শুভমান গিল ঘাড়ের চোটের কারণে ইডেন গার্ডেন্সে ভারত–দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম টেস্টে আর অংশ নিতে পারবেন না। হঠাৎ চোটের কারণে দল থেকে নাম প্রত্যাহার করতে হয়েছে তাকে, যা ভারতীয় শিবিরে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতীয় ক্রিকেটে শুভমান গিলের নাম আজ এক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ তারকার পরিচিতি। ব্যাট হাতে তাঁর নান্দনিক স্ট্রোকপ্লে, ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং, এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দলের অপরিহার্য সদস্য করে তুলেছে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে কিংবা মিডল অর্ডারে তাঁর উপস্থিতি দলের ওপর আলাদা আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। কিন্তু ইডেন গার্ডেন্সে ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম টেস্টের আগে যখন জানা গেল যে ঘাড়ের চোটের কারণে শুভমান আর মাঠে নামতে পারবেন না, তখন শুধু টিম ম্যানেজমেন্ট নয়, প্রায় সমগ্র ক্রিকেটপাগল ভারতই বড় ধাক্কা খেল। কারণ এটি শুধু একজন ক্রিকেটারের অনুপস্থিতি নয়, বরং পুরো দলের ব্যাটিং কম্বিনেশনের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে।
ইডেনে এই সিরিজের প্রথম টেস্ট ঘিরে এক বিশেষ উত্তেজনা ছিল। দীর্ঘ সময় পর কলকাতায় টেস্ট ম্যাচ, তার ওপর প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা—একটি দল যারা নিজেদের বোলিং শক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। তাঁদের পেস আক্রমণের সামনে ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্যাটসম্যানদের চ্যালেঞ্জ নিতে হতো, আর সেই লড়াইয়ে শুভমান গিলের মতো ব্যাটসম্যানকে পাওয়া ভারতীয় শিবিরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ম্যাচের ঠিক কয়েক দিন আগে নেটে প্র্যাকটিসের সময় হঠাৎ ঘাড়ে টান লাগে তাঁর। প্রথমে বিষয়টি তেমন গুরুতর মনে না হলেও পরে ফিজিও ও মেডিক্যাল টিম পরীক্ষার পর জানায়, এই অবস্থায় তাঁকে মাঠে নামানো ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রথম টেস্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করতে হয়।
ঘাড়ের চোট সাধারণত দেখতে সাধারণ মনে হলেও, একজন ব্যাটসম্যানের জন্য তা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ব্যাটিংয়ের সময় মাথা, কাঁধ, ঘাড়—সব মিলিয়ে একটি সঠিক ব্যালান্স বজায় রাখতে হয়। সামান্য ব্যথাও শট সিলেকশনে, ফুটওয়ার্কে, এমনকি বলের লাইন–লেন্থ বুঝতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। শুভমান নিজেও জানিয়েছেন যে তিনি ব্যথা অনুভব করছিলেন, বিশেষ করে লেগ–সাইডে শর্ট বল কিংবা আউটসুইঙ্গারের সময় মাথা সামান্য ঘোরানোর ক্ষেত্রে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে তাঁকে বিশ্রাম দেওয়াই ছিল শ্রেয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাঁকে অযথা চাপ দেওয়া যাবে না, কারণ সামনে দীর্ঘ মৌসুম, যেখানে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ রয়েছে।
শুভমান গিল শুধুমাত্র একজন ব্যাটসম্যানই নন, তিনি নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম সেরা মনোভাবের অধিকারী। তাঁর শান্ত মেজাজ, প্রতিটি পরিস্থিতিকে ঠান্ডা মাথায় সামলানোর ক্ষমতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। তাই তাঁর অনুপস্থিতি দলে শুধু পারফরম্যান্সের ঘাটতি তৈরি করবে না, মনোবলেও কিছুটা প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে ইডেন গার্ডেন্সের মতো ঐতিহাসিক মাটিতে তিনি খেলার সুযোগ হারানোয় তাঁর ভক্তদেরও হতাশা চরমে পৌঁছেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে ভারতের ব্যাটিং ভরসা সবসময়ই শীর্ষ–চারের ওপর নির্ভর করে থাকে। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, কে এল রাহুল—এদের সঙ্গে শুভমান গিলকে ধরেই দলের কৌশল সাজানো হয়। ওপেনার হিসেবে তাঁর উপস্থিতি রোহিতকে স্বচ্ছন্দে নিজের খেলায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। আবার যদি মিডল অর্ডারে তাঁকে নামানো হয়, তবে তিন নম্বরে একটি ভরসার জায়গা তৈরি হয়। তাই তাঁর না থাকা মানে সেই কম্বিনেশন পুরো বদলে যাওয়া। কে তাঁর জায়গায় নামবেন, কেমনভাবে ওপেনিং জুটি তৈরি হবে—এসব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টকে।
শুভমানের চোটের খবর প্রকাশ্যে আসতেই ক্রিকেটবিশ্বে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকে। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলেন, শুভমানের মতো তরুণ প্রতিভা টেস্ট ক্রিকেটে আরও বেশি সুযোগ পাওয়া উচিত। ঘাড়ের এই চোট যাতে আরও বড় সমস্যায় না পরিণত হয় তা নিশ্চিত করতে তাঁকে যথেষ্ট বিশ্রাম দেওয়া জরুরি। কেউ কেউ মনে করছেন যে তাঁর অতিরিক্ত ব্যাটিং লোড এবং বিভিন্ন ফরম্যাটের ব্যস্ত সূচি এই চোটের পিছনে ভূমিকা রাখতে পারে। আধুনিক ক্রিকেটে তিন ফরম্যাটে নিয়মিত খেললে শরীরের ওপর প্রবল চাপ পড়ে, তাই পর্যাপ্ত রিকভারি না হলে এ ধরনের ইনজুরি হওয়া খুব স্বাভাবিক।
ইডেন গার্ডেন্সে শুভমানকে দেখতে না পাওয়া নিঃসন্দেহে ভক্তদের জন্য হতাশাজনক। কারণ যেভাবে তিনি সাম্প্রতিক সিরিজগুলিতে ব্যাট করেছেন, তাতে তিনি আজ ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা ফর্মে থাকা ক্রিকেটার। তাঁর কভার ড্রাইভ, পুল শট, ব্যাটের টাইমিং—এসব দেখার জন্য দর্শকরা অপেক্ষা করে থাকেন। ইডেনের সবুজ উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার পেসারদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই দেখার আশা ছিল অনেকেরই। কিন্তু চোট তাঁকে আপাতত সেই লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
তবে আশার কথা হল, শুভমানের চোট গুরুতর নয়। ফিজিও এবং মেডিক্যাল টিম জানিয়েছে, কয়েকদিন বিশ্রামে থাকলে এবং সঠিক থেরাপি নিলে তিনি দ্রুতই দলে ফিরে আসতে পারবেন। চোটের আপডেট অনুযায়ী দ্বিতীয় টেস্টের আগে তাঁর অবস্থা আবার পরীক্ষা করা হবে। যদি তখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ হন, তবে তাঁকে দলে ফেরানো হতে পারে। ভারতীয় দলও চাইবে তাঁকে দ্রুত ফিরে পেতে, কারণ টেস্ট সিরিজের প্রতিটি ম্যাচই গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রিকেট শুধুমাত্র ব্যাট–বল নয়, এটি মানসিক লড়াইও। ইনজুরি একজন ক্রিকেটারের মনোবল ভেঙে দিতে পারে। শুভমানের ক্ষেত্রে ভক্তরা জানেন যে তিনি মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী। তিনি অতীতে বেশ কয়েকবার চোট থেকে ফিরে অসাধারণ ফর্ম দেখিয়েছেন। তাই এই চোটও তাঁকে থামাতে পারবে না—এমনটাই আশা করছেন সবাই। তাঁর নিজেরও বিশ্বাস, কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই তিনি আবার আগের মতো ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতে পারবেন।
ইডেনে অনুপস্থিতির ফলে ভারতীয় দলের যে সমন্বয়গত সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে টিম ম্যানেজমেন্ট তরুণদের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে। শুভমানের অনুপস্থিতিতে নতুন একজন ক্রিকেটারের সামনে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ তৈরি হবে। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব নেই। তাই কেউ না কেউ অবশ্যই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইবে। তবুও স্বীকার করতেই হয়, শুভমান গিলের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানকে সমানভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়।
ইডেন গার্ডেন্স, যা ভারতীয় ক্রিকেটের গর্ব, সেখানে প্রতিটি বড় ম্যাচের সময় একটি বিশেষ আবহ তৈরি হয়। গ্যালারি ভর্তি দর্শক, উত্তেজনা, প্রতিটি বলের সঙ্গে জীবন্ত হয়ে ওঠা ক্রিকেট—এসব মিলিয়ে এই মাঠে খেলা যেকোনো ক্রিকেটারের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন থেকে শুভমান সাময়িকভাবে দূরে থাকলেও ভবিষ্যতে এই মাঠে তিনি আরও অনেক স্মরণীয় ইনিংস উপহার দেবেন—এটাই সকলের প্রত্যাশা।
শেষমেশ বলতে হয়, চোট ক্রিকেটেরই অংশ। শুভমান গিলের মতো খেলোয়াড়ের জন্য সামনে আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। এই চোট যত দ্রুত সেরে উঠবে, তত দ্রুতই তিনি আবার ব্যাট হাতে মাঠে ফিরে আসবেন। ভারতীয় ক্রিকেট তাঁর মতো প্রতিভার প্রয়োজন আছে, আর দেশজুড়ে কোটি ভক্ত তাঁর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায়।
শুভমান গিলের চোটের পর ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে যে হতাশার তরঙ্গ তৈরি হয়েছে, তার গভীরে রয়েছে এই তরুণ ব্যাটসম্যানের প্রতি মানুষের অসাধারণ বিশ্বাস। আধুনিক ক্রিকেটে যেখানে আগ্রাসী ব্যাটিং এবং দ্রুতগতির রান তোলাই প্রাধান্য পায়, সেখানে শুভমানের ক্লাসিক্যাল টেস্ট ব্যাটিং ভঙ্গি নতুন একটি ব্যাটিং অধ্যায় তৈরি করছে। তাঁর খেলার ধরন দেখে অনেকেই তাঁকে ভবিষ্যতের ভারতীয় ক্রিকেটের স্তম্ভ বলে মনে করেন। তাই তাঁকে মাঠে না দেখা মানেই দর্শকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ হারানো। বিশেষ করে ইডেনে টেস্ট ম্যাচ মানেই ভরা গ্যালারি, উৎসবমুখর পরিবেশ, প্রতিটি স্ট্রোকে উল্লাস—এই আবহে শুভমান ছিলেন উল্লেখযোগ্য তারকা আকর্ষণ।
চোটের কারণে তাঁর না থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারতের ব্যাটিং অর্ডারে যে বাড়তি চাপ তৈরি করবে, সেটা বোঝাই যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার পেস আক্রমণ বিশ্বের অন্যতম সেরা, বিশেষ করে নতুন বলে সুইং ও বাউন্স তুলতে তারা পারদর্শী। শুভমান এমন এক ব্যাটসম্যান, যিনি নতুন বল খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন। তাঁর ফুটওয়ার্ক, বলের লেংথ দ্রুত ধরতে পারা, এবং অফ–স্টাম্পের বাইরে বল ছেড়ে দেওয়ার কৌশল তাঁকে ওপেনিং–এ খুব কার্যকর করে তোলে। তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে রোহিত শর্মার ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব এসে পড়বে। নতুন ওপেনারের সঙ্গে তাঁকে নতুন করে ছন্দ খুঁজে নিতে হবে, যা টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ইনিংসে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও, শুভমানের অনুপস্থিতিতে ভারতের মিডল অর্ডারকেও আরও দায়িত্ব নিতে হবে। বিরাট কোহলি ও কে এল রাহুলকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হতে পারে। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা প্রথমেই আক্রমণ শানাতে চাইবে এবং যদি দ্রুত কয়েকটি উইকেট পড়ে যায়, তাহলে ম্যাচের মোড় ঘুরে যেতে পারে। শুভমান থাকলে সেই প্রথম ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা দলের ছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই নিশ্চয়তা কিছুটা কমে গেছে বলেই বিশেষজ্ঞদের মত।
তবে ক্রিকেট এমনই—এখানে সুযোগ আসে, আবার নতুন নায়কের জন্মও হয়। শুভমানের চোটে দলে নতুন কারও অন্তর্ভুক্তি মানে সেই খেলোয়াড়ের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার একটি সোনালি সুযোগ। ভারতীয় বেঞ্চ স্ট্রেংথ গত কয়েক বছরে খুব শক্তিশালী হয়েছে। বহু তরুণ ব্যাটসম্যান ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ ফর্মে রয়েছেন। তাঁরা এই সুযোগ পেলে হয়তো নতুন আলো ছড়াতে পারেন। শুভমান নিজেও জানেন, ভারতীয় দলে টিকে থাকতে হলে সর্বদা সেরাটা দিতে হয়। তাই তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
শুভমান গিলের ক্রিকেট–জীবন এখনো অনেক লম্বা। চোট তাঁর এই পথচলার একটি সামান্য বাঁক মাত্র। তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে যতটা পরিণত ব্যাটিং দেখিয়েছেন, তাতে সবাই নিশ্চিত—চোট সারলেই তিনি আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় এখন গোটা ভারতীয় ক্রিকেটমহল, আর ইডেনের দর্শকরাও ভবিষ্যতের কোনও সন্ধ্যায় তাঁকে আবার ব্যাট হাতে দেখা যাবে—এমন আশা মনেপ্রাণে লালন করছে।