রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বর্তমানে এক অভূতপূর্ব অসামঞ্জস্যের পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল, সার, কয়লা এবং প্রতিরক্ষা উপকরণ আমদানি বাড়ার ফলে দুই দেশের বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবর্ষে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৩.৮ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতের রাশিয়ায় রপ্তানি মাত্র ৪.৮ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে ভারত এখন নতুন কৌশলে এগোচ্ছে কৃষিজাত পণ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং সরঞ্জাম এবং ফার্মাসিউটিক্যাল রপ্তানি বিস্তারের পরিকল্পনা।
বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক দ্রুত বদলাচ্ছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, বিশ্ববাজারে সরবরাহ সংকট— এসব পরিবর্তনের মাঝে ভারত ও রাশিয়া নতুন বাণিজ্যিক সমীকরণে প্রবেশ করছে। এই নতুন পর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যালান্স।Financial Express–এর রিপোর্টে সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, রাশিয়ার বর্তমান আমদানি বাজার ভারতের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে।
এখনকার পরিস্থিতি জটিল:
ভারত রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, সার, কয়লা ও সামরিক উপকরণ আমদানি করে, যার ফলে দুই দেশের বাণিজ্য পুরোপুরি একদিকে ঝুঁকে আছে।
দুই দেশের বাণিজ্যের মধ্যে বিশাল ৫৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি।
এই ঘাটতি ভারতের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি তৈরি করছে।
এই মুহূর্তে ভারত সরকার, বাণিজ্য মন্ত্রক এবং একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানাচ্ছেন—
কৃষিজাত পণ্য,
প্রকৌশল (engineering) সামগ্রী,
ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধ ও API
—এই তিন খাতে রপ্তানি বৃদ্ধি করলে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।
এই প্রতিবেদনে আমরা দেখব—
কেন রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য অসম
কোন কোন পণ্য রপ্তানিতে বিশাল বাজার তৈরি হতে পারে
কেন রাশিয়ার বাজার এখন ভারতের জন্য “Golden Opportunity”
ফার্মা, কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং— কোন খাতে কত সম্ভাবনা
রাশিয়ার আমদানি চাহিদা কত বড়
কোন বাধাগুলি দূর করতে হবে
কীভাবে ভারতের রপ্তানি দ্বিগুণ হতে পারে
রাশিয়ার অর্থনৈতিক নীতি ভারতের জন্য কী সুযোগ খুলে দিচ্ছে
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লাভ
চলুন বিশদে বিষয়টি জানা যাক।
ভারত–রাশিয়া সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী হলেও বাণিজ্যিক কাঠামো ছিল অসম।
রাশিয়া মূলত ভারতকে দেয়—
অপরিশোধিত তেল
কয়লা
সার
ডিফেন্স ইকুইপমেন্ট
স্টিল/মিনারেল
জ্বালানি-সম্পর্কিত পণ্য
এগুলো উচ্চমূল্যের পণ্য। ফলে আমদানির পরিমাণ দ্রুত বাড়ে।
কিন্তু ভারত রাশিয়ায় রপ্তানি করে—
চা
কফি
অর্গানিক রাসায়নিক
ওষুধ
যন্ত্রপাতি
কিছু কৃষিজাত পণ্য
দুই দেশের বাণিজ্যের ধরন থেকেই বোঝা যায়—
ভারত যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তার মূল্য অনেক কম।
ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকে।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ ক্রমশ বাড়ছে।
এতে রাশিয়ার আমদানি কাঠামো বদলে গেছে।
পূর্বে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান— এসব দেশের থেকে যে পণ্য তারা আমদানি করত, এখন তা বন্ধ বা কমেছে।
ফলে রাশিয়া এখন—
এশিয়া
মধ্যপ্রাচ্য
দক্ষিণ আমেরিকা
চীন
ভারত
—এদের দিকে ঝুঁকছে।
রাশিয়ার বাজারে এখন ভীষণ চাহিদা—
কৃষিজাত খাবার
নির্মাণ সরঞ্জাম
প্রকৌশল যন্ত্রপাতি
ওষুধ
স্বাস্থ্য সরঞ্জাম
রাসায়নিক
টেক্সটাইল
FMCG
ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি এক বিশাল সুযোগ।
Financial Express রিপোর্টে জানা গেছে—
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রক বিশ্বাস করে, এই তিনটি খাতই রাশিয়ার আমদানি চাহিদার সঙ্গে ভারতের উৎপাদন শক্তির সেরা মিল।
রাশিয়ায় মুদিখানা-খাদ্য আমদানির অর্থনৈতিক মূল্য কয়েক বিলিয়ন ডলার।
ভারত রপ্তানি করতে পারে—
শস্য
মসলা
চা
কফি
প্রসেসড ফুড
ফল
সবজি
ডেয়ারি পণ্য
চাল
রাশিয়ার বাজারে এগুলির প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
রাশিয়া বর্তমানে চীন থেকে প্রচুর ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য নিচ্ছে।
ভারত সেই জায়গায় প্রবেশ করতে পারে—
পাম্প
মোটর
কৃষি সরঞ্জাম
নির্মাণ যন্ত্র
ছোট শিল্প যন্ত্র
অটোমোবাইল পার্টস
বিশ্বে ভারতের ওষুধ সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং মানসম্মত।
রাশিয়া ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর সহজেই নির্ভর করতে পারে।
বিশেষ করে—
জেনেরিক ওষুধ
API
মেডিক্যাল ডিভাইস
ভিটামিন/সাপ্লিমেন্ট
ক্যান্সার/ডায়াবেটিস ওষুধ
এই খাতে কয়েক বিলিয়ন ডলার রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
Financial Express–এ উল্লেখ—
রাশিয়ার মোট আমদানি বাজার ৪০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
এদের মধ্যে—
কৃষিজাত আমদানি — ৬০ বিলিয়ন ডলার
ফার্মা আমদানি — ৩৫–৪০ বিলিয়ন ডলার
ইঞ্জিনিয়ারিং আমদানি — ৮০–১০০ বিলিয়ন ডলার
টেক্সটাইল আমদানি — ২০ বিলিয়ন ডলার
কনজিউমার গুডস — ৩০–৪০ বিলিয়ন ডলার
কিন্তু ভারত এখান থেকে রপ্তানি করছে—
মাত্র ৪৫২ মিলিয়ন ডলারের কৃষিজাত পণ্য,
এবং সামগ্রিক রপ্তানি ৪.৮ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ—
রাশিয়ার দৃষ্টিতে ভারত একটি—
নির্ভরযোগ্য
রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল
বন্ধুভাবাপন্ন
বৈচিত্র্যময় উৎপাদন ব্যবস্থা যুক্ত
সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য সরবরাহকারী
দেশ।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে বাধ্য করেছে—
“India can become the alternate supply chain hub.”
—রাশিয়ান ট্রেড অফিসার
রাশিয়ার বাজারে খাদ্যের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা:
ল্যাব টেস্ট
মান নিয়ন্ত্রণ
শংসাপত্র
প্যাকেজিং
ইউরোপের রুট বন্ধ হওয়ায় এখন পণ্য যেতে হয়—
Via UAE
Via Iran
Via Central Asia
Via Sea–Land route
রুবল–রুপি ব্যবস্থায় কিছু অসুবিধা রয়েছে।
অনেক MSME রাশিয়ার বাজার সম্পর্কে জানেই না।
রাশিয়ায় ভারতীয় চায়ের চাহিদা প্রবল।
কেনার ক্ষমতা বেশি।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর অনেক চা–সরবরাহকারী দেশ হারিয়েছে।
গরম মশলা
হলুদ
আদা
রসুন
বেসন
চাল
গম
ডাল
আপেল
ডালিম
কলা
কমলা
আঙুর
ঘি
বাটার
পনির
ট্রাক্টর
হারভেস্টার
পাম্প
মিনি–টিলার
মিনি–ডোজার
ক্রেন
ইট তৈরির মেশিন
ব্রেক শু
পিস্টন
চাকা
বেয়ারিং
সাব-স্টেশন ইকুইপমেন্ট
জেনারেটর
মোটর
ভারত বিশ্বে জেনেরিক ওষুধের “ফার্মাসি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”।
রাশিয়ায়—
ক্যান্সার ওষুধ
ডায়াবেটিস ওষুধ
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ
অ্যান্টিবায়োটিক
পেনকিলার
API
মেডিক্যাল ডিভাইস
এই সব ক্ষেত্রেই ভারত দারুণ প্রতিযোগিতামূলক।
রাশিয়া বর্তমানে ইউরোপীয় ও আমেরিকান ওষুধ আমদানি কমাচ্ছে।
এটি ভারতীয় ওষুধ শিল্পের জন্য সোনার সুযোগ।
ভারত ও রাশিয়া কাজ করছে—
India → Iran → Azerbaijan → Russia পথ।
এশিয়ার নতুন বাণিজ্য পথ।
এই দুই পথ তৈরি হলে—
পরিবহন খরচ কমবে
ট্রানজিট সময় কমবে
রপ্তানি বাড়বে
বাণিজ্য ঘাটতি কমবে
রাশিয়ার বাজারে ভারত শক্ত অবস্থান নেবে
কৃষি ও MSME খাতে কর্মসংস্থান বাড়বে
আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় পণ্যের মর্যাদা বাড়বে
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে
“ভারত যদি রাশিয়ার বাজারের ১০% দখল করতে পারে, তাহলে রপ্তানি ৪–৫ গুণ বাড়বে।”
“Indian medicines are cheaper and effective. Russia can shift quickly.”
“Agriculture + Engineering + Pharma = Perfect Match For Russia.”
রাশিয়ার বাজার এখন ভারতের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনা, রপ্তানি অবকাঠামো উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ, লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে—
ভারত আগামী ৩–৫ বছরের মধ্যে রাশিয়ার বাজারে ২০–২৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পারবে।
এটি শুধু বাণিজ্য ঘাটতি কমাবে না, বরং—
ভারতকে বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।