Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

ইংল্যান্ডের প্রাক্তন তারকা ব্যাটার রবিন স্মিথ আর নেই, প্রয়াণ ৬২ বছর বয়সে

ইংল্যান্ড ক্রিকেটে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রয়াত হলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন তারকা ব্যাটার রবিন স্মিথ। ৬২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি ক্রিকেটার। ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে স্মিথ ইংল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারে ছিলেন অপরিহার্য। বিশেষ করে দ্রুতগতির বোলিংয়ের বিরুদ্ধে তার দৃঢ়তা ও সাহসিকতার জন্য তিনি ক্রিকেট দুনিয়ায় পরিচিত ছিলেন The Judge নামে। রবিন স্মিথ ইংল্যান্ডের হয়ে ৬২টি টেস্ট ও ৭১টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। টেস্টে তার রান সংখ্যা ৪,৫০০ এরও বেশি এবং রয়েছে ৮টি শতক। ওয়ানডেতেও তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য রান সংগ্রাহক। কঠিন পরিস্থিতিতে তার লড়াইয়ের মানসিকতা, শর্ট বলের বিরুদ্ধে দক্ষতা এবং আক্রমণাত্মক ব্যাটিং স্টাইল আজও স্মরণীয়। তার মৃত্যুতে সাবেক সতীর্থ, ক্রিকেট বিশ্লেষক ও ভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়ায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডও একটি বিবৃতি দিয়ে স্মিথের অবদানকে স্মরণ করেছে। রবিন স্মিথ শুধু একজন অসাধারণ ব্যাটসম্যানই ছিলেন না, বরং ছিলেন ক্রিকেট জগতের এক বিনয়ী ও প্রেরণাদায়ী চেহারা। তার প্রয়াণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হারালো এক মূল্যবান রত্ন।

ইংল্যান্ড ক্রিকেটে শোকের ছায়া: 'দ্য জাজ' রবিন স্মিথ আর নেই—৬২ বছর বয়সে থেমে গেল এক নির্ভীক যোদ্ধার পথচলা

১.  সূচনা: এক সাহসী হৃদয়ের প্রস্থান

ক্রিকেট বিশ্বের জন্য এটি এক গভীর শোকের দিন। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ব্যাটিং তারকা, যিনি তার দৃঢ়তা, ধৈর্য এবং ভয়হীন ব্যাটিং স্টাইলের জন্য 'দ্য জাজ' (The Judge) নামে পরিচিত ছিলেন, সেই রবিন স্মিথ মাত্র ৬২ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন। তার অকাল প্রয়াণ শুধু ইংল্যান্ডের ক্রিকেটমহল নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই এক স্তম্ভশূন্য করে দিল।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে যখন ক্রিকেট মানেই ছিল গতি, বাউন্স এবং পেস বোলারদের একচ্ছত্র দাপট, সেই কঠিন সময়ে রবিন স্মিথ ছিলেন ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারের অন্যতম সাহসী মুখ। তার ব্যাট হাতে লড়াই, শর্ট বলের বিরুদ্ধে তার টেকনিক্যাল শ্রেষ্ঠত্ব—এসবই তাকে ক্রিকেট ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার কীর্তি, তার সাহস এবং তার মানসিক দৃঢ়তার গল্প আগামী প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে। তার চলে যাওয়া ক্রিকেট বিশ্বের এক স্বর্ণযুগের সমাপ্তি ঘোষণা করল।

২.  রবিন স্মিথ: এক স্বর্ণযুগের প্রতিভা ও ব্যক্তিগত জীবন

রবিন জন স্মিথ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে। শৈশবের পর তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানেই তার ক্রিকেটীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটে। কাউন্টি ক্রিকেটে হ্যাম্পশায়ারের হয়ে তার পারফরম্যান্স এতটাই ধারাবাহিক ছিল যে, ১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় দলে ডাক পান।

স্মিথ দ্রুতই ইংল্যান্ডের টপ এবং মিডল অর্ডারে নিজের অবস্থান পাকা করে নেন। তার ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল তার শান্ত এবং সংকল্পবদ্ধ মানসিকতা। তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যাটসম্যান, যিনি স্কোরবোর্ডের দিকে না তাকিয়ে বোলারদের চোখ দেখে খেলতেন।

২.১. আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল পরিসংখ্যান:

রবিন স্মিথ তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মোট ৬২টি টেস্ট এবং ৭১টি ওয়ানডে ম্যাচে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তার পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে, তিনি কতটা নির্ভরযোগ্য ছিলেন।

ফরম্যাট ম্যাচ সংখ্যা মোট রান ব্যাটিং গড় শতক অর্ধশতক সর্বোচ্চ স্কোর
টেস্ট ৬২ ৪,৫২৫ $43.68$ ২৭ $175^*$ (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে)
ওয়ানডে ৭১ ২,৩১২ $34.50$ ১৭ $167^*$ (অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে)

তার টেস্ট গড় ($43.68$) নব্বই দশকের ইংল্যান্ডের ব্যাটিং দুর্বলতা এবং পেসারদের দাপটের যুগে ছিল ব্যতিক্রমী। এটি প্রমাণ করে, তিনি চাপের মুখেও কীভাবে ইনিংস গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখতেন।

২.২. ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মহাকাব্যিক নক:

১৯৯৩ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তার অপরাজিত ১৬৭ রানের ওয়ানডে ইনিংসটি আজও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা নক হিসেবে বিবেচিত। সেই ইনিংসে তিনি অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে খেলেছিলেন এবং বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন তার ব্যাটিংয়ে পাওয়ার, টাইমিং এবং টেকনিকের এক বিরল মিশ্রণ।

৩.  শর্ট বলের বিরুদ্ধে এক অনবদ্য শিল্পী: কেন তিনি ছিলেন "The Judge"?

ক্রিকেট দুনিয়ায় রবিন স্মিথকে 'দ্য জাজ' বা 'বিচারক' নামে ডাকার কারণ ছিল তার ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক—শর্ট বল মোকাবিলা করার তার বিস্ময়কর দক্ষতা।

৩.১. ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসারদের মুখোমুখি:

স্মিথের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং গৌরবময় সময় ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলা। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণে ছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর পেসাররা:

  • কার্টলি অ্যামব্রোস

  • কোর্টনি ওয়ালশ

  • ম্যালকম মার্শাল

  • ইয়ান বিশপ

এই বোলাররা যখন বাউন্সারে ব্যাটসম্যানদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতেন, তখন রবিন স্মিথ ছিলেন সেই কয়েকজন ইংরেজ ব্যাটারের একজন, যিনি হেলমেট ও বুক চিতিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে খেলতেন। তিনি কখনও ভয় পেতেন না, বরং শর্ট বলকে সঠিক সময়ে বিচার করে (Judge) পুল ও কাট শটে বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতেন।

এই কারণেই তার সতীর্থ এবং ধারাভাষ্যকাররা তাকে 'দ্য জাজ' নামে ডাকতে শুরু করেন। কারণ তিনি বোলারদের গতি এবং বাউন্সকে নির্ভুলভাবে বিচার করে শাস্তি দিতে পারতেন। তার উইকেট নেওয়া ছিল বোলারদের জন্য কঠিনতম কাজ।

৩.২. ব্যাটিং টেকনিকের বৈশিষ্ট্য:

৪.  ১৯৯০-এর দশকের ইংল্যান্ড দলে তার কৌশলগত গুরুত্ব

১৯৯০-এর দশকে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল ছিল এক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে। দলের ব্যাটিং লাইনআপে ধারাবাহিকতার অভাব ছিল প্রকট। এমন অবস্থায় রবিন স্মিথ ছিলেন দলের সবচেয়ে স্থির, আস্থার এবং নির্ভরতার প্রতীক।

৪.১. চাপের মুখে হাল ধরা:

স্মিথ ছিলেন 'ম্যান ইন এ ক্রাইসিস'। দল যখন ধসে পড়তো বা দ্রুত ৩-৪টি উইকেট পড়ে যেত, তখন রবিন স্মিথই হাল ধরতেন। তিনি ছিলেন সেই অভিজ্ঞতম ব্যাটসম্যান, যিনি তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতেন। তার অভিজ্ঞতা কঠিন পিচ, তীব্র গতি এবং সিম-মুভমেন্টের বিরুদ্ধে এক অমূল্য সম্পদ ছিল।

৪.২. ড্রেসিংরুমের অনুপ্রেরণা:

তিনি শুধু স্কোরবোর্ডেই অবদান রাখতেন না, ড্রেসিংরুমেও ছিলেন একজন অনুপ্রেরণা। তার দৃঢ় মানসিকতা তরুণ ক্রিকেটারদের সাহস জোগাত। তার ব্যাটিং দেখে দলের বাকি খেলোয়াড়রা বিশ্বাস পেতেন যে, সবচেয়ে ভয়ংকর বোলারদেরও মোকাবিলা করা সম্ভব।

৫.  মৃত্যুসংবাদে শোকাহত ক্রিকেট দুনিয়া: শ্রদ্ধা ও স্মরণ

রবিন স্মিথের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রাক্তন সতীর্থ, কোচ, ক্রিকেটার, বিশ্লেষক এবং ভক্ত—সকলেই স্মরণ করছেন তার অবদান এবং সাহসিকতা।

  • ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড (ECB): তাদের শোকবার্তায় লিখেছে—"A courageous cricketer, a wonderful teammate, and a gentleman of the game. Robin Smith’s unique approach and strength against the fastest bowling attacks will be missed forever."

  • মাইকেল ভন (প্রাক্তন অধিনায়ক): "An absolute icon of courage. Facing the fastest bowlers in the world with dignity and strength. His fearlessness was his trademark. RIP Robin."

  • নাসের হুসেইন: "England cricket owes a lot to Robin Smith. His courage was unmatched, and he was a crucial player during a very difficult time for the team. Sad news."

  • গ্রাহাম গুচ: "A true fighter. He took on the bouncers and delivered. A sad, sad day for English cricket."

ভক্তদের অসংখ্য শ্রদ্ধা বার্তায় সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেছে, যেখানে তারা তার বিখ্যাত পুল এবং কাট শটগুলির ভিডিও শেয়ার করছেন।

৬.  আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার পরের জীবন ও মেন্টরশিপ

২০০৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর রবিন স্মিথ ক্রিকেট থেকে পুরোপুরি দূরে সরে যাননি। তিনি মূলত কোচিং, ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট এবং তরুণ খেলোয়াড়দের মেন্টরশিপে যুক্ত ছিলেন।

  • কোচিং ও একাডেমি: তিনি নিয়মিত ইংল্যান্ডে ক্রিকেট একাডেমিগুলিতে কাজ করতেন এবং তরুণ প্রতিভাদের ব্যাটিং কৌশল শেখাতেন। তার অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ করে শর্ট বল মোকাবিলা করার কৌশল নতুন প্রজন্মের কাছে ছিল এক অমূল্য পাঠ।

  • আত্মজীবনী: তার আত্মজীবনী "The Judge" ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়, যেখানে তিনি তার ক্যারিয়ারের চ্যালেঞ্জ, ইনজুরি এবং কঠিন প্রতিপক্ষদের মোকাবিলা করার গল্প তুলে ধরেছেন।

তার জীবন প্রমাণ করে—ক্রিকেট মাঠ থেকে অবসর নিলেও, ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা কখনও শেষ হয়নি।

৭.  রবিন স্মিথের উত্তরাধিকার: এক নির্ভীক যোদ্ধার প্রতিচ্ছবি

রবিন স্মিথ তার ব্যাটিং গড় বা শতকের সংখ্যার চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে ক্রিকেটে নিজের ছাপ রেখে গেছেন—তিনি রেখে গেছেন এক নির্ভীক মানসিকতা। তার উত্তরাধিকার হলো:

  • ১. সাহসিকতার প্রতীক: তিনি প্রমাণ করেছিলেন, গতিকে ভয় না পেয়েও সাফল্যের সঙ্গে খেলা যায়।

  • ২. 'ফাইট' ব্যাকের অনুপ্রেরণা: তার প্রতিটি ইনিংস ছিল বিপক্ষের চাপের মুখে এক নীরব প্রতিবাদ।

  • ৩. ক্রিকেটের ভদ্রতা: মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক, যার বিনয় ছিল তার শক্তির মতোই গভীর।

তিনি ছিলেন এক যোদ্ধা, এক কিংবদন্তি এবং এক নিঃশব্দ কিন্তু শক্তিশালী নায়ক। তার প্রয়াণে ক্রিকেট হারাল এক অবিস্মরণীয় রত্ন।

শান্তিতে থাকুন রবিন স্মিথ। ক্রিকেট বিশ্ব আপনাকে আপনার সাহস, দক্ষতা এবং ক্রিকেটের প্রতি নিবেদনের জন্য চিরকাল গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে।

Preview image