মেট্রোর ভিতর হঠাৎ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন যাত্রীদের ভিড়ের মাঝে আচমকা বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। চলন্ত বগিতে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা হতবাক হয়ে ঘটনাটি লক্ষ্য করেন। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যটি ভিডিওতে ধরা পড়ে এবং দ্রুত ভাইরাল হতে শুরু করে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে প্রশ্ন ও উদ্বেগ বাড়ছে।
কলকাতা—এক ব্যস্ত মহানগর। প্রতিদিন লাখো মানুষের যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হলো মেট্রো। দ্রুতগামী, তুলনামূলক নিরাপদ এবং সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কারণে বহু যাত্রী প্রতিদিন অফিস, পড়াশোনা বা ব্যক্তিগত কাজের জন্য মেট্রো ব্যবহার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, যা মেট্রো যাত্রীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। চলন্ত মেট্রোর বগির ভিতরে এক ব্যক্তির আচরণকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এবং সেই ঘটনাই এখন শহরজুড়ে আলোচনার বিষয়।
এই ভিডিওতে দেখা যায়—একটি ভিড়াক্রান্ত মেট্রো বগির ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী হঠাৎই অস্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করছেন। তার উপস্থিতি এবং আচরণ চারপাশের মানুষকে উদ্বেগে ফেলেছে। কেউ পিছিয়ে যাচ্ছেন, কেউ মোবাইল বের করে ভিডিও তুলছেন, আবার কেউ ফিসফিস করে বলছেন—"কী হচ্ছে এটা?"
এই ঘটনা কোনো বড় গোলযোগে পরিণত না হলেও যাত্রীদের মনে ভয় এবং প্রশ্ন—মেট্রোর ভিতরের নিরাপত্তা কি যথেষ্ট?
এখন বিস্তারিত দেখা যাক কী হয়েছিল সেই বগির ভিতরে।
ঘটনাটি দুপুরের ব্যস্ত সময়ে। একটি সাধারণ দিনের মতোই লোকজনে ঠাসা বগিতে মানুষ দাঁড়িয়ে এবং বসে ছিলেন। কেউ মোবাইল স্ক্রল করছিলেন, কেউ খেয়াল করছিলেন কখন স্টেশন আসবে। সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল।
হঠাৎ দেখা যায়, মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে শরীর নড়াতে শুরু করেন। তার মুখভঙ্গি এবং হাত-পায়ের নাড়াচাড়া আচমকা বদলে যায়। এই আচরণ কাছের যাত্রীদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
একজন যাত্রী জানান—
“হঠাৎ লোকটা খুব অদ্ভুতভাবে নড়ছিল। বোঝা যাচ্ছিল না, ওর কী হচ্ছে। সবাই একটু দূরে সরে গেল।”
আরেকজন বলেন—
“আমরা ভেবেছিলাম হয়তো কেউ ঝগড়া শুরু করবে। ভিড়ের মধ্যে এমন আচরণ খুব ভয় লাগায়।”
এই আচরণের কারণে বগির পরিবেশ মুহূর্তে বদলে যায়। স্বাভাবিক যাত্রা এলোমেলো হয়ে ওঠে।
মেট্রোর মতো বদ্ধ পরিবেশে যাত্রীদের নিরাপত্তা নির্ভর করে একে অপরের উপর। অতিরিক্ত ভিড়ে যদি কোনো যাত্রী হঠাৎ অস্বাভাবিক আচরণ করেন, সেখানে আতঙ্ক ছড়ানো স্বাভাবিক।
যাত্রীদের ভয় পাওয়ার কারণগুলো ছিল—
এমন পরিস্থিতিতে সামান্য ঠেলাঠেলিতেও চোট লাগতে পারে।
তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো অস্থির বা মানসিকভাবে অসুস্থ।
আজকের দিনে যেকোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার আশঙ্কা থেকেই ভয় বেড়ে যায়।
বোমা, ছুরি বা অন্য বিপজ্জনক সামগ্রী বহনের সম্ভাবনাও মানুষকে আতঙ্কিত করে।
কেউ কেউ দ্রুত দূরে সরে যান, কেউ আবার পাশের কোণে দাঁড়ান।
এই মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়াই বগির ভিতর উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।
অনেকেই মনে করছেন—ভিডিওতে দেখা যাত্রীর আচরণটি “মেন্টাল ডিসট্রেস” বা মানসিক চাপ থেকে আসতে পারে। দিনের পর দিন কাজের চাপ, ব্যক্তিগত সমস্যা বা অসুস্থতা—সবকিছু মিলিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতেই পারে।
এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে তাকে সাহায্য করা উচিত ছিল বলেই মত দেন কিছু যাত্রী।
এক যাত্রী বলেন—
“অনেকে তাকে সমালোচনা করছেন, কিন্তু যদি তিনি অসুস্থ হন তাহলে আমাদের সাহায্য করা উচিত। ভয় না পেয়ে মানবিক আচরণ করা প্রয়োজন।”
ভিডিও সামনে আসতেই সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
কারও মতে—
“লোকটা স্পষ্টই মানসিক চাপে ভুগছিল। আমাদের আরও মানবিক হওয়া উচিত।”
আবার কেউ লিখেছেন—
“আজকাল এমন ঘটনা খুব হচ্ছে। মেট্রোর ভিতরে আরও নিরাপত্তা প্রয়োজন।”
অনেকে বলছেন—
“যদি লোকটার কাছে কোনো বিপজ্জনক জিনিস থাকত? বগিতে এত ভিড়! বড় দুর্ঘটনা হতে পারত।”
এদিকে কিছু নেটিজেন আহত মানুষটির প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে লিখেছেন—
“তিনি হয়তো অসুস্থ। সাহায্য করা উচিত ছিল।”
অন্যদিকে আবার কেউ মন্তব্য করছেন—
“এটা জনসমক্ষে বিরক্তি সৃষ্টি করার ঘটনা। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
অর্থাৎ প্রতিক্রিয়া দুই ভাগে বিভক্ত—
? নিরাপত্তাহীনতা
? মানবিকতা
মেট্রো রেলের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান—
“বগিতে CCTV রয়েছে। যাত্রীদের উচিত তৎক্ষণাৎ RPF-কে জানানো।”
RPF সূত্র অনুযায়ী—
প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে টহলদারি বাড়ানো হয়েছে
সন্দেহজনক আচরণ নজরে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড পরীক্ষা করা হবে
হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে
মেট্রো কর্তৃপক্ষ আরও জানায়—
“মানসিক সমস্যাগ্রস্ত যাত্রীদের ক্ষেত্রে মানবিক আচরণও প্রয়োজন।”
অর্থাৎ শুধু কঠোর ব্যবস্থা নয়, সহমর্মিতাও জরুরি।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে—
মানুষ শারীরিক বা মানসিক চাপের কারণে জনসমক্ষে আচমকা অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারেন। হতে পারে—
উদ্বেগজনিত সমস্যা
প্যানিক অ্যাটাক
মানসিক চাপ
অতিরিক্ত ক্লান্তি
মানসিক অসুস্থতা
বা অবচেতন আতঙ্ক
সেক্ষেত্রে তাকে ভয় না পেয়ে সাহায্য করা উচিত।
ট্রান্সপোর্ট সেফটি বিশেষজ্ঞদের মতে—
“অস্বাভাবিক আচরণ সবসময়ই বিপজ্জনক নয়, তবে মেট্রোর মতো পরিবেশে সতর্ক থাকা জরুরি।”
ঘটনার সময় বেশ কিছু যাত্রী তাঁদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন—
একজন যাত্রী বলেন—
“আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম হয়তো লোকটা অসুস্থ।”
আরেকজন বলেন—
“এ ধরনের ঘটনা হলে বগিতে RPF থাকা উচিত।”
এক মহিলা যাত্রী বলেন—
“মেয়েরা এমনিতেই ভিড়ে সমস্যায় পড়ে। এই ঘটনা ভয় বাড়িয়ে দেয়।”
একজন বৃদ্ধ বলেন—
“আমার মনে হল লোকটার মাথা ঘুরছিল। সাহায্য করা দরকার ছিল।”
অর্থাৎ ভয় ও মানবিকতার মাঝে যাত্রীরা বিভক্ত।
মেট্রো বগিতে প্রত্যেক কোণে নিরাপত্তাকর্মী রাখা সম্ভব নয়। ফলে—
CCTV নির্ভর নিরাপত্তা
প্ল্যাটফর্মে RPF
যাত্রীদের সচেতনতা
—এসবের ওপরই নির্ভর করতে হয়।
তবে এই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠছে—
? সন্দেহজনক আচরণ দেখলে RPF-কে জানানো
? যাত্রীদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা
? আতঙ্ক না ছড়িয়ে সহনশীল থাকা
? অসুস্থ মনে হলে সাহায্য করার চেষ্টা
? ভিডিও না তুলে প্রথমে কর্তৃপক্ষকে জানানোর অভ্যাস
? জরুরি নম্বর মনে রাখা
এমন ৬টি নিয়ম মেনে চললে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনায় দ্রুত সমাধান আসবে।
এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়া কোনো চমক সৃষ্টি বা ‘অনলাইন কনটেন্ট’ তৈরির বিষয় নয়—এটি শহরের জন্য একটি বার্তা। মানুষ প্রতিদিন মেট্রো ব্যবহার করেন সুরক্ষিতভাবে যাতায়াতের নিশ্চয়তায়। তাই যাত্রীদের আচরণ, মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থা—সবদিকেই বাড়তি নজর দেওয়া এখন অত্যন্ত প্রয়োজন।
আমাদের সমাজ আরও মানবিক হবে তখনই, যখন আমরা নিরাপত্তার পাশাপাশি সহমর্মিতাকেও সমান গুরুত্ব দেব। মেট্রোর মতো জনপরিবহনে প্রত্যেক যাত্রীই দায়িত্বশীল হলে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
এই ঘটনাটি না বড় কোনো বিপদ ডেকে এনেছে, না বড় সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। কিন্তু এটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—
মেট্রো রেল, প্রশাসন এবং যাত্রী—তিন পক্ষই সচেতন হলে শহরের পরিবহন ব্যবস্থা আরও নিরাপদ এবং মানবিক হবে।
সমাজ তখনই প্রগতির পথে এগোয়, যখন নিরাপত্তার পাশাপাশি সহমর্মিতাও সমানভাবে লালিত হয়।