Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

ইন্ডিগোতে দেশজুড়ে ফ্লাইট সংকট ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিলম্ব, বহু ফ্লাইট বাতিল যাত্রী ভোগান্তি চরমে

ভারতের বৃহত্তম বিমান সংস্থা IndiGo গত কয়েক দিন ধরে অভূতপূর্ব বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রায় সব প্রধান বিমানবন্দর দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ প্রায় সর্বত্রই ইন্ডিগোর অসংখ্য ফ্লাইট হয় মারাত্মকভাবে বিলম্বিত হয়েছে, না হলে শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়েছে। Times of India এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মাত্র নভেম্বর মাসেই ইন্ডিগো ১,২০০ র বেশি ফ্লাইট বাতিল করেছে, যা গত বছরের তুলনায় রেকর্ড বৃদ্ধি।

ইন্ডিগোতে দেশজুড়ে ফ্লাইট বিলম্ব ও বাতিল: যাত্রী ভোগান্তি চরমে — কীভাবে তৈরি হলো এই বিশৃঙ্খলা? পূর্ণাঙ্গ বিশেষ রিপোর্ট

ভারতের সবচেয়ে বড় বিমান সংস্থা ইন্ডিগো (IndiGo) বর্তমানে এক নজিরবিহীন সংকটের মুখোমুখি। গত কয়েক দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে ইন্ডিগোর অসংখ্য ফ্লাইট হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিলম্বিত হচ্ছে, না হলে সরাসরি বাতিল করা হচ্ছে। ফলত, সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে বিমানবন্দর প্রাঙ্গণ— প্রতিটি জায়গাতেই যাত্রীদের হাঁসফাঁস, হতাশা, ক্ষোভ আর অনিশ্চয়তার ছবি ফুটে উঠছে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে What Led to the CHAOS?— সেই প্রশ্ন আজ দেশের কোটি যাত্রীর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। Times of India–র রিপোর্ট অনুযায়ী, গত কয়েক দিনে ইন্ডিগোর অভ্যন্তরীণ অপারেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বহুমাত্রিক কারণে। এই বিশৃঙ্খলা শুধু যাত্রী অসুবিধা নয়, ভারতের সামগ্রিক এভিয়েশন সিস্টেমের উপরও প্রভাব ফেলেছে।
 

এই ভোগান্তির প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে পাইলট ও কেবিন ক্রু–সংকট। DGCA–র নতুন “ডিউটি টাইম ও রেস্ট রুল” কার্যকর হওয়ায় ক্রুদের বিশ্রামের সময় বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে একাধিক ক্রু একইসাথে ফ্লাইট অপারেশনে অনুপস্থিত থাকেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আচমকা অসুস্থতার কারণে একসাথে অনেক ক্রুর লিভ নেওয়া। ফলাফল— বহু ফ্লাইটে ক্রু–ঘাটতি, যা সরাসরি ফ্লাইটের সময়সূচি ভেঙে দেয়।

এর পাশাপাশি শীতকালীন কুয়াশা, উত্তর ভারতের খারাপ ভিজিবিলিটি, এয়ার ট্রাফিক কনজেশন ও টেকনিক্যাল ত্রুটি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিমানবন্দরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, শিশু–বয়স্কদের কষ্ট, ট্রানজিট মিস, ব্যাগেজ বিলম্ব— যাত্রীদের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে। অনেক যাত্রী অভিযোগ করেছেন, ফ্লাইট বাতিল বা দেরির নোটিশ শেষ মুহূর্তে দেওয়া হয়েছে, ফলে বিকল্প ব্যবস্থা করার সময় পাননি।

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে DGCA ইন্ডিগোকে শো–কজ নোটিস জারি করেছে। সংস্থাকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে— কেন এত ফ্লাইট বিপর্যয়, কেন যাত্রীদের ঠিকমতো জানানো হয়নি এবং কেন রোস্টার ম্যানেজমেন্টে ত্রুটি ছিল। ইন্ডিগোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সময়সূচি স্বাভাবিক করা হবে এবং অতিরিক্ত ক্রু মোতায়েন, রোস্টার পুনর্গঠন ও কিছু ফ্লাইট কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই দীর্ঘ প্রতিবেদনে আমরা বিশদে আলোচনা করব—

 কীভাবে শুরু হলো এই সঙ্কট

 কী কী কারণে ইন্ডিগোর সময়ানুবর্তিতা ভেঙে পড়লো

 ক্রু-সংকট থেকে আবহাওয়া — কোন কোন কারণ সবচেয়ে গুরুতর

 যাত্রীরা কী ধরনের সমস্যায় পড়লেন

 সরকারের (DGCA) হস্তক্ষেপ

 ইন্ডিগোর দাবি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

 এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

 এয়ারলাইন্সের ইমেজ ও ব্যবসার ভবিষ্যৎ প্রভাব

 সমাধানের পথ কী?


 ১. সঙ্কটের সূচনা কোথায়?

ভারতের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কয়েক মাস ধরেই চাপের মধ্যে ছিল। উৎসবের মরশুম, শীতকালীন অপারেশন, বিমানবন্দর ভিড়, এবং বাড়তে থাকা যাত্রী সংখ্যা— সব মিলিয়ে বিমান সংস্থাগুলির উপর কাজের চাপ অনেকটাই বেড়েছিল। কিন্তু ইন্ডিগোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হঠাৎ করেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গত সপ্তাহের শেষ দিক থেকে যাত্রীদের ক্রমাগত অভিযোগ আসতে থাকে—

  • ফ্লাইট ২–৩ ঘণ্টা নয়, ৮–১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্ব

  • হঠাৎ করে ফ্লাইট বাতিল

  • যাত্রীদের আগাম নোটিফিকেশন না দেওয়া

  • অগোছালো গ্রাহক পরিষেবা

  • বিকল্প ফ্লাইটের অভাব

  • ব্যাগেজ ডেলিভারিতে সমস্যা

  • ট্রানজিট যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ

শুরুতে মনে হয়েছিল এগুলি সামান্য কিছু "অপারেশনাল গ্লিচ"। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, বিষয়টি অনেক গভীর। প্রায় প্রতিটি বড় বিমানবন্দর— দিল্লি, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, মুম্বাই, কলকাতা— সব জায়গাতেই ইন্ডিগোর সময়সূচি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে।


 ২. প্রধান কারণ: ক্রু (পাইলট-কেবিন ক্রু) সংকট সবচেয়ে বড় ভূমিকা

এই পুরো বিশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় এবং তীব্র কারণ— ক্রু–সংকট।

ইন্ডিগোর হাজারের বেশি দৈনিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পাইলট ও কেবিন ক্রু প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ঘটনা এই স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়—

 (ক) নতুন “ডিউটি আওয়ার” নিয়ম — বিশ্রামের সময় বৃদ্ধি

DGCA-র নতুন নিয়ম অনুযায়ী পাইলটদের "Duty Time Limit" কমানো হয়েছে এবং বিশ্রামের সময় বাড়ানো হয়েছে।
অনেক পাইলটের “Flight Duty Period” কমে গেছে, ফলে তারা আগের মতো লম্বা সময় উড়তে পারছেন না।

এতে ফ্লাইট শিডিউল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

 (খ) আকস্মিকভাবে অনুপস্থিতি — Sick Leave বেড়ে যাওয়া

কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়, অনেক পাইলট হঠাৎ একসাথে সিক লিভ নেন।
ফলে অনেক ফ্লাইটের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রু অপ্রাপ্য হয়ে পড়ে।
এমনকি কেবিন ক্রুর অনেক সদস্যকেও অতিরিক্ত কাজের চাপে ছুটি নিতে হয়।

ফল: বৃহৎ ক্রু ঘাটতি → ফ্লাইট বিলম্ব / বাতিল


 ৩. সময়সূচির গোলমাল — শীতকাল, ঘন কুয়াশা এবং ATC ডিলে

শীতের শুরুতে উত্তর ভারতের বিমানবন্দরগুলো ঘন কুয়াশার সমস্যায় পড়তে শুরু করেছে।
বিশেষত দিল্লি ও লখনৌতে ভিজিবিলিটি কমে যায়।
এতে ATC (Air Traffic Control) অনেক ফ্লাইটকে অপেক্ষায় রাখে।

ইন্ডিগো যেহেতু ঘণ্টায় ৮০–১০০ ফ্লাইট অপারেট করে, কয়েক ঘণ্টার ATC ডিলে চেইন সিস্টেম ভেঙে পড়ে।


 ৪. প্রযুক্তিগত সমস্যার হার: ছোট ত্রুটি → বড় বিপর্যয়

TOI–র রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইন্ডিগোর একাধিক বিমানে প্রযুক্তিগত ত্রুটি পাওয়া গেছে।
যদিও এসব "মাইনর ইস্যু", কিন্তু এভিয়েশনে ছোট ত্রুটি মানেই ফ্লাইট আটকে দেওয়া

একেকটি বিমান দাঁড়িয়ে গেলে তার পরের

  • ৩–৪টি ফ্লাইট,

  • তার স্লট,

  • তার যাত্রীরা
    সবাই প্রভাবিত হয়।

এই ডোমিনো এফেক্টই বিলম্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।


 ৫. নভেম্বর মাসে ১,২০০–এর বেশি ফ্লাইট বাতিল — ঐতিহাসিক রেকর্ড

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসেই ইন্ডিগো ১,২৩২টি ফ্লাইট বাতিল করেছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেশি।
এত বড় সংখ্যায় বাতিল হওয়া মানেই সংস্থার অভ্যন্তরীণ সিস্টেমে বড় সমস্যা রয়েছে।


 ৬. যাত্রীদের জন্য এটি কী পরিমাণ দুর্ভোগ তৈরি করেছে?

ভারতের এভিয়েশন ইতিহাসে এরকম পরিস্থিতি কমই দেখা যায়।
যাত্রীরা নিম্নলিখিত সমস্যার সম্মুখীন হন—

 ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে বসে অপেক্ষা

 ছোট বাচ্চা ও বয়স্ক যাত্রীর জন্য মারাত্মক কষ্ট

 কোনও পূর্ব নোটিশ না পাওয়া

 টিকিটের দাম ফেরত না পাওয়া বা বিলম্ব

 ব্যাগেজ আটকে যাওয়া

 ট্রানজিট মিস হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক যাত্রা নষ্ট

 হোটেল বা বিকল্প পরিবহনের খরচ যাত্রীদের বহন

কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়—
যেখানে দেখা যায় যাত্রীরা এয়ারলাইন্স কাউন্টারের সামনে বসে প্রতিবাদ করছেন।
কেউ কেউ দাবি করেন, “৩ ঘণ্টা পর জানানো হচ্ছে— ফ্লাইট বাতিল!”


 ৭. DGCA হস্তক্ষেপ করেছে — শো-কজ নোটিস

DGCA ইতিমধ্যেই ইন্ডিগোর কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছে—

news image
আরও খবর
  • কেন এত ফ্লাইট বিলম্বিত?

  • কেন যাত্রীদের সময়মতো তথ্য দেওয়া হয়নি?

  • কেন যথেষ্ট ব্যাকআপ প্ল্যান ছিল না?

DGCA বলেছে, যাত্রীরা যাতে ক্ষতিপূরণ পান, তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে।


 ৮. ইন্ডিগোর বক্তব্য — “আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অবস্থা ঠিক হবে”

ইন্ডিগো জানিয়েছে—

  • ক্রু রোস্টার পুনর্গঠন করা হচ্ছে

  • ফ্লাইট শিডিউল কমিয়ে আনা হচ্ছে

  • স্ট্যান্ডবাই পাইলট বাড়ানো হচ্ছে

  • গ্রাহক সেবায় আরও লোক যুক্ত করা হচ্ছে

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
“এটি ২ দিনের সমস্যা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনার অভাব।”


 ৯. বিশেষজ্ঞদের মতে সমস্যার ৫টি মূল কারণ

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন—

  1. ক্রু ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দুর্বল

  2. অতিরিক্ত ফ্লাইট শিডিউল, পর্যাপ্ত ব্যাকআপ নেই

  3. পাইলটদের কাজের চাপ বৃদ্ধি

  4. শীতকালীন বিঘ্নের জন্য প্রস্তুতির অভাব

  5. গ্রাহক পরিষেবা ও নোটিফিকেশন সিস্টেম অকার্যকর


 ১০. ইন্ডিগোর ব্র্যান্ড ইমেজ ও ব্যবসার ভবিষ্যৎ ক্ষতি

ভারতের যাত্রীদের মধ্যে ইন্ডিগোর ইমেজ সবসময়ই "সময়নুবর্তী" ও “ঝামেলাবিহীন” এয়ারলাইন্স হিসেবে ছিল।
কিন্তু এই ঘটনায়—

  • ব্র্যান্ডের উপর আস্থা নষ্ট হচ্ছে

  • সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ক্ষোভ

  • প্রতিযোগী এয়ারলাইন্স লাভবান হতে পারে

  • দীর্ঘমেয়াদে টিকিট বিক্রি কমে যেতে পারে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
“যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে ইন্ডিগোর মার্কেটে বড় আঘাত আসতে পারে।”


 ১১. যাত্রীদের জন্য করণীয়

 যাত্রার আগে ফ্লাইট স্ট্যাটাস চেক করুন
 সম্ভব হলে বিমানবন্দরে আগেভাগে পৌঁছান
 ইন্ডিগোর অ্যাপ / SMS নোটিফিকেশন সক্রিয় রাখুন
 প্রয়োজন হলে DGCA–তে অভিযোগ জানাতে পারেন
 বিকল্প পরিবহন/ফ্লাইট প্রস্তুত রাখুন


 ১২. ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন আসতে পারে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে ইন্ডিগোকে—

  • পাইলট ও ক্রু সংখ্যা বাড়াতে হবে

  • ব্যাকআপ প্লেন ও ব্যাকআপ ক্রু রাখতে হবে

  • সময়সূচি আরও বাস্তবসম্মত করতে হবে

  • প্রযুক্তিগত ত্রুটি কমাতে উন্নত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন

  • গ্রাহক পরিষেবা উন্নত করতে হবে


 শেষ কথা

ভারতের বিমান পরিবহণ খাত ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে— কিন্তু একইসাথে
যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে, বিমানবন্দর ব্যস্ত হয়েছে, এবং যাত্রী প্রত্যাশাও বেড়েছে।

এই অবস্থায় ইন্ডিগোর এই বিপর্যয় ভারতীয় এভিয়েশন সেক্টরের জন্য বড় সতর্ক সংকেত।
সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

যাত্রী, পাইলট, সংস্থা ও সরকার— সকলের মিলিত উদ্যোগেই ভারতীয় বিমান পরিবহণ খাতকে নির্ভরযোগ্য রাখা সম্ভব।

Preview image