Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

একঘেয়েমি ভুলে এবার শীতে বানান টাটকা ফুলকপির নিরামিষ রেজ়ালা স্বাদে রেস্তোরাঁ ঘরেই উৎসব

শীতের বাজারে টাটকা ফুলকপির রমরমা ভাজা বা আলু-ফুলকপির ঝোল ছাড়াও এই সব্জি দিয়ে তৈরি করা যায় এক রাজকীয় ও ক্রিমি পদ ফুলকপির রেজ়ালা পোস্ত কাজু, দুধ আর মশলার মোলায়েম মিশ্রণে এই নিরামিষ রেজ়ালা হয়ে ওঠে জিভে জল আনা খাবার, যা পরোটা বা পোলাওয়ের সঙ্গে জমে দারুণ

শীতের বাজারের রঙ আর ঘ্রাণ যেন বাংলার রান্নাঘরে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে বাজারে সাজানো থাকে বিভিন্ন রঙের সব্জি—গাজর, ব্রোকোলি, বাঁধাকপি, বিট, সিম, পালং-শ্যাক… আর তার মধ্যমণি হয়ে ওঠে টাটকা ফুলকপি। শীতকাল মানেই যে কোনও বাঙালি বাড়িতে ফুলকপির উপস্থিতি অবধারিত। কখনও আলু-ফুলকপির ডালনা, কখনও ভাজা, কখনও আবার ভেটকি মাছের সঙ্গে ঝোল—এসব আমাদের রোজকার পরিচিত স্বাদ।

তবে শীতের এই প্রাচুর্যের মধ্যেও মাঝে-মধ্যে মন চায় কিছু আলাদা, কিছু অনন্য স্বাদের রান্না। ঠিক সেই মুহূর্তে ফুলকপির রেজ়ালা হয়ে ওঠে নিখুঁত একটি নির্বাচন—যেখানে ঘরোয়া উপকরণ ও মুঘলাই স্বাদের মিলনে তৈরি হয় এক রাজকীয় নিরামিষ পদ। আমিষ কিংবা নিরামিষ—রেজ়ালার দু’টি সংস্করণই দারুণ জনপ্রিয়, কিন্তু পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া তৈরি এই বিশেষ নিরামিষ রেজ়ালার স্বাদ একবার মুখে দিলে ভুলতে পারবেন না।

এই রেজ়ালার প্রধান আকর্ষণ তার মোলায়েম, সাদা-ক্রিমি বেস। দুধে ভিজিয়ে রাখা পোস্ত, কাজু, কিশমিশ ও চারমগজ—এই চারটি উপকরণের মিশ্রণে তৈরি হয় এক অবিশ্বাস্য নরম ও রিচ পেস্ট, যা রেজ়ালার আত্মা। এই ঘন বেস ফুলকপির সঙ্গে মিশে তৈরি করে সমৃদ্ধ, মোলায়েম এবং মিষ্টি–নোনতা স্বাদের অপূর্ব ভারসাম্য।

রান্নার শুরুতে ফুলকপিকে গরম জলে ডুবিয়ে রাখা হয়, যাতে তার প্রতিটি অংশ পরিষ্কার থাকে এবং ভাজার সময় সুন্দর রং আসে। এরপর ফুলকপির টুকরোগুলোকে হালকা ভেজে তৈরি করা হয় সোনালি, হালকা কুঁচকানো টেক্সচার—যা পরে রেজ়ালায় দারুণ ভাবে মিশে যায়।

ফোড়ন দেওয়ার সময় শুকনো লঙ্কা ও থেঁতো গোলমরিচের ঘ্রাণ প্রথমেই বুঝিয়ে দেয় যে রান্নাটি একটি স্পেশাল কিছু হতে চলেছে। এরপর কম আঁচে বাদামের পেস্ট দিয়ে ধীরে ধীরে রান্না করতে হয় যতক্ষণ না তেল আলাদা হয়ে আসে—এটাই রেজ়ালার স্বাদ আনার আসল কৌশল। এর পর যোগ হয় ভাজা ফুলকপি, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, নুন ও ধনেগুঁড়ো। লঙ্কার গুঁড়ো যদি কম দেওয়া হয়, গ্রেভি থাকবে একেবারে সাদা; আর বেশি দিলে রং হবে হালকা লালচে।

এখানে একটি বিশেষ সতর্কতা—এই রেসিপিতে হলুদ ব্যবহার করা চলবে না, কারণ রেজ়ালার মৌলিক রং সাদা বা হালকা অফ-হোয়াইট। তেমনই, রেসিপিতে সরষের তেলও দেওয়া যাবে না, কারণ এর শক্ত ঝাঁজ রেজ়ালার নরম সুবাসকে ঢেকে দেয়।

এই পর্যায়ে ফেটানো টকদই মেশালে গ্রেভিতে আসে টক-মিষ্টি ভারসাম্য, আর খোয়া ক্ষীর গ্রেভিকে করে আরও গভীর, রিচ ও মোলায়েম। ঢাকা দিয়ে ৫-৬ মিনিট রান্না করলে ফুলকপির মধ্যে গ্রেভি পুরোপুরি ঢুকে যায় এবং তেলের একটি হালকা স্তর ভেসে ওঠে—যা বাদামের উপস্থিতির কারণে আরও সুন্দর দেখায়।

শীতের সময় রান্নাঘরে এক আলাদা রকমের উষ্ণতা থাকে। সকালের হালকা সূর্যের আলো জানালার ফাঁক গলে এসে পড়ে রান্নার টেবিলে, আর পাত্রে সাজানো থাকে টাটকা সব্জির বাহারি রঙ। গাজরের কমলা, পালংয়ের সবুজ, বিটের গাঢ় রঙ, সিমের কচি মসৃণতা—এই সব কিছুর মাঝেই সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে সাদা মেঘের মতো ফুলকপি। শীতের ফুলকপি তার স্বাদ, সুবাস ও টেক্সচারের জন্য এমনই বিশেষ যে তাকে দিয়ে সাধারণ রান্না যতই করা হোক, নতুন এক রেসিপির সন্ধান করতে মন চায় মাঝেমধ্যেই।

এমন সময়েই সামনে আসে ফুলকপির রেজ়ালা—একটি নিরামিষ পদ, যা একই সঙ্গে মৃদু, মোলায়েম, সুগন্ধি এবং রাজকীয়। নাম শুনলেই মনে পড়ে মুঘলাই রান্নার ঐতিহ্য, যেখানে মশলার ঝাঁজ নয় বরং সুবাস, দুধের কোমলতা, বাদামের ঘনত্ব আর গোলাপজলের ফুলেল গন্ধ একত্র হয়ে তৈরি করে অপূর্ব এক স্বাদ।

রেজ়ালার শেষ পর্ব: সুগন্ধে ভরে ওঠে রান্নাঘর

ফুলকপির রেজ়ালার শেষ ধাপটি যেন রান্নার সোনায় সোহাগা। বাদাম-পোস্ত-দুধের বেসে ফুলকপি নরম হয়ে এলে অপেক্ষা থাকে চূড়ান্ত সুগন্ধ যোগ করার।

প্রথমেই মেশানো হয় গরমমশলার ঝাঁজ—যা পুরো গ্রেভির মধ্যে এনে দেয় উষ্ণতা এবং স্বাদের গভীরতা। গরমমশলার তীব্র কিন্তু মিষ্টি সুবাস রেজ়ালাকে আলাদা চরিত্র দেয়। এরপর যোগ হয় গোলাপজল—যার ফুলেল ঘ্রাণ যেন রেজ়ালাকে মুহূর্তেই রাজকীয় করে তোলে। ঠিক পরিমাণে ব্যবহার করা হলে গোলাপজলের গন্ধ কখনও বেশি আধিপত্য করে না, বরং পুরো গ্রেভির সঙ্গে এক নরম পরশের মতো মিশে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় খুব সামান্য কেওড়াজল, যা রন্ধনে এনে দেয় এক অচেনা কিন্তু মোহময় সুবাস।

এই তিনটি উপাদান—গরমমশলা, গোলাপজল, কেওড়াজল—একত্রে রেজ়ালায় তৈরি করে উৎসবের গন্ধ। রান্না শেষে কয়েক মিনিট ঢাকা দিয়ে রেখে দিলে এই সুগন্ধ ফুলকপির ভেতরে ভেতরে সেঁধিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে কড়াই খুললে যে গন্ধ বের হয়, তা ঘর ভরিয়ে তোলে এমনভাবে যে ক্ষুধা না থাকলেও খেতে ইচ্ছে করে যায়।

পরিবেশনে পূর্ণতা

ফুলকপির রেজ়ালার সৌন্দর্য শুধু তার স্বাদেই নয়, তার পরিবেশনেও।
এই রেসিপি এমন একটি বহুমুখী পদ, যা যেকোনো ব্রেড বা রাইস-ডিশের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায়।

সবকিছুর সঙ্গেই এই পদটি সমানভাবে উপভোগ্য। রেজ়ালার ঘন, সাদা-ক্রিমি গ্রেভি এবং নরম ফুলকপি প্রতিটি কামড়ে এক আলাদা মোলায়েম স্বাদ দেয়।

বড়দের যেমন এই পদটি পছন্দ হবে, তেমনই শিশুরাও খেতে ভালবাসবে কারণ এতে ঝাল কম, মশলার তীব্রতা নেই, এবং দুধ-বাদাম-দইয়ের ঘন স্বাদ মুখে এক নরম মিষ্টি আরাম দেয়। যারা নিরামিষ রান্না নিয়ে ভাবেন, তাদের জন্য এটি সত্যিই একটি দারুণ বিকল্প।

শীতের ফুলকপির সঙ্গে রেজ়ালার মেলবন্ধন

শীতের ফুলকপি আলাদা কারণ এতে প্রাকৃতিক মিষ্টি স্বাদ থাকে, যা রেজ়ালার ক্রিমি বেসের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায়। ফুলকপির টেক্সচারও হয় দৃঢ়—যা রান্নায় গলে যায় না, বরং গ্রেভিতে মিশে নরম, কোমল ও রসাল হয়ে ওঠে।

এ ছাড়া শীতের সময় দুধ, দই, বাদাম, ঘি—সবকিছুই সহজে হজম হয় এবং স্বাদেও থাকে উৎকৃষ্ট। ফলে শীতকালেই রেজ়ালা বানানোর পরামর্শ দেন বেশিরভাগ রন্ধনশিল্পী।

অতিথি আপ্যায়নে উপযুক্ত

ফুলকপির রেজ়ালা এমন একটি পদ, যা দেখতে যেমন সুন্দর, স্বাদেও তেমনি অনন্য। তাই অতিথি এলে, পরিবারে কোনো বিশেষ দিন হলে বা একটু ভিন্ন কিছু রান্না করতে চাইলে এই রেসিপিটি সহজেই বেছে নিতে পারেন।

এত কম মশলা, এত কম ঝাল-তেল ব্যবহার করেও যে একটি পদ এত রিচ হতে পারে—তা এই রেজ়ালার মাধ্যমেই বোঝা যায়।একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করবে

শীতের টাটকা ফুলকপি দিয়ে তৈরি এই রেসিপিটি শুধু নতুন স্বাদের সন্ধানই নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা।
চোখে লাগে রঙের স্নিগ্ধতা, নাকে লাগে গোলাপ-কেওড়ার মিষ্টি গন্ধ, আর মুখে দিলে মেলে দুধ-বাদামের মোলায়েম স্বাদের বিস্তার।

ঘরোয়া রান্নায় প্রতিদিন নানান সব্জি ব্যবহার করা হয়, কিন্তু কিছু কিছু রেসিপি আছে যা ঠিক প্রতিদিনের নয়—একটু বিশেষ, একটু ব্যতিক্রমী। ফুলকপির রেজ়ালা ঠিক সেই ধরনের একটি পদ। সাধারণ ফুলকপি দিয়ে তৈরি হলেও এটি একেবারে রেস্তোরাঁ-স্টাইলের সমৃদ্ধ স্বাদ এনে দেয়, যা খেতে যেমন অসাধারণ, দেখতে তেমনি আকর্ষণীয়।

শীতের সময়ে পাওয়া টাটকা ফুলকপির স্বাদই এই রেসিপিকে আরও উন্নত করে। ফুলকপির নরম-মোলায়েম টেক্সচার, দুধ-বাদামের ক্রিমি বেস এবং গোলাপজল-কেওড়ার রাজকীয় সুবাস মিলে তৈরি হয় এক দারুণ রন্ধন-অভিজ্ঞতা। রান্না করতে খুব বেশি পরিশ্রম লাগে না, আবার উপকরণও সকলের রান্নাঘরেই থাকে—কিন্তু তবুও এই রেজ়ালা এমন স্বাদ দেয় যা সাধারণ দিনের খাবারকেও উৎসবে পরিণত করতে পারে।

এই রেসিপির সৌন্দর্য রয়েছে তার সরলতায়। এখানে ঝাল, মশলা বা তেলের বাড়াবাড়ি নেই। পোস্ত, কাজুবাদাম, চারমগজ আর দুধের মোলায়েম বেস ফুলকপির সঙ্গে মিশে তৈরি করে নরম, সাদা, সুগন্ধি একটি গ্রেভি। তার সঙ্গে সামান্য কাশ্মীরি লঙ্কা রঙে জৌলুস আনে, আর খোয়া ক্ষীর গ্রেভিকে করে আরও সমৃদ্ধ। শেষে গরমমশলা, গোলাপজল এবং কেওড়াজল যোগ হলে রান্নার গন্ধ যেন ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

ফুলকপির রেজ়ালার অন্যতম বিশেষত্ব হল—এটি কোনওভাবেই ঝোল ঝোল হয় না। মাঝারি ঘন, ক্রিমি, রেস্তোরাঁর মতো টেক্সচারই এই পদের আসল পরিচয়। দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমনি অতি সুস্বাদু। লুচি, পরোটা, রুটি কিংবা পোলাও—সব ধরনের খাবারের সঙ্গে এটি দারুণ মানিয়ে যায়।

এমন রেসিপি ঘরে সহজে তৈরি হয় না বলেই এটিকে ‘বিশেষ’ বলা চলে। একবার চেখে দেখলে বুঝবেন—সাদা, মোলায়েম, সুগন্ধি এই রেজ়ালা বাংলার ঘরোয়া রান্নায় একেবারে বিরল।

যদি এখনও না বানিয়ে দেখেন, এই শীতেই একবার রান্না করে ফেলতে পারেন।
রান্নার উপকরণ সাধারণ, পদ্ধতি সহজ—কিন্তু স্বাদ এমন যে নিশ্চয়ই বারবার বানাতে ইচ্ছে করবে

Preview image