জেরুজালেম মাস্টার্সে দুরন্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে আবারও প্রমাণ করলেন নিজের প্রতিভা ভারতের তরুণ দাবাড়ু অর্যুন এরিগাইসি। ফাইডে ওয়ার্ল্ড কাপে হৃদয়ভাঙা পরাজয়ের পর অনেকেই ভেবেছিলেন তাঁর মনোবল কমে যাবে, কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটল। জেরুজালেমের দাবা মঞ্চে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা, শান্ত মস্তিষ্ক এবং আক্রমণাত্মক খেলায় উঠে এল তাঁর সত্যিকারের লড়াইয়ের মানসিকতা। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলেন ভারতীয় দাবার জীবন্ত কিংবদন্তি বিশ্বনাথন আনন্দ। অভিজ্ঞতার পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়েও অর্যুন দেখালেন নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস ও পরিপক্বতা। ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। আনন্দের কৌশলী চাল সামলাতে গিয়ে অর্যুন যতটা সতর্ক ছিলেন, ঠিক ততটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন সুযোগ পেলেই। শেষ পর্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনা ও দুর্দান্ত এন্ডগেম টেকনিকের সুবাদে তিনি জিতে নেন জেরুজালেম মাস্টার্সের শিরোপা। এই জয় শুধু একটি ট্রফি নয় ওয়ার্ল্ড কাপের ব্যর্থতা কাটিয়ে এগিয়ে চলার শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং ভারতীয় দাবার ভবিষ্যতের নতুন বার্তা। অর্যুন এরিগাইসির এই সাফল্য প্রমাণ করল যে ব্যর্থতা কখনোই শেষ নয়, বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার সুযোগ। ভারতীয় দাবা মহল তাঁর এই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং আশা করছে, সামনে তিনি আরও বহু আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করবেন।
ভারতীয় দাবা যে আজ বিশ্বমঞ্চে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলল জেরুজালেম মাস্টার্স ২০২৫ টুর্নামেন্টের ফাইনালে। অর্যুন এরিগাইসি—নামটি এখন আর শুধু ভারতের ভবিষ্যৎ নয়, বিশ্ব দাবার অন্যতম শক্তিশালী উপস্থিতির প্রতীক। ফাইডে ওয়ার্ল্ড কাপের কঠিন পরাজয়ের দুঃখ কাটিয়ে তিনি যেভাবে আবারও লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে এলেন এবং পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দের মতো কিংবদন্তিকে হারিয়ে শিরোপা জিতলেন, তা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে এক নতুন ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে। এটি কেবল একটি টুর্নামেন্টের জয় নয়, এটি মানসিক দৃঢ়তা, প্রজন্মের পরিবর্তন এবং ভারতের দাবা শক্তির উত্থানের এক গভীর তাৎপর্য বহন করে।
ফাইডে ওয়ার্ল্ড কাপ দাবার অন্যতম কঠিন এবং মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টের নক-আউট ফরম্যাট বিশ্বের সেরা গ্র্যান্ডমাস্টারদের ওপর চরম মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। অর্যুন এরিগাইসি (Arjun Erigaisi) ২০২৫ সালের ওয়ার্ল্ড কাপে দারুণ শুরু করলেও, শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টার ফাইনালে চীনের গ্র্যান্ডমাস্টার ওয়েই ই-এর (Wei Yi) কাছে পরাজিত হন। এটি ছিল তার জন্য এক হৃদয়বিদারক মুহূর্ত, কারণ এই পরাজয়ের অর্থ দাঁড়ায়—দ্বিতীয়বারের মতো তিনি মর্যাদাপূর্ণ ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে (Candidates Tournament) অংশগ্রহণের সুযোগ হারালেন। এর আগে ২০২৩ সালেও তিনি কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিয়েছিলেন।
খেলাধুলার জগতে, বিশেষ করে দাবার মতো মনস্তাত্ত্বিক খেলায়, এত বড় একটি টুর্নামেন্টে শেষ মুহূর্তে ব্যর্থতা একজন তরুণ খেলোয়াড়ের আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। অর্যুন নিজে স্বীকার করেছেন—এই পরাজয় মানসিকভাবে তাঁকে কিছুটা নাড়া দিয়েছিল এবং একটি বড় টুর্নামেন্টে "স্ট্রং ফিনিশ" দিতে না পারার হতাশা তাঁকে গ্রাস করেছিল। সেই সময়টায় তিনি সোশ্যাল মিডিয়া এবং বাহ্যিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রেখে সম্পূর্ণভাবে নিজের আত্মসমালোচনায় মনোনিবেশ করেন।
কিন্তু অর্যুন প্রমাণ করেন যে, তিনি কেবল একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় নন, তিনি একজন মানসিক চ্যাম্পিয়ন। তিনি তাঁর দুর্বলতাগুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেন। কৌশলগত ভুলগুলি চিহ্নিত করা, বিশেষত চাপের মধ্যে সময় ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলি নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন। তাঁর প্রস্তুতির পদ্ধতিকে তিনি আরও বিজ্ঞানসম্মত ও উন্নত করেন, যার মধ্যে শুধু ওপেনিং থিওরি নয়, গভীর এবং জটিল এন্ডগেম পজিশনগুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি জানতেন—দাবার জগতে ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং ব্যর্থতা একজন গ্র্যান্ডমাস্টারকে আরও বেশি খুঁতহীন এবং মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ঠিক এই বিশ্বাস এবং পুনরুজ্জীবিত সংকল্প নিয়েই তিনি যাত্রা শুরু করেন তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য—জেরুজালেম মাস্টার্স ২০২৫-এর উদ্দেশ্যে। এই মানসিক প্রত্যাবর্তনই তাঁর ঐতিহাসিক জয়ের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করে।
জেরুজালেম মাস্টার্স ২০২৫ ছিল দ্রুত দাবার (Rapid Chess) একটি প্রিমিয়াম 'এ-লেভেল' টুর্নামেন্ট, যা ৩০ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। এই টুর্নামেন্টে বিশ্বের বিশিষ্ট গ্র্যান্ডমাস্টাররা অংশ নেন, যার মধ্যে ছিলেন দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগী ইয়ান নেপোমনিয়াচি (Ian Nepomniachtchi), কিংবদন্তি পিটার সুইডলার (Peter Svidler) এবং স্বয়ং বিশ্বনাথন আনন্দ। এটি একটি ১২-খেলোয়াড়ের রাউন্ড-রবিন ইভেন্ট ছিল, যেখানে শীর্ষ চারজন খেলোয়াড় নক-আউট পর্বে প্রবেশ করেন।
অর্যুন এই টুর্নামেন্টে শুরু থেকেই অসাধারণ মনোনিবেশ এবং মানসিক স্থৈর্য দেখিয়েছেন। তাঁর খেলা ছিল বৈচিত্র্যময়; তিনি কালো ঘুঁটি নিয়ে স্থিতিশীল প্রতিরক্ষা এবং সাদা ঘুঁটি নিয়ে আক্রমণাত্মক খেলা—উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতা দেখিয়েছেন।
রাউন্ড-রবিন পর্বে তিনি ৭.৫/১১ পয়েন্ট নিয়ে নেপোমনিয়াচি এবং আনন্দের সাথে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে থেকে নক-আউট পর্বে প্রবেশ করেন। এই পর্বে তিনি অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি এড়িয়েছেন এবং নিজের শক্তি সঞ্চয় করেছেন।
সেমি-ফাইনালে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন অভিজ্ঞ পিটার সুইডলার। অর্যুন এই কঠিন ম্যাচটি ১.৫-০.৫ ব্যবধানে জিতে ফাইনালে নিজের জায়গা নিশ্চিত করেন। সেমি-ফাইনালের দ্বিতীয় গেমে ফরাসি ডিফেন্স (French Defence) ব্যবহার করে একটি রুক ও বিপরীত রঙের বিশপের এন্ডগেমে (Rook and Same Color Bishop Endgame) তিনি জয় ছিনিয়ে আনেন।
ট্যাকটিক্যাল খেলায় তাঁর প্রতিভা নতুনভাবে নজর কাড়ে, যখন তিনি কঠিন পজিশনেও মুহূর্তের মধ্যে গভীর চাল খুঁজে বের করে প্রতিপক্ষকে চমকে দেন।
অনেকে তখনই বলেছিলেন—ওয়ার্ল্ড কাপের হতাশাকে পেছনে ফেলে অর্যুনের এই টার্নঅ্যারাউন্ড ভারতীয় দাবার জন্য এক আশীর্বাদ। এই টুর্নামেন্টে তাঁর পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা তাঁকে ফাইনালে কিংবদন্তি বিশ্বনাথন আনন্দের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
জেরুজালেম মাস্টার্সের ফাইনাল ছিল ভারতীয় দাবা ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর ও প্রতীকী মুহূর্ত। এটি ছিল এক অর্থে গুরু-শিষ্যের সঙ্ঘর্ষ। আনন্দ এবং অর্যুন বিগত দেড় বছরে বেশ কিছু নক-আউট টুর্নামেন্টে মুখোমুখি হলেও, এই প্রথমবার তাঁরা কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে একে অপরের প্রতিপক্ষ হলেন।
৩.১ অভিজ্ঞতা বনাম তারুণ্যের ঝলক ও প্লে-অফ উত্তেজনা
আনন্দ এবং অর্যুনের মধ্যে ফাইনালটি ছিল দুই গেমের র্যাপিড (১৫ মিনিট + ৫ সেকেন্ড ইনক্রিমেন্ট) ফরম্যাটে।
প্রথম র্যাপিড গেম ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। অর্যুন বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করলেও, আনন্দ তাঁর অভিজ্ঞতার জোরে সেই চাপ সামলে নেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ড্র হয়।
দ্বিতীয় র্যাপিড গেমটিও তুলনামূলকভাবে শান্ত ড্রয়ের মাধ্যমে শেষ হয়।
ফলে, শিরোপা নির্ধারণের জন্য ম্যাচটি ব্লিটজ টাই-ব্রেকারে (Blitz Tie-break: ৩ মিনিট + ২ সেকেন্ড ইনক্রিমেন্ট) গড়ায়, যা ফাইনালকে এক চরম উত্তেজনায় নিয়ে আসে।
৩.২ ম্যাচ বিশ্লেষণ: ব্লিটজ টাই-ব্রেকের মাস্টারপিস
ব্লিটজ দাবার দ্রুতগতির ফরম্যাটে অর্যুনের নির্ভুল গণনা এবং স্নায়ুর দৃঢ়তা ছিল দেখার মতো।
প্রথম ব্লিটজ টাই-ব্রেক: এই গেমে অর্যুন সাদা ঘুঁটি নিয়ে শুরু করেন। তিনি একটি কৌশলগত ওপেনিং বেছে নেন এবং মধ্যপর্বে আনন্দের ওপর ধারাবাহিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। চাপের মুখে আনন্দ একটি বড় ভুল করে বসেন, যার সুযোগ নিয়ে অর্যুন তাঁর অবস্থানকে প্রায় জেতা (Decisive Advantage) পজিশনে নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত এই গেমে অর্যুন বিজয়ী হন। এই জয় তাঁকে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং শিরোপার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়।
দ্বিতীয় ব্লিটজ টাই-ব্রেক: এই গেমে অর্যুন কালো ঘুঁটি নিয়ে খেলেন এবং তিনি জানতেন—ড্র করলেই শিরোপা তাঁর। এই গেমেও অর্যুন শান্ত মাথায় খেলেন। যদিও একসময় পজিশনটি অর্যুনের অনুকূলে ছিল এবং তিনি চাইলে জয়ের চেষ্টা করতে পারতেন, কিন্তু টুর্নামেন্টের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি ঝুঁকি এড়িয়ে ড্র করতে রাজি হন।
ফাইনালের ফলাফল দাঁড়ায় অর্যুন এরিগাইসি ২.৫-১.৫ বিশ্বনাথন আনন্দ (টাই-ব্রেকার সহ)।
৩.৩ কিংবদন্তির প্রতিক্রিয়া ও তরুণ তারকার অঙ্গীকার
ম্যাচ শেষে আনন্দ অর্যুনের খেলার প্রশংসা করে বলেন:
“অর্যুন দুর্দান্ত খেলেছে। সে প্রতিটি বিপজ্জনক অবস্থান সামলেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তার ক্যালকুলেশন ছিল নিখুঁত। আজকের জয় তার যোগ্য এবং আমি নিশ্চিত, সে ভারতীয় দাবার ভবিষ্যতের কাণ্ডারি।”
অন্যদিকে, অর্যুন বিনয়ের সাথে বলেন:
“ওয়ার্ল্ড কাপের পর নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। আনন্দ স্যারের বিরুদ্ধে খেলা সবসময়ই সম্মানের। এই শিরোপা আমাকে আরও ভালো হতে, আরও কঠোর পরিশ্রম করতে এবং আরও বড় লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করবে।”
অর্যুন এরিগাইসির জেরুজালেম মাস্টার্স জয় শুধু একটি ট্রফি জেতা নয়; এর গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক।
৪.১ ব্যর্থতা থেকে ফেরা (The Comeback Story)
ফাইডে ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৫-এর কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর পরই এই শিরোপা জয় অর্যুনের মানসিক দৃঢ়তার চরমতম প্রমাণ। এই জয় দেখিয়ে দিয়েছে যে, অর্যুন কেবল প্রতিভাবান নন, তিনি প্রতিকূলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরতে জানেন। এটি খেলাধুলায় 'রেজিলিয়েন্স' বা স্থিতিস্থাপকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই প্রত্যাবর্তন ভারতের হাজার হাজার তরুণ দাবাড়ুর জন্য এক জীবন্ত প্রেরণা।
৪.২ ভারতের দাবা শক্তির উত্থান
অর্যুনের এই সাফল্য ভারতের 'গোল্ডেন জেনারেশন' দাবাড়ুদের উত্থানকে আরও মজবুত করেছে। প্রজ্ঞানেরান্ধা, নিহাল সরিন, গুখেশ—এই নামগুলির পাশে এখন অর্যুনের নামও সমমর্যাদায় উজ্জ্বল। এই জয় প্রমাণ করে যে, ভারতীয় দাবার উত্থান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত পরিবর্তন। তরুণ প্রতিভারা ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ করছে, যা ভারতের বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়।
৪.৩ আর্থিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
জেরুজালেম মাস্টার্স ছিল ১৪০,০০০ ইউএস ডলারের প্রাইজ পুলের টুর্নামেন্ট। এই শিরোপার সুবাদে অর্যুন ৫৫,০০০ ইউএস ডলার (প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা) পকেটস্থ করেন, যা তাকে ভবিষ্যতের আরও বড় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য আর্থিক সহায়তা দেবে। এছাড়া, এই টুর্নামেন্টের বিজয়ী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক দাবার এলিট ক্লাবে নিজের অবস্থান আরও সুসংহত করেন।
৪.৪ তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা
অর্যুনের এই গল্প—হতাশা থেকে শীর্ষে ওঠার গল্প—ভারতের অসংখ্য তরুণ দাবাড়ুর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। এটি তাদের শেখাবে যে, ব্যর্থতা খেলারই অংশ, কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ হলো সেই ব্যর্থতা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কীভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে ফেরা যায়। তাঁর এই সাফল্য ভারতীয় তরুণদের মধ্যে দাবাকে কেবল একটি খেলা হিসেবে নয়, বরং একটি গৌরবের ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করার উৎসাহ দেবে।
অর্যুন এরিগাইসির এই সাফল্যের পেছনে ছিল সুনির্দিষ্ট কৌশল ও কঠোর পরিশ্রম।
১. প্রস্তুতির গভীরতা ও ওপেনিং বৈচিত্র্য: অর্যুন তাঁর কোচিং টিমের সাথে প্রতিটি প্রতিপক্ষের খেলা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি কেবল প্রচলিত চালের বদলে নতুন এবং অপ্রচলিত ভ্যারিয়েশন ব্যবহার করেছেন। এর ফলে প্রতিপক্ষ অস্বস্তিকর পজিশনে চলে গেছেন এবং তাদের দীর্ঘ সময় নিয়ে চিন্তা করতে হয়েছে, যা ঘড়ির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
২. শক্তিশালী এন্ডগেম দক্ষতা: টুর্নামেন্টে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল নিখুঁত এন্ডগেম। তিনি জটিল এন্ডগেমে নির্ভুল গণনা দেখিয়েছেন এবং সামান্য সুবিধা থেকেও জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। দাবার সর্বোচ্চ স্তরে, যেখানে সবাই ওপেনিং ও মধ্যপর্বে ভালো, সেখানে এন্ডগেমের এই শ্রেষ্ঠত্ব তাঁকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে।
৩. মানসিক স্থৈর্য ও সময় ব্যবস্থাপনা: ওয়ার্ল্ড কাপের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি এই টুর্নামেন্টে সময় ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। চাপের মুখেও তিনি ভেঙে পড়েননি, বরং কঠিন পজিশনেও শান্ত থেকে সেরা চালটি খুঁজে বের করেছেন। এই মানসিক নিয়ন্ত্রণই ছিল কিংবদন্তি আনন্দের বিরুদ্ধে টাই-ব্রেকারে জয়ের মূল চাবিকাঠি।
৪. চাপের মুখে নির্ভুলতা (Blitz Accuracy): দ্রুত গতির ব্লিটজ টাই-ব্রেকারে তাঁর খেলার নির্ভুলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর চালের গতি এবং গভীরতা আনন্দের মতো কিংবদন্তিকেও চমকে দিয়েছে।
জেরুজালেম মাস্টার্সের ফাইনাল ছিল আনন্দ বনাম অর্যুন—ভারতীয় দাবার এক ঐতিহাসিক এবং প্রতীকী মুহূর্ত। এটি দেখিয়ে দিল—ভারতের দাবা ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত এবং অত্যন্ত প্রতিভাবান হাতে রয়েছে।
বিশ্বনাথন আনন্দ, যাঁর হাত ধরে ভারতে দাবার আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল, তিনি ভারতকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মর্যাদা। তিনি শুধু প্রথম ভারতীয় বিশ্বচ্যাম্পিয়নই নন, তিনি ভারতীয় দাবাড়ুদের কাছে এক অদম্য আদর্শ। এই টুর্নামেন্টে নেপোমনিয়াচির মতো তারকাকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছানো প্রমাণ করে যে, ৫৬ বছর বয়সেও তাঁর খেলার ধার বিন্দুমাত্র কমেনি।
এখন তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে উঠে আসছেন অর্যুন এরিগাইসি, যিনি বিশ্ব দাবায় ভারতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এই ফাইনালটি ছিল এক প্রকার দায়িত্ব হস্তান্তর। যেখানে আনন্দ তরুণ প্রতিভাকে উৎসাহিত করছেন এবং নিজের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি এখনও প্রতিযোগিতায় আছেন, তবে ভবিষ্যৎ এখন অপেক্ষায় রয়েছে নতুন তারকার জন্য। এই সঙ্ঘর্ষ কেবল একটি ম্যাচ ছিল না—এটি ছিল ভারতীয় দাবার বিবর্তন ও পরিবর্তনের এক সুস্থ ধারা।
আজ অর্যুন শুধু ভারতের সম্পদ নন, তিনি বিশ্ব দাবার অন্যতম উজ্জ্বল এবং প্রতিভাবান তারকা। ডিসেম্বরের ২০২৫-এর হিসাব অনুযায়ী, তাঁর রেটিং প্রায় ২৭৭৫ এবং তিনি বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সেরা পাঁচজন খেলোয়াড়ের মধ্যে অবস্থান করছেন।
রেটিং উন্নতির গতি: অর্যুন এরিগাইসি দ্রুততম ভারতীয় হিসেবে এবং আনন্দের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে ২৮০০ রেটিং অতিক্রম করেছিলেন (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে), যা তাঁকে সর্বকালের ১৫তম-সর্বোচ্চ রেটেড খেলোয়াড়ে পরিণত করে।
ধারাবাহিক আন্তর্জাতিক সাফল্য: তিনি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পাচ্ছেন। বড় খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে তিনি আত্মবিশ্বাসীভাবে লড়ছেন, যা তাঁকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের যোগ্যতামঞ্চে নিয়ে যেতে পারে।
খেলায় বহুমুখিতা: তাঁর খেলায় আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার এক চমৎকার সমন্বয় দেখা যায়। তাঁর এই বহুমুখী শৈলী তাঁকে যেকোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সফল হতে সাহায্য করে।
এই সব কিছুর সমন্বয়েই অর্যুন আগামী দিনের ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করছেন। তাঁর বয়স (২২ বছর) এবং বর্তমান রেটিং বিবেচনা করে, তিনি যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন, তবে খুব শীঘ্রই বিশ্ব দাবা তাঁর হাতে নতুন নেতৃত্ব দেখতে পারে।
অর্যুনের এই ঐতিহাসিক জয় একটি বড় বার্তা বহন করছে: “ভারতের দাবা আরও উঁচুতে উঠছে, এবং এই উত্থান কেবল একজন খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে নয়।”
আজ ভারতে দাবার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। নতুন ক্লাব, নতুন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, বিশেষত অনলাইনে আধুনিক কোচিং পদ্ধতির কারণে দাবার পরিবেশ বদলে গেছে। বিশ্বনাথন আনন্দের অনুপ্রেরণা এবং পরবর্তী প্রজন্মের (প্রজ্ঞানেরান্ধা, গুখেশ) সাফল্য দেখে তরুণরা দাবার প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।
অর্যুনের সাফল্য সেই দাবা বিপ্লবকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁর এই জয় প্রমাণ করে যে, সঠিক সমর্থন, কঠোর পরিশ্রম এবং মানসিক দৃঢ়তা থাকলে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও বিশ্বমানের চ্যাম্পিয়ন তৈরি হওয়া সম্ভব। তাঁর এই সাফল্যের ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে সরকার, কর্পোরেট হাউজ এবং ক্রীড়া সংস্থাগুলি দাবার প্রতি আরও বেশি বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে বলে আশা করা যায়, যা দেশের দাবার অবকাঠামোকে আরও উন্নত করবে।
অর্যুনের সাফল্যের পেছনে তাঁর পরিবারের অবদান অসীম। তিনি তেলঙ্গানার ওয়ারাঙ্গলের এক তেলেগু পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর বাবা একজন নিউরোসার্জন এবং মা একজন গৃহিণী।
উৎসাহ ও সমর্থন: তাঁর বাবা-মা তাঁকে শৈশব থেকেই উৎসাহ দিয়েছেন। পরিবারের আর্থিক ও মানসিক সমর্থন তাঁকে সবসময় শক্তি জুগিয়েছে।
প্রাথমিক কোচিং: হনামকোন্ডার বিএস চেস একাডেমিতে তাঁর প্রথম কোচ বোল্লম সম্পাথের তত্ত্বাবধানে তিনি তাঁর প্রাথমিক দাবার বিকাশ ঘটান।
দাবার জগতে শীর্ষে পৌঁছানোর পথে অসংখ্য উত্থান-পতন থাকে, সেই কঠিন সময়ে পরিবারের মানসিক সমর্থন একজন খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় শক্তি—অর্যুন নিজেই তা বারবার বলেছেন।
জেরুজালেম মাস্টার্স ২০২৫ জয়ের পর অর্যুন এরিগাইসির লক্ষ্য এখন আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাঁর এই জয় তাঁকে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের (Candidates Tournament) পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
তাঁর immediate লক্ষ্যগুলি হলো:
রেটিং আরও বাড়ানো: বিশ্বের সেরা ৫ খেলোয়াড়ের মধ্যে নিজের অবস্থান সুসংহত রাখা।
আরও আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়: ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শীর্ষ স্তরের গ্র্যান্ড প্রিক্স ও অন্যান্য মাস্টার্স টুর্নামেন্টে সাফল্য অর্জন করা।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের যোগ্যতা অর্জন: ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের জন্য যোগ্যতা অর্জন করে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের আসনে বসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—অর্যুনের এই ফর্ম এবং মানসিকতা বজায় থাকলে, খুব শীঘ্রই তিনি বিশ্ব দাবার সর্বোচ্চ মঞ্চে সাফল্য অর্জনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবেন। ভারতীয় দাবা এখন আনন্দের হাত ধরে তৈরি হওয়া ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে এক নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের দিকে তাকিয়ে আছে, যার অন্যতম প্রধান মুখ হতে পারেন অর্যুন এরিগাইসি।
ওয়ার্ল্ড কাপের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের হতাশা থেকে জেরুজালেম মাস্টার্সের শিরোপা জয় পর্যন্ত—অর্যুন এরিগাইসির এই যাত্রা এক অনন্য অধ্যায়। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়; এটি ভারতীয় দাবার উত্থান, মানসিক দৃঢ়তা এবং প্রজন্মের পরিবর্তনের এক শক্তিশালী প্রতীক।
অর্যুন দেখিয়ে দিয়েছেন—হতাশা কখনোই শেষ নয়, বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার এক বিশাল সুযোগ। কিংবদন্তি বিশ্বনাথন আনন্দকে ফাইনালে পরাজিত করে তিনি কেবল একটি ট্রফি জেতেননি, তিনি ভারতীয় দাবার নেতৃত্বের মশাল নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। তাঁর এই সাফল্য এক বার্তা বহন করছে:
"ভারতের দাবার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নতুন চ্যাম্পিয়ন তৈরি হচ্ছে। অর্যুন এরিগাইসির এই উত্থান ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।"
তাঁর এই বিজয় ভারতীয় দাবাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল, যেখানে বিশ্ব আধিপত্য এখন আর কেবল স্বপ্ন নয়, বরং এক অনিবার্য বাস্তবতা।