আজও সলিল চৌধুরীর সুর এবং সৃষ্টি কতটা প্রাসঙ্গিক তা তুলে ধরেছেন তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে এক বাঙালি সুরকার।
সলিল চৌধুরী আজও কতটা প্রাসঙ্গিক প্রতিটি দশকেই এই প্রশ্নটি উঠে আসে। সলিল চৌধুরী এমন একজন সুরকার যিনি তাঁর সময়ের সীমানা অতিক্রম করে আজও মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে আছেন। তাঁর সৃষ্টি কখনওই পুরনো হয়ে যায়নি বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজ, ১৯ নভেম্বর সলিল চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা তাঁর অবদানকে স্মরণ করছি এবং বুঝতে পারছি, কেন তিনি আজও সবার কাছে এত প্রিয়। সলিল চৌধুরী কেবল একজন সুরকারই ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন শিল্পী একজন সমাজসেবক এবং একজন বিপ্লবী।
আমি প্রবাসী বাঙালি এবং সেই সময় বিদেশে বাংলা গান শোনার তেমন সুযোগ ছিল না। কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করার কারণে বাংলার ছেলেমেয়েদের মতো বাংলা গান শোনার সুযোগ পাইনি। তবে, একদিন ‘মধুমতী’ ছবির সলিল চৌধুরীর সুর করা গানটি শুনলাম এবং প্রথমবার অনুভব করলাম যে, সলিল চৌধুরীর সুর অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা। আমি তখন স্কুলে পড়ি এবং সুরের বিষয়ে তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না তবে বুঝতে পারছিলাম যে, সলিল চৌধুরীর সুরে কিছু একটা ছিল যা আমাকে আকর্ষণ করেছিল। তখন আমি জানতাম না পার্থক্যটা কোথায় কিন্তু অনুভব করেছিলাম যে, তাঁর সুরের মধ্যে একটা বিশেষ ব্যাপার ছিল যা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
৭০-এর দশকে যখন আমি একটু বড় হতে শুরু করি তখন নানা ধরনের গান শোনার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমি বিটলস, জোন বায়েজের মতো শিল্পীদের গান শোনার পাশাপাশি সলিল চৌধুরীর গানও শুনছিলাম। আমার কাছে তখন সলিল চৌধুরীর গান শোনা কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। কেউ আমাকে বলেনি যে, সলিল চৌধুরীর গান শুনতেই হবে, তবে সুরের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় অভ্যাস হয়ে উঠেছিল। তখন ইন্টারনেটও ছিল না, একমাত্র মাধ্যম ছিল রেকর্ড এবং রেডিয়ো। কিন্তু গান শোনার পরিসরটি অনেক বড় ছিল এবং বিথোভেন ও বিটলসের পাশাপাশি সলিল চৌধুরীও আমার প্রিয় সুরকার হয়ে উঠেছিলেন।
এইভাবে ধাপে ধাপে আমি সলিল চৌধুরীর সুরের বৈচিত্র আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। শিগগিরই বুঝতে পারলাম যে, সলিল চৌধুরী শুধু ছবির গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তাঁর সুরে ছিল নানা দিক, তাঁর গানগুলো ছিল শুধু সুরের অঙ্গীকার নয়, তার মধ্যে সমাজের নানা অবস্থা, প্রতিবাদ এবং ভাবনাও প্রতিফলিত হতো। বিশেষত তাঁর গণসঙ্গীত যেমন ‘ও আলোর পথযাত্রী’ আমাকে অবাক করেছিল। এই গানটি আমাকে সলিল চৌধুরীর সত্তাকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করেছিল। ৭০-এর দশকের শেষে এসে আমি বুঝতে পারলাম, শুধু সুর নয়, তাঁর গানের কথায় রয়েছে শক্তিশালী মতামত, প্রতিবাদ এবং সমাজের প্রতি এক সশক্ত বার্তা। সলিল চৌধুরীকে আবিষ্কার করার পদ্ধতি ছিল দীর্ঘ, এবং আমি ধাপে ধাপে তাঁকে চিনি।
বিশ্বের নানা শিল্পীদের গান আমি শুনতাম এবং তাঁদের থেকে অনুপ্রাণিত হতাম, তবে সলিল চৌধুরী কখনও ‘আউট অফ প্লেস’ ছিলেন না। আমি লক্ষ্য করলাম, সলিল চৌধুরী ও মাইকেল জ্যাকসন, বিলি জোয়েল ইত্যাদি শিল্পীদের গান যেন কোথাও একই সারিতে রয়েছে। মাইকেল জ্যাকসন তাঁর গানে বলেছিলেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড মেক ইট আ বেটার প্লেস’। অনেক বছর আগে সলিল চৌধুরী তাঁর গান ‘ও আলোর পথযাত্রী’-তে একই বার্তা দিয়ে গেছেন। এই মিলটি আমাকে অনেক গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ছাত্রজীবন শেষে সুরকার হওয়ার পথে যখন আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন সলিল চৌধুরীর সুর আবারও মনে পড়ল। যখন আমি শুভা মুদগলের গাওয়া ‘অব কে সওয়ান’ গানটি বেঁধেছিলাম, তখন ভাবছিলাম, সলিল চৌধুরী যদি এই গানটি করতেন তবে কীভাবে সুর করতেন। তখন অন্তরা চৌধুরী মুম্বাইয়ে থাকতেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং তাঁর থেকে জানলাম সলিল চৌধুরীর সুরকৌশল সম্পর্কে। সলিল চৌধুরী নিজে যা সৃষ্টি করেছেন, তা কখনও সহজ ছিল না, বরং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ছিল নানা চ্যালেঞ্জ এবং নতুনত্ব।
সলিল চৌধুরী সাধারণত সহজ সুর তৈরি করতে পছন্দ করতেন না। উদাহরণস্বরূপ, ‘না জিয়া লাগে না’ এবং ‘কহী বার য়ুঁ হী দেখা হ্যায়’-এর মতো গানের সুর সরল ছিল না, বরং সেগুলি ছিল সুরের জন্য চ্যালেঞ্জ। সলিল চৌধুরী নিজে চিন্তা করে বলতেন, সুর করতে হবে নিজের ভাবনা অনুসরণ করে, এবং এর জন্য ঝুঁকি নিতে হবে। সুরকার হিসেবে তাঁর যে নির্ভীকতা ছিল, তা আমার কাছে বিশেষ শিক্ষা ছিল। তাঁর কাছ থেকে আমি শিখেছি যে, সুরকার হতে হলে ভয় না পেয়ে নিজের সৃষ্টির প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।
সলিল চৌধুরীর সুরে ছিল এক ধরনের অভ্যন্তরীণ শক্তি যা তাকে এক অনন্য অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল। তাঁর গানগুলো কখনও কোনো পরিস্থিতিতে আপস করেনি, বরং সবসময় সৃজনশীলতার উচ্চতায় ছিল। তাঁর গানগুলির যে জোরালো সুর এবং কথার মধ্যে গভীরতা ছিল, তা অন্যান্য সুরকারদের থেকে তাঁকে আলাদা করে রেখেছিল। তাঁর জীবনের কাজের প্রতি যে দাপট এবং সাহস ছিল, তা সুরকারদের জন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
সলিল চৌধুরী শুধু একজন সুরকার ছিলেন না তিনি ছিলেন এক প্রতিভাবান শিল্পী যিনি তাঁর সুরের মাধ্যমে সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ প্রকাশ করেছেন। সলিল চৌধুরী তাঁর সুরে এমন এক শক্তিশালী ভাষা ব্যবহার করেছেন যা শুধুমাত্র সুর নয় বরং এক ধরনের সামাজিক বার্তা বহন করে। তাঁর গানগুলির মধ্যে কখনোই আপস ছিল না। তিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের প্রতি গভীর মনোযোগ এবং প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা তৈরি করেছিলেন। তাঁর গান ছিল ভালোবাসা স্বাধীনতা এবং মানুষত্বের প্রতীক যা মানুষের হৃদয়ে সরাসরি প্রভাব ফেলত। সলিল চৌধুরীর সুরের মধ্যে এক অদ্বিতীয় শক্তি ছিল যা কখনোই বাস্তবতার সীমায় আবদ্ধ হয়নি বরং তিনি নিজের চিন্তাভাবনা ও দর্শনকে সুরের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁর সুরে ছিল সমাজের অসঙ্গতিগুলির প্রতি প্রতিবাদ এবং মানুষের জীবনের সত্যিকার অর্থ খোঁজার চেষ্টা।
তিনি জানতেন যে সঙ্গীত শুধুমাত্র একটি শিল্প নয় বরং একটি শক্তিশালী মাধ্যম যা সমাজের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। সলিল চৌধুরী কখনোই সুরের ক্ষেত্রে কোনো ত্যাগ স্বীকার করেননি এবং তাঁর সুরের মধ্যে প্রতিটি নোটে ছিল একটি দৃষ্টি ছিল একটি প্রতিজ্ঞা যা তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। তাঁর সুরের মধ্যে প্রতিবাদ ছিল যতটা ছিল ভালোবাসা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সুরের মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলানো সম্ভব এবং তাই তিনি নিজের সৃষ্টির প্রতি কখনো আপস করেননি।
সলিল চৌধুরী সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষের অধিকার স্বাধীনতা ও মানবতার পক্ষে এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর গানগুলো ছিল এক ধরনের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে একদিকে ছিল প্রেম ও ভালোবাসার সুর অন্যদিকে ছিল প্রতিবাদ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী আওয়াজ। তাঁর সুর সেই সব মানুষের জন্য ছিল যারা নিজেরা নিজের অধিকার খুঁজে পেতে সংগ্রাম করছিলেন। সলিল চৌধুরী তাঁর সুরের মাধ্যমে এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে সবাই সমান অধিকার পাবে এবং মানবতা সবার জন্য উন্মুক্ত হবে।
অতএব সলিল চৌধুরী শুধুমাত্র সুরকার ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল বিপ্লবী যিনি তাঁর সুরের মাধ্যমে পৃথিবীকে দেখিয়েছেন একটি নতুন দৃষ্টিকোণ।
আজকের যুগে গানগুলো অনেক সময় লাইক এবং ভিউ এর সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় কিন্তু সলিল চৌধুরীর গান গুলি আজও সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর গান শুধু সংখ্যার সঙ্গে নয় বরং মানের সঙ্গে বিচার করা হয়। তাঁর সুরে যে গভীরতা ছিল তা আজও জীবিত এবং মানুষের অন্তরে অবস্থান করছে। সলিল চৌধুরীর গান শুধু তাঁর সময়ের জন্য ছিল না বরং আজকের যুগেও সেগুলি প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে। তিনি যা সৃষ্টি করেছিলেন তা সময়ের সীমানা পেরিয়ে আজও আমাদের কাছে পৌঁছায়। সলিল চৌধুরীর সুর শুধু গান নয়, এটি ছিল একটি বার্তা যা আজও সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে। তাঁর সুরের মধ্যে ছিল এক ধরনের মানবিক গুণাবলি, যা কেবল সুরকারদেরই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
আজ যখন আমরা সঙ্গীতের ব্যাপারে কথা বলি তখন সলিল চৌধুরীর সুরের মধ্যে যে অসীম শক্তি, মানবিকতা এবং প্রতিবাদ রয়েছে তা আমাদের মনে থাকে। তাঁর গানগুলি কোনো এক নির্দিষ্ট সময় বা সীমার মধ্যে আটকে থাকে না, বরং তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের জীবনে ছাপ ফেলে। সলিল চৌধুরী শুধু একটি সুরকার ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দৃষ্টান্ত, এক আদর্শ যিনি তাঁর সুরের মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার পথে আলোর আলো ফেলেছিলেন। তাঁর সৃষ্টির মাঝে যে গভীরতা, যে অনুভূতি এবং যে মানবিকতা ছিল তা কখনো হারাতে পারে না। সলিল চৌধুরী আমাদের জীবনে অমর হয়ে রয়েছেন এবং তাঁর সুর আজও আমাদের চিন্তা ভাবনায় স্থান করে নিয়েছে।
সলিল চৌধুরীর গান শুধুমাত্র সুরের সৌন্দর্যই নয়, তার মধ্যে ছিল এক সামাজিক দায়িত্ববোধ, যা তাঁকে শুধু ভারতীয় গানের জগতে নয়, আন্তর্জাতিক গানের অঙ্গনেও এক অনন্য স্থান দিয়েছে। তাঁর গানগুলি শুধু শোনা নয়, অনুভব করার বিষয়। সলিল চৌধুরী আজও আমাদের জন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন, তাঁর সুর আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলছে এবং আমাদের চিন্তা ভাবনা প্রভাবিত করছে।