উত্তরাখণ্ডে ডিজিটাল অ্যারেস্ট নামে সাইবার প্রতারণা ফাঁস হয়েছে, যেখানে কিরণ কুমারের নেতৃত্বে একটি গ্যাং ভিকটিমদের ভিডিও কল ও ভয় দেখিয়ে ৮৭ লাখ টাকা হাতিয়েছে। প্রতারকরা ভিকটিমদের ভার্চুয়ালি আটক রাখত, পুলিশ বা সিবিআই এজেন্ট ভান করে মানি লন্ডারিং বা অপরাধের হুমকি দিত। এসটিএফ অভিযান প্রতারণার সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়।
উত্তরাখণ্ডে একটি বিপজ্জনক সাইবার প্রতারণার ঘটনা সামনে এসেছে, যা ডিজিটাল অ্যারেস্ট নামে পরিচিত। এটি এমন একটি স্ক্যাম, যেখানে প্রতারকরা ভিকটিমদের ভিডিও কল বা ভয় ভীতি দেখিয়ে প্রলোভিত করে। উত্তরাখণ্ডের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) এই স্ক্যামের জাল ভেঙে দিয়েছে, এবং তাদের অভিযান একটি বড় মাপের প্রতারণা ফাঁস করেছে প্রায় ৮৭ লাখ টাকা (প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন) এমন একটি প্রতারণা যা বেশ কয়েকটি জেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। এই প্রতারণার কেন্দ্রে ছিল কিরণ কুমার নামের একজন ব্যক্তি। এসটিএফএর গোয়েন্দা তদন্তে জানা গেছে, কিরণ কুমার বেঙ্গালুরু (ইয়েলাহাঙ্কা) থেকে কাজ করছিল এবং তার সঙ্গে একটি সাইবার গ্যাং যুক্ত ছিল, যারা বিভিন্ন গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করছিল। অভিযোগ অনুসারে, তারা এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল, যেখানে তারা ভুক্তভোগীদের ভয়ের মধ্যে রেখে ডিজিটালি আটকে রাখার হুমকি দিত, অর্থাৎ তারা ভয় দেখাত যে ভিকটিমরা পুলিশের বা সিবিআই এর তদন্তের কবলে পড়বেন, এবং তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং বা ড্রাগস সংক্রান্ত অভিযোগ করা হবে যদি তারা সহযোগিতা না করে অর্থাৎ অর্থ না পাঠায়। এসটিএফ এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতারকরা তাদের শিকারদের ৪৮ ঘণ্টা বা তার কাছাকাছি সময় "ডিজিটাল অ্যারেস্টে" রাখত এবং WhatsApp ভিডিও কল এবং ভয় ভীতির মাধ্যমে তারা নিজেদের পুলিশ অফিসার বা সিবিআই এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিত। এই ভয় ভীতি এবং মানসিক চাপে ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে তাদের এসটিএফ এর তদন্তের সময় তারা একটি বড় ব্যাংক লেনদেনের কাঠামো উন্মোচন করে। তারা দেখেছে যে প্রতারকরা একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছিল, ইয়েস ব্যাংক এর একটি অ্যাকাউন্ট যার নাম রাজেশ্বরী জিএকে এন্টারপ্রাইজ নামে নিবন্ধিত ছিল। ওই অ্যাকাউন্টে প্রায় ৪১ লাখ টাকা প্রতারিত অর্থ পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পারে। প্রমাণ হিসেবে, যখন কিরণ কুমারকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, সিম কার্ড, ল্যাপটপ এবং ব্যাংক সংক্রান্ত নথিপত্র সহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। এসটিএফএর সিনিয়র পুলিশ সুপার (এসএসপি) নবনীত সিংহ এই অভিযানের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, এই প্রতারণা শুধুমাত্র এক বা দুই ভুক্তভোগীর সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং দেশব্যাপী একটি সাইবার প্রতারণা সিন্ডিকেট ছিল, যার বিরুদ্ধে প্রায় ২৪টি মামলা হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে। এছাড়া তারা আরও তদন্তে পায় যে, প্রতারিত অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একটিতে প্রায় সাত থেকে নয় কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন রয়েছে, যা স্ক্যামের জটিলতা ও আকারকে নির্দেশ করে। গ্রেফতারের সময় পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, এই প্রতারকরা তাদের শিকারদের এমন মানসিক অবস্থায় রাখত যেন তারা প্রকৃতপক্ষে আটক একটি ধরনের ভার্চুয়াল আটকে রাখা। ভিডিও কল, ভয় ভীতি এবং অব্যাহত চাপ দিয়ে তারা ভুক্তভোগীদের কাছে অনুরোধ করত বা আদেশ করত টাকা স্থানান্তর করার জন্য। তাদের ভয় দেখানো হত যে যদি টাকা না দেওয়া হয়, তাহলে তারা আইনগতভাবে দায়ী হবেন, মিথ্যা মানি লন্ডারিং বা মাদক মামলায়। অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে প্রতারকদের নির্দেশিত অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিত। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নয়, অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ ছিল যে তারা প্রায় দুই দিনের জন্য অ্যারেস্টেড বা আটক বোধ করেছিল, যদিও তারা শারীরিকভাবে কোথাও আটক ছিল না, কিন্তু কার্যত তাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও যোগাযোগের মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। এই ঘটনা শুধু একটি সাধারণ প্রতারণা নয়, এটি আমাদের ডিজিটাল যুগে মানুষের দুর্বলতা, তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং সামাজিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে আসে। প্রতারকরা দেখেছে যে অনেক সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন আইন, পুলিশ, সিবিআই, যদি ভার্চুয়ালি উপস্থাপন করা যায়, তাহলে মানুষ খুব দ্রুত ভয় পায় এবং সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। তারা আইনগত কর্তৃত্বের ভান ব্যবহার করে সাইবার শিকার তৈরি করেছে এবং সেই ভান মানুষের জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এই স্ক্যামের প্রভাব শুধু আর্থিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও ভুক্তভোগীদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। প্রায় দুই দিন ধরে ডিজিটালি অ্যারেস্টেড থাকার ফলে তাদের মানসিক চাপ, উদ্বেগ, আতঙ্ক তীব্র হতে পারে। তারা ধারণা করতে পারে যে তারা অপরাধ করেছে, অথবা আইনের বিষয়ে তাদের ওপর ভয়ানক পরিণতি আসতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সঞ্চয়, জীবিকার সহায়তা সব ঝুঁকির মুখে পড়ে। এসটিএফ এর এই গ্রেফতার এবং নেটওয়ার্ক ভাঙার অভিযান শুধু একটি অপরাধচক্র দমন কর্মসূচি ছিল না, বরং একটি প্রমাণ যে ভার্চুয়াল ভয় এবং নিয়ন্ত্রণের কাঠামো তৈরি করা যায় প্রতারণার মাধ্যমে। এটি দেখিয়ে দেয় যে আধুনিক সাইবার অপরাধীরা শুধু টাকা আত্মসাৎ করতে চায় না, তারা মানুষের বিশ্বাস এবং ভয়কে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে ডিজিটাল যোগাযোগের ঝুঁকিগুলোর প্রতি। প্রতিটি ব্যক্তির উচিত সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা যখন কেউ বলে তারা আইন বা পুলিশের প্রতিনিধি, বিশেষ করে তখনই যখন তারা ভিডিও কল করে এবং দাবি করে আপনি নিয়মবিরোধী বা অপরাধমূলক কাজ করেছেন। তখন সেই আতঙ্ক বা দৃশ্য যতই বাস্তব মনে হোক না কেন, সেই মুহূর্তে গুরুত্বসহকারে যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। ব্যাংক লেনদেন করার আগে, কোনও নির্দেশকারী ব্যক্তি যদি দাবি করে আপনি ঝুঁকিতে আছেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে সাইবার সেল, স্থানীয় পুলিশ বা বিশ্বস্ত কাউকে জানানো উচিত, কিন্তু তড়িঘড়ি করে টাকা পাঠানো যাবে না। এসটিএফ এর এই মামলাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে প্রতারণার ধরনগুলি বদলে গেছে। আগে শুধুমাত্র কল বা ব্যাংকের নাম করে প্রতারণাপূর্ণ মেসেজ ছিল, এখন ভিডিও কল, ভয়, ভান এবং ভার্চুয়াল ক্ষমতার ব্যবহার যুক্ত হয়েছে। প্রতারকরা আইন এবং দুর্নীতি সম্পর্কে গভীরভাবে ধারণা রাখে এবং সেই জ্ঞানকে জনগণের মাঝে দুশ্চিন্তা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য কাজে লাগায়। এই ঘটনার পর, এসটিএফ এবং অন্যান্য আইন সুরক্ষা সংস্থা একই সঙ্গে একটি বড় অগ্রাধিকার পায়, ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানো। সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন যে, শুধুমাত্র কল বা মেসেজ যাই বলুক না কেন, কখনোই প্যানিক মোডে কাজ করা উচিত নয়, অবিলম্বে সহায়তা চাওয়া উচিত। এছাড়া, ভুক্তভোগীদের জন্য একটি স্পষ্ট পথও থাকা উচিত যে যদি তারা এমন হুমকি বা ভয় দেখানো যোগাযোগ পান, তারা কীভাবে রিপোর্ট করবে, কার কাছে যাবে এবং কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে প্রতারণাকারীরা তাদের ভয়ের অস্ত্র হিসেবে সেই "ডিজিটাল অ্যারেস্ট" ধারণাকে আর ব্যবহার করতে না পারে। এই ধরনের সাইবার অপরাধ সম্প্রতি শুধু উত্তরাখণ্ডেই সীমাবদ্ধ নেই, সারা দেশে এমন ঘটনা বেড়েই চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লি পুলিশও একটি সর্বভারতীয় সাইবার প্রতারণা সিন্ডিকেট ফাঁস করেছে, যা ডিজিটাল অ্যারেস্ট এবং ইনভেস্টমেন্ট ফ্রড উভয় পন্থা ব্যবহার করছে এবং কোটি কোটি টাকা লেনদেন করছে। এসব ঘটনা আমাদের সামনে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে প্রতারণাকারীরা দেশব্যাপী সংগঠিত হচ্ছে এবং তাদের কাজের ধরন আরও জটিল ও পরিকল্পিত। আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর জন্য এটি একটি বড় সতর্কবার্তা যে প্রতারণাকারীরা শুধুমাত্র স্থানীয় কল সেন্টার বা এক দুটি শহরেই সক্রিয় নয়, তারা আন্তঃরাজ্য এবং ভার্চুয়াল মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ডিজিটাল গোয়েন্দা ক্ষমতা (ডিজিটাল ফরেনসিক) বাড়ানো এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা অত্যাবশ্যক। সাধারণ নাগরিকদের অবস্থান শক্তিশালী করার গুরুত্বও রয়েছে। ডিজিটাল লিটারেসি শুধু দক্ষতা নয়, এটি সুরক্ষা। প্রতিটি বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা এমন কেউ যিনি প্রযুক্তি উপযোগী নাও হতে পারেন, তাদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, সহজ শিক্ষাদান এবং সাইবার সেল যোগাযোগের পদ্ধতি তাদের প্রথম প্রতিরক্ষা হয়ে উঠতে পারে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বও বাড়ছে এই ধরনের প্রতারণা রোধে। ব্যাংকগুলোকে শুধুমাত্র লেনদেনের ব্যাক এন্ড মনিটরিং করার বদলে প্রাক সতর্কতা ব্যবস্থা ও সন্দেহ স্কোরিং পরিকল্পনা উন্নত করতে হবে। যদি একটি লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পর একজন গ্রাহক দাবি করে যে তাকে লেনদেন করার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, তাহলে ব্যাংকের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও নতুন সমাধান খুঁজতে হবে এই ধরনের প্রতারণা রোধে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে সন্দেহজনক কল এবং মেসেজ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। টেলিকম কোম্পানিগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সন্দেহজনক নম্বর ব্লক করার জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম চালু করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে শিক্ষা এবং সচেতনতা কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।