ভারতীয় শেয়ারবাজার মঙ্গলবারের ট্রেডিং সেশনে স্পষ্টভাবে চাপের মুখে পড়ে। টানা কয়েকদিনের র‍্যালির পর Sensex ও Nifty উভয় সূচকই দিনের শেষে নিম্নমুখী হয়ে বন্ধ হয়। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই পতনের প্রধান কারণ দুটি বিনিয়োগকারীদের প্রফিট-বুকিং এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের FII সেল-অফ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে FII–দের বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে অতিরিক্ত দুর্বলতার সৃষ্টি হয়েছে। তার উপরে, মার্কিন সুদহার নিয়ে অনিশ্চয়তা, ডলার ইনডেক্স শক্তিশালী হওয়া এবং রূপির দুর্বলতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্ক করে তুলেছে।
২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় শেয়ারবাজার এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। মঙ্গলবারের ট্রেডিং শেষে পরিষ্কার হয়েছে যে গত কয়েকদিনের দ্রুত র্যালি বা লাভবান ওঠানের পর বাজার একটি স্বাভাবিক কারেকশন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। Business News This Week-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বাজারে প্রধান চাপ এসেছে দুটি উৎস থেকে—একটি হলো বহুল-প্রত্যাশিত প্রফিট-বুকিং, আরেকটি হলো FII (Foreign Institutional Investors) বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক বিক্রি। এই দুটি শক্তির সম্মিলিত প্রভাবে Sensex, Nifty এবং অন্যান্য ব্রডার ইনডেক্সগুলো দিনের শেষে উল্লেখযোগ্যভাবে নিচে নেমে আসে।
এই দীর্ঘ বিশ্লেষণে শেয়ারবাজারের পতনের মূল কারণ, ভারতীয় অর্থনীতি, বৈদেশিক বাজারের প্রভাব, সেক্টর-ওয়াইজ পরিস্থিতি, বিনিয়োগকারীদের মনোভাব, ভবিষ্যতের বাজার-চিত্র, এবং অর্থনীতির সামগ্রিক দিক নিয়ে ৪০০০ শব্দের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
ব্যাংকিং সেক্টর দিনের সবচেয়ে বড় দুর্বল লিংক হিসেবে উঠে আসে। Bank Nifty উল্লেখযোগ্যভাবে নিচে নামে, কারণ সাম্প্রতিক র্যালির পর এখানেই সবচেয়ে বেশি প্রফিট-বুকিং দেখা গেছে। পাশাপাশি PSU স্টকগুলো—যেগুলো গত কয়েক সপ্তাহে শক্তিশালীভাবে উঠেছিল—লাভ তুলে নেওয়ার চাপে উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে আসে। মধ্যম ও ক্ষুদ্র–মূলধনী স্টকগুলোতে পতন ছিল সর্বাধিক, কারণ এই দুটি সেগমেন্টেই ভ্যালুয়েশন অত্যন্ত উঁচুতে পৌঁছে গিয়েছিল।
অটো, IT ও FMCG সেক্টরেও চাপ থাকলেও, FMCG কিছুটা প্রতিরোধ দেখিয়েছে। IT সেক্টরে মার্কিন বাজার সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা নিয়ে সেন্টিমেন্ট দুর্বল ছিল। অটো সেক্টরে ফেস্টিভ সিজন পরবর্তী সেলস-স্লোডাউন প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পতন বাজারের দীর্ঘমেয়াদি ট্রেন্ড বদলে দেবে না। এটি একটি “healthy correction”, অর্থাৎ র্যালির পর স্বাভাবিকভাবে যে ধরনের লাভ তুলে নেওয়া হয়, সেটিই হচ্ছে। ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতি এখনও শক্তিশালী—GDP গ্রোথ, কর সংগ্রহ, ব্যাংকিং স্থিতিশীলতা এবং কর্পোরেট আয়ের দিক থেকে দেশ ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে।
তবে স্বল্পমেয়াদে FII–দের ধারাবাহিক বিক্রি, গ্লোবাল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং রূপির ওপর চাপ বাজারকে আরও কয়েকদিন অস্থির রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—আতঙ্কে বিক্রি নয়, বরং মানসম্মত স্টকের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে সুযোগ খোঁজা।
সার্বিকভাবে, মঙ্গলবারের পতন বাজারের স্বল্পমেয়াদি দুর্বলতা নির্দেশ করলেও, ভারতের দীর্ঘমেয়াদি বাজারচিত্র এখনও শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক।
মঙ্গলবার সকালে শেয়ারবাজার শুরু হয়েছিল মিশ্র সেন্টিমেন্ট দিয়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেমন কোনো বড় পজিটিভ বা নেগেটিভ সংবাদ ছিল না। কিন্তু বাজার খোলার কিছু মিনিটের মধ্যেই ট্রেডিং বোর্ডে ক্রমে দেখা যায় দুর্বলতা। ধীরে ধীরে কয়েকটি বড়-ক্যাপ স্টকে সেল-অফ শুরু হয়, যা অল্প সময়েই অন্যান্য স্টকেও ছড়িয়ে পড়ে।
কয়েকদিন ধরে Sensex এবং Nifty–র ধারাবাহিক লাভের পর অনেক বিনিয়োগকারী তাদের অর্জিত মুনাফা তুলে নিতে শুরু করেন। প্রফিট-বুকিং এমন এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা র্যালির পর প্রায়ই দেখা যায়। বিশেষ করে রিটেল বিনিয়োগকারী, HNI (High Net Worth Individuals) এবং কিছু PMS (Portfolio Management Services) প্রতিষ্ঠান মুনাফা সুরক্ষিত করতে বিক্রি করে।
কিন্তু দিনের প্রধান ঘটনাটি হলো FII-দের আগ্রাসী বিক্রি।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন—ভারতে FII-দের বিক্রি নতুন নয়, তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের সেলিং চাপে বাজার বারবার নিচের দিকে চাপ পেয়েছে। তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো:
ডলার শক্তিশালী হলে বিদেশি ফান্ডগুলি উদীয়মান বাজার (emerging market) থেকে অর্থ তুলে নিয়ে নিরাপদ বাজারে (safe haven) পার্ক করতে চায়। ভারত, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুরের মতো বাজার এতে প্রভাবিত হয়।
Federal Reserve–এর ভবিষ্যৎ সুদহার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সুদহার বাড়লে FII–রা ভারতীয় বাজার থেকে ফান্ড তুলে নেয়, কারণ তখন মার্কিন বন্ডে লভ্যাংশ বাড়ে।
রূপি যখন ডলারের তুলনায় দুর্বল হয়, তখন FIIs-দের লাভ কমে যায়। কারণ তারা ডলারে বিনিয়োগ করে, আর দুর্বল রূপিতে রিটার্ন ফিরে পায়। ফল—বিশেষ করে শর্ট-টার্ম হোল্ডিংগুলিতে তারা বিক্রি করে দেয়।
মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন নির্বাচন, ইউরোপের জ্বালানি বিরোধ—সবকিছুই বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।
এই সব কারণ মিলেই ভারতীয় বাজারে FII বিক্রি কিছুটা আগ্রাসী হয়েছে।
একথা সত্যি যে শেয়ারবাজার গত কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে লাভে ছিল। ব্যাংকিং, PSU, অটো, রিয়েলটি এবং ক্যাপিটাল গুডস—সব সেক্টরেই উল্লেখযোগ্যভাবে র্যালি দেখা গেছে।
এই সময় হঠাৎই বাজারে সেল-অফ শুরু হলে বিশ্লেষকরা মনে করেন—
এটি “Healthy Correction”.
কিন্তু তা কি সত্যিই তাই?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—হ্যাঁ, এটি আপাতদৃষ্টিতে একটি স্বাস্থ্যকর কারেকশন হলেও, FII–দের ধারাবাহিক বিক্রি বাজারে মাঝারি মেয়াদে চাপ তৈরি করতে পারে। বাজার যে পর্যায়ে উঠে এসেছিল—সেখানে সামান্য সংবাদও তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে।
Bank Nifty ছিল দিনের “biggest dragger”।
কারণ:
ব্যাংক শেয়ারের দাম অনেকটাই বাড়ছিল
এখন প্রফিট-বুকিং হয়েছে
রূপি দুর্বল হওয়ায় বিদেশি বিক্রি বেড়েছে
ক্রেডিট গ্রোথ সামান্য ধীর হয়েছে
ভারতের বিদেশি রিজার্ভ ও বন্ড মার্কেটেও সামান্য চাপ দেখা গেছে, যা ব্যাংকিং সেক্টরকে আরও দুর্বল করেছে।
গত কয়েক সপ্তাহে PSU স্টক (Power Grid, ONGC, Coal India, SBI, BHEL)–এ বিনিয়োগকারীদের প্রবল আগ্রহ ছিল। সরকারের রিফর্ম, ডিভিডেন্ড ইয়িল্ড এবং শক্তিশালী কমোডিটি দামের কারণে এই স্টকগুলো র্যালি করছিল।
কিন্তু বাজারের সামান্য দুর্বলতা দেখা যেতেই ট্রেডাররা এখানে লাভ তুলে নিয়েছে। কারণ PSU স্টকগুলিতে মুনাফা দ্রুত বুক করা হয়।
অটো:
ফেস্টিভ সিজন শেষে সেলস কিছুটা কমেছে
র্যালির পর সেল-অফ
IT:
মার্কিন বাজার স্থিতিশীল
তবে ডলার-রূপি ওঠানামায় চাপ
Accenture–এর সাম্প্রতিক আউটলুক মিশ্র
FMCG:
প্রতিরক্ষামূলক স্টক হওয়ায় পতন তুলনামূলক কম
গ্রামীন চাহিদা পুনরুদ্ধারের অপেক্ষা
বড় ক্যাপ স্টকে মাঝারি পতন হলেও মিডক্যাপ ও স্মলক্যাপে সেলিং চাপ বেশি ছিল। এর কারণ:
এই সেগমেন্টে ভ্যালুয়েশন খুব বেশি ছিল
Mutual Fund-রাও কিছুটা সতর্ক করেছে
রিটেল ট্রেডারদের মধ্যে panic selling
Midcap index 2–3% পর্যন্ত নিচে নেমে যায়
সংবাদ দেখে অনেকে ভাবেন—শেয়ারবাজার পড়ে মানেই অর্থনীতি খারাপ।
এটি ভুল ধারণা।
ভারতের GDP গ্রোথ এখনও শক্তিশালী।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত।
কর সংগ্রহ শক্তিশালী।
রিয়েল-ইস্টেট বাজারও ইতিবাচক।
ম্যানুফ্যাকচারিং PMI ভালো।
বাজার পতন সবসময় অর্থনীতির দুর্বলতা নির্দেশ করে না।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপ—সব জায়গাতেই সামান্য চাপ দেখা গেছে।
เหตุ:
মার্কিন ট্রেজারি ইল্ড বাড়া
চীনের অর্থনৈতিক সংকট
তেলের দাম অস্থির
আন্তর্জাতিক ফান্ডের রিস্ক-অফ সেন্টিমেন্ট
রিটেল বিনিয়োগকারী ভয় পেয়ে দ্রুত স্টক বিক্রি করতে শুরু করেন। যাকে বলে panic selling।
অন্যদিকে, অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা ধৈর্য ধরে বলেন—
“Every correction is an opportunity.”
বিশ্লেষকদের মতে:
বাজার বর্তমানে overbought
কিছুটা consolidation হবে
FII inflow না বাড়লে চাপ থাকবে
কিন্তু long-term bullish
সার্বিকভাবে বলতে গেলে:
প্রফিট-বুকিং স্বাভাবিক
FII selling নিয়ন্ত্রণে
long-term strong
panic selling অপ্রয়োজনীয়
ভারতীয় শেয়ারবাজার শক্তিশালী অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই স্বল্পমেয়াদি পতন হলেও ভবিষ্যৎ ইতিবাচক।