fitness & Continuity):
* মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে—সিনিয়র খেলোয়াড়রা দীর্ঘ ব্রেক নিয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফিরছেন কিন্তু ফর্মে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারছেন না।
* বিরতির সময় ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা তাদের ম্যাচ ফিট (Match Fit) থাকতে সাহায্য করবে, যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য অপরিহার্য।
৩. ভারতের বেঞ্চ স্ট্রেংথ আরও মজবুত করা (Bench Strength & Knowledge Transfer):
* যদি সিনিয়ররা তরুণদের সঙ্গে ঘরোয়া লেভেলে খেলেন, তাদের অভিজ্ঞতা সরাসরি তরুণদের কাছে স্থানান্তরিত হবে।
* দলগুলোর খেলার 'ইনটেনসিটি' (Intensity) বাড়বে।
* তরুণ ক্রিকেটারদের মান দ্রুত উন্নত হবে, যা ভবিষ্যতের জন্য বেঞ্চ স্ট্রেংথকে আরও মজবুত করবে।
বিরাট কোহলি তাঁর ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ফিটনেস, শৃঙ্খলা ও মানসিক শক্তির জন্য বিশ্বময় প্রশংসিত। তিনি বিশ্বের অন্যতম সেই খেলোয়াড় যিনি প্রতিটি সিরিজে নিজের রুটিন ও ফোকাস বজায় রাখেন। তাই তাঁর প্রস্তুতি নিয়ে মতামত অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্য তাঁর ক্যারিয়ারের গভীর দর্শনকে প্রতিফলিত করে।
১. মানসিক প্রস্তুতি শারীরিক প্রস্তুতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (Mind over Matter):
* কোহলির মতে ক্রিকেটে—ম্যাচ পড়া, পরিস্থিতি বোঝা, চাপ সামলানো—এসবই বাস্তব প্রস্তুতি।
* তিনি বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এত বছর খেলার পর তার 'ম্যাচ রিডিং' (Match Reading) ক্ষমতা এখন স্বয়ংক্রিয়।
২. অতিরিক্ত প্র্যাকটিস শরীরকে ক্লান্ত করে (Avoiding Burnout):
* তিনি বলেন, "অতিরিক্ত প্র্যাকটিসের ফলে অনেক সময় শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি নিজের শরীরকে কখনো বেশি চাপ দিই না।"
* এটি একটি 'বার্নআউট' (Burnout) এড়ানোর কৌশল, যেখানে তিনি জানেন কখন শরীরকে বিশ্রাম দিতে হবে।
৩. ম্যাচে নিজের প্রবৃত্তির ওপর বিশ্বাস (Trusting Instincts):
* কোহলি বিশ্বাস করেন—সিদ্ধান্ত নেওয়া, শট নির্বাচন, ফর্মে থাকা—এসব আসে অভিজ্ঞতা থেকে, অতিরিক্ত নেটে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে নয়।
৪. আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের জন্য ‘টিউনিং’ বেশি জরুরি (Tuning In):
* তিনি বলেন, "এত বছর খেলছি, আমি জানি কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। আমাকে তিন সপ্তাহ প্র্যাকটিসের দরকার হয় না।" অর্থাৎ, তিনি শুধুমাত্র তার 'টেকনিক্যাল টিউনিং'-এ বিশ্বাসী, যা অল্প সময়েও সম্ভব।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—কোহলির বক্তব্য কি বোর্ডের নীতির সরাসরি বিপরীত?
আসলে, সরাসরি বিপরীত নয়। দুই পক্ষের লক্ষ্য একই: ভারতীয় ক্রিকেটকে আরও শক্তিশালী করা। তবে পদ্ধতি আলাদা।
| প্যারামিটার | বিসিসিআই (নীতি) | বিরাট কোহলি (দর্শন) |
| মূল লক্ষ্য | ঘরোয়া ক্রিকেট মজবুত করা, বেঞ্চ স্ট্রেংথ বৃদ্ধি। | ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। |
| প্রস্তুতির পদ্ধতি | ম্যাচ ফিট থাকতে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট খেলা। | মানসিক সতেজতা ও শারীরিক বিশ্রামকে অগ্রাধিকার। |
| ফোকাস | তরুণ খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা দেওয়া। | নিজের ফর্ম এবং শরীরকে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্তরের জন্য প্রস্তুত রাখা। |
বোর্ড চায় সিনিয়ররা শারীরিকভাবে মাঠে থাকুক এবং তরুণদের অভিজ্ঞতা দিক। কোহলি বলছেন তিনি অতিরিক্ত প্রস্তুতিতে বিশ্বাসী নন, তিনি মানসিকভাবে ফ্রেশ থেকে আন্তর্জাতিক স্তরেই তাঁর ম্যাচ ফিটনেস বজায় রাখতে পারেন।
এই বিতর্কে ক্রিকেট বিশ্লেষকরাও দুই ভাগে বিভক্ত।
গ্রুপ ১: কোহলিকে সমর্থনকারী (The Experience Argument)
যুক্তি: কোহলি পৃথিবীর সবচেয়ে ফোকাসড এবং ফিট ক্রিকেটারদের একজন। তিনি তাঁর শরীরকে ঠিকই জানেন কী দিতে হবে। তাঁর মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নেটে হাজার বল খেলার দরকার নেই।
বিশেষজ্ঞদের মত: "কোহলির মতো খেলোয়াড়রা ম্যাচ ফিট থাকেন তাদের উচ্চ মানের ফিটনেস রুটিন ও ম্যাচ রিডিংয়ের মাধ্যমে, কেবল নেটে সময় কাটানোর মাধ্যমে নয়। তাঁর পদ্ধতি হয়তো অন্যদের থেকে আলাদা, কিন্তু তাঁর সাফল্যের হারই তার প্রমাণ।"
গ্রুপ ২: বোর্ডকে সমর্থনকারী (The Structural Argument)
যুক্তি: সিনিয়ররা ঘরোয়া ক্রিকেট খেললে ভারতীয় ক্রিকেটের 'সাপ্লাই চেইন' (Supply Chain) আরও শক্তিশালী হবে। আন্তর্জাতিক দলে ঢোকার রাস্তা আরও কঠিন হবে, যা ইতিবাচক।
তাদের মত: "সিনিয়ররা ঘরোয়া ক্রিকেট খেললে ক্রিকেটের ভিত আরও শক্ত হবে। তরুণরা তাদের আইডলদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাদের উন্নতি দ্রুত হবে, যা জাতীয় দলের বেঞ্চ স্ট্রেংথকে আরও গভীর করবে।"
কোহলির মন্তব্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে মূলত কয়েকটি সংবেদনশীল কারণে:
১. সময়টা সংবেদনশীল: বিসিসিআই যখন ঘরোয়া ক্রিকেট বাধ্যতামূলক করার নীতি ঘোষণা করছে, ঠিক তখনই কোহলির বক্তব্য অনেকের কাছে এই নীতির বিপরীতে বিদ্রোহের ইঙ্গিত বলে মনে হয়েছে।
২. কোহলির কথার গুরুত্ব: তিনি ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রিকেটার। তাঁর মন্তব্য মানে বড় বার্তা, যা বোর্ডের নির্দেশনার প্রতি এক ধরনের 'চ্যালেঞ্জ' হিসেবে দেখা যেতে পারে।
৩. তরুণদের উপর প্রভাব: অনেকে মনে করছেন—যদি তরুণরা শুনে যে "প্রস্তুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়", তবে সেটা ভুল বার্তা দিতে পারে। তবে কোহলির বক্তব্যকে সামগ্রিকভাবে বোঝা দরকার—তিনি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছেন, 'অতিরিক্ত' প্রস্তুতিতে বিশ্বাসী নন, প্রস্তুতিতে বিশ্বাসী নন এমনটি নয়।
খুব সম্ভবত না, বোর্ডের নীতি পরিবর্তন হবে না। কারণ বোর্ডের এই কঠোর অবস্থান ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের সঙ্গে জড়িত:
ভবিষ্যৎ নির্মাণ: ভারতের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ঘরোয়া স্তর থেকেই তৈরি হয়।
বেঞ্চ স্ট্রেংথ বৃদ্ধি: সিনিয়রদের অংশগ্রহণ বেঞ্চ স্ট্রেংথ বাড়াবে, যা ICC ইভেন্টগুলিতে ভারতকে ধারাবাহিক হতে সাহায্য করবে।
নীতিগত অবস্থান: একবার নীতি শিথিল করলে তা ভবিষ্যতে আরও সিনিয়রদের ঘরোয়া ক্রিকেট এড়িয়ে চলার সুযোগ করে দেবে।
বোর্ডের নীতি এবং কোহলির দর্শন—দুটিই ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতি উৎসর্গীকৃত। বোর্ড তার 'কাঠামোগত দায়িত্ব' পালন করছে, আর কোহলি তাঁর 'ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা' প্রকাশ করছেন।
বিসিসিআই চায় সিনিয়ররা ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলুক। কোহলি বলছেন তিনি নিজের মতো প্রস্তুতি নেন। দুই পক্ষের পথ আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য একই—ভারতীয় ক্রিকেটকে বিশ্ব মঞ্চে আরও শক্তিশালী করা।
বিরাট কোহলির মন্তব্য বিতর্ক সৃষ্টি করলেও তাঁর অভিজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাস ও ফর্ম প্রমাণ করে—তিনি জানেন নিজের শরীর, নিজের মন এবং নিজের প্রস্তুতির ধরন। কোহলির মতো কিংবদন্তিদের মতামতকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি বোর্ডের উচিত তাদের নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। কারণ একজন কোহলি জন্ম নেন বিরল প্রতিভার মাধ্যমে, কিন্তু শত শত কোহলি তৈরি হয় শক্তিশালী ঘরোয়া কাঠামোর মাধ্যমে।
ভারতীয় ক্রিকেটে এই ভিন্ন মতই ভবিষ্যতে আরও ভালো দিক দেখাবে, যেখানে কাঠামো এবং স্বাধীনতা—দুটিই সমান গুরুত্ব পাবে।