ব্যস্ত সকালে ব্লু লাইনে সিগন্যাল সমস্যায় ধীরগতির মেট্রো পরিষেবা, দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত দীর্ঘ বিলম্ব—যাত্রীরা পড়লেন চরম ভোগান্তিতে
ফের বড়সড় বিভ্রাটে কাঁপল কলকাতা মেট্রো রেল পরিষেবা। সপ্তাহের দ্বিতীয় কাজের দিনের ব্যস্ত সকালে ব্লু লাইনে দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরামগামী ডাউন লাইনে হঠাৎই ধীরগতির মেট্রোর জেরে রীতিমতো নাজেহাল হলেন নিত্যযাত্রীরা। অফিসযাত্রা, স্কুল-কলেজের ভিড়, সকালের তাড়াহুড়া সব মিলিয়ে যেখানে এই সময়ে মেট্রোকে অনেকেরই ‘সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য’ পরিবহণ বলে মনে হয়, ঠিক সেই সময়েই মেট্রোর গতিপথ যেন ভেঙে পড়ল সিগন্যাল সমস্যার সামনে। যাত্রীরা জানান, সকাল ৮টা নাগাদ থেকেই পরিষেবার গতি অস্বাভাবিক রকম কমতে শুরু করে, কিছু স্টেশনে ট্রেন দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, কোথাও আবার ম্যানুয়ালি সিগন্যাল দিয়ে ছাড়তে হচ্ছে ট্রেন। এর ফলে দীর্ঘ লাইনে যাত্রীদের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে।
দক্ষিণেশ্বর-নোয়াপাড়া অংশের অবস্থা ছিল সবচেয়ে উদ্বেগজনক। সাধারণত যেখানে দক্ষিণেশ্বর থেকে নোয়াপাড়া পৌঁছতে সাত থেকে আট মিনিটের বেশি লাগে না, সেখানে এ দিন লাগল প্রায় ৩৮ মিনিট। এক অফিসযাত্রী অর্ক বিশ্বাসের কথায় “এমন ধীরগতির পরিষেবা আগে কখনও দেখিনি। দক্ষিণেশ্বর থেকে ট্রেন ছাড়তেই দেরি, ঢুকতেও দেরি। নোয়াপাড়া পর্যন্ত পৌঁছতেই প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল! নোয়াপাড়া পার হওয়ার পরেও মেট্রো ঢিলেঢালা গতিতে এগোচ্ছে। পর পর সব স্টেশনেই ট্রেন দাঁড়াচ্ছে দীর্ঘক্ষণ।” তাঁর কথায়, সিগন্যালের স্বাভাবিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় ট্রেন ছাড়ার অনুমতি দিতে হচ্ছে ম্যানুয়ালি, যা পরিষেবাকে আরও ধীর করছি।
অন্য এক যাত্রী জানান, ডাউন ব্লু লাইনে দক্ষিণেশ্বর ও বরাহনগরের মাঝখানে সকাল ৮টা ৪২ মিনিট থেকে ৮টা ৫৭ মিনিট পর্যন্ত একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। এত দীর্ঘ সময় প্রায় স্থির হয়ে থাকা ট্রেনে গাদাগাদি অবস্থায় যাত্রীরা ভোগান্তির সীমা ছাড়িয়ে ফেলেন। বরাহনগরে কোনওমতে ঢুকলেও সেখানেও আবার অপেক্ষা। ঘোষণা করা হয় নোয়াপাড়ার দিক থেকে সিগন্যাল না পাওয়ার ফলে গাড়ি ছাড়তে দেরি হবে। ফলে একের পর এক ট্রেন আটকে যায় স্টেশনে, আর লাইনে নামতে না পেরে বহু যাত্রী ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
পরিষেবার বিশৃঙ্খলা শুধু ডাউন লাইনে আটকে থাকেনি। দমদম স্টেশনে অপেক্ষারত যাত্রীরা জানান, দক্ষিণেশ্বরগামী একটি ট্রেন স্টেশনে ঢোকার পর যাত্রীদের নামিয়ে পুরো গাড়ি খালি করে দেওয়া হয়। তারপর সেই একই ট্রেনকে শহিদ ক্ষুদিরামগামী আপ লাইনে চালানো হয়। এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে অনেকেই প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন— ট্রেন বদলানোর ঘোষণা, যাত্রী নামানোর নির্দেশ, গন্তব্য পাল্টে দেওয়া সব মিলিয়ে সকালবেলার ব্যস্ত সময়ে বিভ্রান্তির চরমে পৌঁছান বহু নিত্যযাত্রী।
যদিও আপ লাইনে—অর্থাৎ শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে দমদমগামী পথে পরিষেবা তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক ছিল। কয়েকজন আপ লাইনের যাত্রী জানান, আপ পথে ট্রেন নির্ধারিত সময়সূচি মেনে বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। তবে ডাউন লাইনের বিশৃঙ্খলা ও দেরির ধাক্কায় স্টেশনে যাত্রী জমে যেতে থাকায় অনেক স্টেশনে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
দক্ষিণেশ্বর স্টেশন ব্লু লাইনের প্রান্তিক স্টেশন হওয়ায়, প্রতিদিনই ট্রেন, বাস, রিকশা কিংবা সড়কপথে এসে বহু মানুষ এখান থেকেই মেট্রো ধরেন। বিশেষত সকালে অফিস-কলেজগামী ভিড় সবচেয়ে বেশি থাকে এই অংশে। ফলে দক্ষিণেশ্বর থেকেই পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটায় গোটা ব্লু লাইন জুড়েই প্রভাব পড়ে। যাত্রীরা জানান, ট্রেন দেরিতে আসায় প্ল্যাটফর্মে কয়েকটি মেট্রো লাইন অপেক্ষা করতে হচ্ছে লম্বা সময়। আবার মেট্রো এলেও ভিড় এতটাই বেশি যে অনেকে বাধ্য হয়ে ১–২টি ট্রেন ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্টেশনে থাকা শিশু, মহিলা, বয়স্ক যাত্রী—সবার জন্যই পরিস্থিতি হয়ে ওঠে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। কয়েকজন যাত্রী জানান, অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর জায়গাও ছিল না। দক্ষিণেশ্বর, বরানগর, নোয়াপাড়া, দমদম—এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে যাত্রীচাপ সবচেয়ে বেশি ছিল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও বহু যাত্রী গন্তব্যে দেরিতে পৌঁছন। একজন নিত্যযাত্রীর বক্তব্য, “আজকের মতো এমন ভিড় শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না। একটি মেট্রো আসছে, কিন্তু পুরো গাদাগাদি। এরপর আরও দুই-তিনটি মেট্রো ছাড়তে হয়েছে। চাকরিতে পৌঁছতে দেরি তো হবেই, উপরে এই চাপ সামলানোই মুশকিল।”
সকাল সওয়া ১০টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। বহু স্টেশনে ট্রেন ঢুকতে সময় নিচ্ছে, তার ওপর সিগন্যাল ম্যানুয়ালি দেওয়ার কারণে প্রতিটি স্টেশনে দাঁড়ানো ও ছাড়ার প্রক্রিয়াই সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। যাত্রীরা জানান, এক একটি স্টেশন যেতে ১৩–১৪ মিনিট লেগে যাচ্ছে, যা সাধারণ সময়ের প্রায় তিনগুণ। নোয়াপাড়া দমদম—এমজি রোড চাঁদনি পার্কস্ট্রিট—এই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোকেও ধীরগতির প্রভাব টেনে নিয়ে যায়, এবং গোটা লাইনেই যাত্রীচাপ বাড়তে থাকে।
অন্যদিকে, এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীদের প্রশ্ন—শীতকাল এলেই কেন মেট্রোতে বিভ্রাটের মাত্রা বাড়ে? কেন বারবার সিগন্যাল বা প্রযুক্তিগত সমস্যার কথা বলে দায়সারা ঘোষণা? অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দিয়ে লিখেছেন— “কলকাতার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরিবহণটাও আর নির্ভরযোগ্য নেই।” আবার কেউ বলেছেন— “প্রতিদিনই কোনো না কোনো অংশে মেট্রো বিভ্রাট। অফিস সময়ের আগে বিকল্প ব্যবস্থাই ভাবতে হবে।”
দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত ব্লু লাইনের দৈনন্দিন যাত্রীসংখ্যা কয়েক লক্ষ। এই বিশাল যাত্রীচাপ সামলাতে মেট্রো রেলের প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত ঘাটতি যে বড় ভূমিকা রাখছে, তা এ দিনের ঘটনাতেই স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিগন্যালিং সিস্টেমের সামান্য গোলযোগও বড়সড় বিপত্তি তৈরি করতে পারে, কারণ মেট্রো রেল পুরোপুরি আধুনিক সেন্ট্রালাইজড কন্ট্রোর রুম থেকে পরিচালিত হয়। এক জায়গায় সমস্যা হলে তার প্রভাব পড়ে গোটা লাইনে।
অন্যদিকে, যাত্রীসেবা স্বাভাবিক করতে মেট্রো কর্তৃপক্ষের তরফে তৎপরতা চলছে বলেই দাবি। তবে যাত্রীরা বলছেন— বাস্তবে সেই তৎপরতার ফল সকালের ব্যস্ত সময়ে তাঁরা দেখেননি। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোগান্তি তাদের ভোগ করতেই হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য অতিরিক্ত জনদূর্ভোগের কারণে মেট্রোর বাইরে বাস বা অটো ধরার কথাও ভাবছেন, যদিও তাতে আরও সময় লাগছে।
মেট্রোর এই পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি অফিসে দেরিতে পৌঁছনোর অভিযোগ উঠছে বহু জায়গায়। কারও মিটিং নষ্ট হয়েছে, কারও ক্লাস। অনেকেই অভিযোগ করছেন, “দক্ষিণেশ্বর নোয়াপাড়া দমদম এই অংশে নিয়মিত বিভ্রাট হচ্ছে। প্রতিদিনই ভয় থাকে, না জানি কোনদিন আবার এমন হবে।”
সকাল থেকে শুরু হওয়া বিশৃঙ্খলা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সিগন্যাল ম্যানুয়ালি দেওয়া, একাধিক স্টেশনে অতিরিক্ত ভিড়, ট্রেনের অস্বাভাবিক ধীরগতি সব মিলিয়ে ব্লু লাইনের যাত্রীদের সকালটা কার্যত দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে অসহায়তা ও ক্ষোভ দুটিই ক্রমশ বেড়েছে। অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে প্রশাসনের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন। তাঁদের কথায়, মেট্রো পরিষেবা কলকাতাবাসীর দৈনন্দিন জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বিশেষত ব্যস্ত সময়ে। তাই এরকম আকস্মিক বিপর্যয় শুধু যাত্রীদের সময়ই নষ্ট করে না, বরং তাদের মানসিক চাপও বাড়িয়ে তোলে।
বিভ্রাটের কারণে অফিসপাড়ায়ও প্রভাব স্পষ্ট। বহু সংস্থায় কর্মীরা দেরিতে পৌঁছেছেন, অনেকে আগেই কর্তৃপক্ষকে দেরির কথা জানাতে বাধ্য হয়েছেন। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা গেছে। অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, সকালে সন্তানকে নিয়ে স্টেশনে এসে তাঁরা ভেবেছিলেন স্বাভাবিক মতোই ট্রেনে তুলে দিতে পারবেন। কিন্তু ট্রেন দেরিতে এসে অতিরিক্ত ভিড়ে ঠাসা থাকায় তাঁরা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। ফলে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বিকল্প পরিবহণে সন্তানের হাতে তুলে দিয়েছেন, যার ফলে আরও দেরি হয়েছে।
স্টেশনের অবস্থা ছিল আরও জটিল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীদের সারি ক্রমশ বাড়ছিল, বিশেষত দক্ষিণেশ্বর, নোয়াপাড়া, দমদম, বরাহনগর ও বি টি রোডের আশপাশের স্টেশনগুলোতে। যেহেতু ট্রেন আসতে সময় নিচ্ছিল, আর এলেও ট্রেন ছিল পরিপূর্ণ, তাই প্রতিটি স্টেশনে অপেক্ষার সময় বেড়েই চলছিল। এমনকি কিছু যাত্রী ভিড়ের চাপ এড়াতে প্ল্যাটফর্মের একেবারে পাশের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন।
একের পর এক দেরির ফলে ট্রেনের সময়সূচি পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায়। যাত্রীরা বলেন, পরিষেবা কখন স্বাভাবিক হবে সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ঘোষণাও ছিল না। মাঝে মাঝে স্টেশন ঘোষণায় জানানো হচ্ছিল যে সিগন্যাল সমস্যার কারণে দেরি হচ্ছে, কিন্তু সমস্যার প্রকৃতি বা সমাধান সম্পর্কে কোনও দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে যাত্রীরা আরও বিভ্রান্ত ও অস্বস্তিতে পড়েন।
এদিকে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে সিগন্যালিং সিস্টেমের আধুনিকীকরণ না হলে ভবিষ্যতেও এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শহরের দ্রুতগতির জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেট্রোর ওপর যাত্রীচাপ যেমন বাড়ছে, তেমনই প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। নাহলে প্রতিদিনের যাতায়াতে এই ধরনের বিঘ্ন যাত্রীদের জীবনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে।
সব মিলিয়ে, এক দিনের এই প্রযুক্তিগত গোলযোগ ফের প্রমাণ করল কলকাতা মেট্রোকে আরও দক্ষ, দ্রুত এবং প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী না করলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না। যাত্রীরা এখন শুধু চান, দ্রুত পরিষেবা স্বাভাবিক হোক এবং ভবিষ্যতে এমন বিভ্রাট এড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হোক।