Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

রানা সরকারের কটাক্ষে জিৎকে ঘিরে তোলপাড় টলিউড

প্রযোজক রানা সরকার প্রকাশ্যে জিৎকে আক্রমণ করে বলেছেন, সাউথের ছবি কপি করে আর কাজ হবে না। তাঁর দাবি, জিৎ এখন ব্যর্থতার দায় ঢাকতে বলছেন বাংলায় ভালো লেখক নেই। এই মন্তব্য ঘিরেই উত্তাল টলিউড।

রানা সরকারের কটাক্ষে জিৎকে ঘিরে তোলপাড় টলিউড

টলিউডে ফের শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। এই ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিন পর এমন সরাসরি মুখোমুখি অবস্থান খুব কমই দেখা গেছে। কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন একদিকে বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক জিৎ, আর অন্যদিকে খ্যাতনামা প্রযোজক রানা সরকার। মুখের কথায় আগুন ছুঁড়ে দিয়েছেন রানা, আর সেই আগুন এখন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে।

বিতর্কের সূচনা

সবকিছু শুরু এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার থেকে। এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রানা সরকার বলেন,

“জিৎ এতদিন সাউথের ছবি কপি করেছেন। এখন বুঝতে পেরেছেন, ফ্রেম টু ফ্রেম কপি করে মুভি চলে না। কারণ, শেষ কয়েকটি ছবি একেবারেই ফ্লপ।”

এরপর আরও একটি মন্তব্যেই চড়ে যায় বিতর্কের পারদ। রানা জানান,

“এখন আবার তিনি বাহানা দিচ্ছেন—বাংলায় নাকি ভালো লেখক নেই! এই মন্তব্য বাংলা চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য, লেখক ও চিত্রনাট্যকারদের প্রতি একেবারে অসম্মানজনক।”

এই কথাগুলো প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয় তুমুল প্রতিক্রিয়া। টলিউডের একাংশ রানা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, সত্যিই অনেক বাণিজ্যিক ছবি এখনও দক্ষিণী সিনেমার রিমেকের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, জিৎ-এর অনুরাগী এবং তাঁর সহকর্মীরা দাবি করেন—রানা সরকারের মন্তব্য ব্যক্তিগত আক্রমণ, যা একজন শিল্পীর প্রতি অসম্মান।


জিৎ: জনপ্রিয়তা, সাফল্য ও নতুন চ্যালেঞ্জ

টলিউডের বর্তমান বাণিজ্যিক ছবির জগতে জিৎ এক অদ্ভুত অবস্থানে আছেন। ২০০২ সালে সাথী ছবির মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেকের পর থেকেই তিনি একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন—নাটের গুরু, যুদ্ধ, বস, অওয়ারা, বস টু—সবই বাণিজ্যিকভাবে সফল। তাঁর ছবিগুলোয় রোমান্স, অ্যাকশন, আর হিরোইজমের মিশ্রণ থাকে যা দর্শককে দীর্ঘদিন ধরে আকর্ষণ করেছে।

তবে গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। বাংলা সিনেমায় এখন দর্শকের রুচি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। দর্শকরা নতুন গল্প, বাস্তবধর্মী কাহিনি, এবং ভিন্ন ধারার সিনেমা চাচ্ছেন। ফলে প্রচলিত ‘মাস অ্যাকশন’ ঘরানার ছবির বাজার কিছুটা সঙ্কুচিত হয়েছে। জিৎ-এর সাম্প্রতিক কয়েকটি ছবি যেমন বাজি, রাবণ বা চেঞ্জজ বক্স অফিসে আশানুরূপ সাড়া ফেলতে পারেনি।

এই ব্যর্থতার প্রেক্ষিতেই, এক অনুষ্ঠানে জিৎ বলেছিলেন,

“বাংলায় ভালো লেখক খুব কম। নতুন গল্প পাচ্ছি না। সবাই একই রকম গল্প নিয়ে আসে, তাই নতুন কিছু করার সুযোগ মেলে না।”

আর এখান থেকেই রানা সরকারের প্রতিক্রিয়া শুরু।


রানা সরকারের যুক্তি ও সমালোচনা

রানা সরকার বাংলা চলচ্চিত্রে এক পরিচিত নাম। বিবাহ অভিযান, চৌরঙ্গী, কিত্তন–এর মতো ছবির প্রযোজক তিনি। তাঁর বক্তব্য,

“বাংলা ভাষার সাহিত্যিক ঐতিহ্য বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর—তাঁদের দেশে কেউ যদি বলে লেখকের অভাব, সেটা তো হাস্যকর! আজও অনেক তরুণ লেখক চমৎকার গল্প লিখছেন। কিন্তু প্রযোজক-অভিনেতারা ঝুঁকি নিতে চান না।”

তিনি আরও বলেন, “দর্শকের পছন্দ বদলেছে, তাই শুধু রিমেক বা ফর্মুলা ফিল্মে কাজ হবে না। মৌলিক গল্পে বিনিয়োগ করতেই হবে।”

এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি পরোক্ষে ইঙ্গিত দেন—জিৎ যদি নতুন ধারা গ্রহণ না করেন, তাহলে তাঁর জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।


টলিউডের প্রতিক্রিয়া

এই মন্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে টলিউড। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং পরিচালকেরা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মত প্রকাশ করেছেন।

একজন তরুণ পরিচালক বলেছেন,

“রানা সরকারের বক্তব্যে যুক্তি আছে। আমরা অনেকদিন ধরে মৌলিক গল্পে কাজ করতে চেয়েছি, কিন্তু বড় প্রযোজনা ঘর বা তারকা অভিনেতারা ঝুঁকি নিতে চান না। সবাই নিরাপদ পথেই হাঁটতে চান।”

অন্যদিকে, একজন সিনিয়র অভিনেত্রী মন্তব্য করেন,

“জিৎ বাংলা ইন্ডাস্ট্রির মুখ। তাঁর অবদান অস্বীকার করা যায় না। যে মানুষ ২০ বছর ধরে দর্শকের মন জয় করেছেন, তাঁকে নিয়ে এমনভাবে প্রকাশ্যে কথা বলা উচিত নয়।”

অর্থাৎ, কেউ রানার বক্তব্যে যুক্তি দেখছেন, কেউ আবার সেটিকে অহেতুক কটাক্ষ বলেই মনে করছেন।


সিনেমার কপি সংস্কৃতি: এক পুরনো বাস্তবতা

রানা সরকারের বক্তব্যে একটি বড় ইস্যু উঠে এসেছে—বাংলা সিনেমায় দক্ষিণী ছবির রিমেক সংস্কৃতি। এটি কোনো নতুন বিষয় নয়। গত এক দশকে টলিউডে অসংখ্য হিট ছবি সরাসরি বা আংশিকভাবে দক্ষিণ ভারতের সফল ছবির অনুকরণে তৈরি হয়েছে। জিৎ, দেব, সোহম, অঙ্কুশ—প্রায় সব বাণিজ্যিক নায়কের ফিল্মোগ্রাফিতে রিমেক ছবির সংখ্যা কম নয়।

এই প্রবণতা নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। অনেকে বলেন, রিমেক ছবিতে স্থানীয় স্বাদ হারিয়ে যায়, আর সেটি বাংলা দর্শকের কাছে সবসময় গ্রহণযোগ্য হয় না। তবে সমর্থকদের মতে, এই রিমেকই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে এমন সময়ে, যখন বড় বাজেটের মৌলিক গল্পে বিনিয়োগের ঝুঁকি কম মানুষ নেন।

news image
আরও খবর

মৌলিক গল্পের অভাব নাকি সাহসের অভাব?

জিৎ-এর মন্তব্য যে “বাংলায় ভালো লেখক নেই”, সেটি একধরনের হতাশা প্রকাশ করে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, সমস্যা লেখকের অভাবে নয়, বরং সাহসের অভাবে। কারণ বাংলা সাহিত্য, নাটক ও সমসাময়িক সাহিত্যপত্রে অসংখ্য গল্পকার আছেন যাদের কাজ সিনেমায় রূপান্তর করা যায়। কিন্তু সেই সাহসী পদক্ষেপ নিতে প্রযোজক ও তারকারা দ্বিধাগ্রস্ত হন, কারণ ব্যবসায়িক ঝুঁকি থাকে।

একজন চিত্রনাট্যকারের বক্তব্য,

“লেখক আছেন, কিন্তু তাঁদের গল্পকে সিনেমায় রূপ দিতে প্রযোজক-অভিনেতারা আগ্রহ দেখান না। তারা চান আগেই প্রমাণিত ফর্মুলা। ফলে নতুন গল্প আসার পথ আটকে যায়।”

রানা সরকারের কথায়ও এই হতাশা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন,

“বাণিজ্যিক ছবিতে মৌলিকতা আনতে হবে, না হলে দর্শক হারিয়ে যাবে। কপি করে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই।”


সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়

এই বিতর্কে সোশ্যাল মিডিয়া যেন আরও আগুন ঢেলে দিয়েছে। টুইটার (এক্স), ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে নেটিজেনদের মধ্যে শুরু হয়েছে তর্কবিতর্ক।
এক পক্ষ বলছে, “রানা সরকার ঠিকই বলেছেন, জিৎ-এর ছবি এখন পুরনো ধাঁচে চলছে।”
অন্য পক্ষ বলছে, “একজন শিল্পীর পরিশ্রমকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়।”

ফ্যান ক্লাবগুলোও মুখ খুলেছে। Team Jeet Fanatics নামের একটি বড় গ্রুপ লিখেছে,

“জিৎ কখনও নিজেকে লেখক বলেছেন না। তিনি কেবল ইন্ডাস্ট্রির সমস্যার দিকটি তুলে ধরেছেন। তাঁর নাম ব্যবহার করে প্রচার পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

অন্যদিকে, কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্রপ্রেমী মন্তব্য করেছেন,

“বাংলা সিনেমা বাঁচাতে হলে মৌলিক গল্পের দিকেই যেতে হবে। জিৎ-এর মতো তারকাদেরও নতুন প্রতিভাদের সঙ্গে কাজ করা উচিত।”


রানা সরকার বনাম জিৎ: ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের রাজনীতি

এই ঘটনার পেছনে অনেকেই টলিউডের অন্দরমহলের রাজনীতি দেখছেন। রানা সরকার নিজেও বরাবরই সরাসরি মত প্রকাশের জন্য পরিচিত। তিনি প্রায়ই রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে মন্তব্য করেন, যা কখনও কখনও বিতর্ক তৈরি করে। অন্যদিকে, জিৎ তুলনামূলকভাবে সংযত, খুব কমই সংবাদমাধ্যমে ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া জানান।

অনেকে মনে করছেন, এটি কেবল শিল্প সম্পর্কিত নয়, বরং প্রযোজক ও তারকাদের মধ্যে ক্ষমতার টানাপোড়েনের প্রতিফলন। প্রযোজকেরা চান তারকারা তাঁদের শর্তে কাজ করুন, অন্যদিকে জনপ্রিয় অভিনেতারা চান নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে। ফলে মাঝেমধ্যেই এই সংঘাত প্রকাশ্যে আসে।


বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা

বাংলা সিনেমা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আছে বাণিজ্যিক ছবি, অন্যদিকে বিকল্প ও সমান্তরাল ধারার সিনেমা। অটোগ্রাফ, বেলাশেষে, দিতো আমরা, ঘরে বাইরে আজ, প্রজাপতি—এর মতো ছবিগুলো প্রমাণ করেছে, দর্শক ভালো গল্প চায়, ভাষা নয়।

কিন্তু বড় বাজেটের বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে নতুনত্ব আনা যায়। এক সময় যেভাবে দেব, জিৎ, সোহমরা টলিউডে বাণিজ্যিক ছবির স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে এনেছিলেন, এখন সেই ধারা কিছুটা ক্লান্ত। দর্শক ও সমালোচক উভয়েই নতুন কিছু খুঁজছেন। এই প্রেক্ষাপটে, রানা সরকারের মন্তব্য অনেকের কাছে বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেছে।


জিৎ-এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া

এই লেখাটি লেখা পর্যন্ত জিৎ এখনও সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল জানিয়েছে, অভিনেতা আপাতত চুপ থাকছেন। তবে তিনি মনে করেন, “ব্যক্তিগত আক্রমণের জবাব দেওয়া প্রয়োজন নেই। কাজই তাঁর জবাব দেবে।”

তিনি বর্তমানে নতুন একটি সিনেমার শুটিংয়ে ব্যস্ত, যা নাকি একেবারেই মৌলিক গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সূত্র জানাচ্ছে, এটি একটি মানসিক থ্রিলার, যেখানে জিৎকে দেখা যাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রে। যদি সত্যিই সেটি সফল হয়, তবে এই বিতর্কই হয়তো তাঁর জন্য নতুন মোড় আনতে পারে।


সমালোচক ও বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে

চলচ্চিত্র বিশ্লেষক অনিন্দ্য ঘোষ বলেন,

“এই বিতর্ক আসলে বাংলা সিনেমার পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। আগে তারকা মানেই সফলতা ছিল, এখন গল্পই মূল চালিকাশক্তি। তাই জিৎ-দেরও সেই ধারা গ্রহণ করতে হবে।”

আরেক সমালোচক রুপা রায় বলেন,

“রানা সরকার যা বলেছেন, তা কঠোর হলেও ভুল নয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অসংখ্য গল্প আছে। তবে এই কথা প্রকাশ্যে বলার ধরনটা আরও সংযত হতে পারত।”


দর্শকের প্রত্যাশা: তারকা নয়, গল্প

সবশেষে একটাই বিষয় পরিষ্কার—দর্শক এখন গল্প চায়। বড় নাম, জনপ্রিয় গান বা অ্যাকশন দৃশ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে স্ক্রিপ্ট। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থান দর্শকদের চোখ খুলে দিয়েছে। তারা এখন হিন্দি, কোরিয়ান, স্প্যানিশ, এমনকি বাংলা ইন্ডি ছবিও দেখছে। ফলে বাংলা সিনেমাকে টিকে থাকতে হলে মৌলিকতায় ফিরে যেতে হবে।


উপসংহার

রানা সরকার ও জিৎ-এর এই বিতর্ক সাময়িক হলেও এর প্রভাব গভীর। এটি শুধু দুই ব্যক্তির বিরোধ নয়, বরং বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি—কপি বনাম মৌলিকতা, নিরাপত্তা বনাম ঝুঁকি, তারকা বনাম গল্প।

জিৎ আগামী দিনে কীভাবে জবাব দেন, তা দেখার বিষয়। কিন্তু এতটুকু নিশ্চিত—এই বিতর্ক টলিউডকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। হয়তো এই সংঘাতই বাংলা সিনেমাকে এক নতুন দিক দেখাবে—যেখানে তারকা শক্তির চেয়ে গল্প বলার শক্তিই হবে মূল নায়ক।

Preview image