Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

ডেটা এন্ট্রির দায়িত্ব না নেওয়ার দাবিতে বিডিও অফিস ঘেরাও করলেন BLO রা

SIR ফর্মের ডেটা এন্ট্রির অতিরিক্ত দায়িত্ব বাতিলের দাবিতে রামপুরহাট-১ নম্বর ব্লকের বিডিও অফিসের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভে অংশ নিলেন রামপুরহাট এলাকার বিভিন্ন বুথের BLO রা। তাঁদের অভিযোগ, ইতিমধ্যেই ভোটার তালিকা সংশোধন, ফিল্ড ভেরিফিকেশন ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের চাপ অত্যধিক। তার উপর নতুন করে ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রির দায়িত্ব চাপানো হলে কাজের মান বজায় রাখা সম্ভব হবে না। মাঠ পর্যায়ের কর্মী হওয়ায় তাঁদের ফিল্ডওয়ার্কেই অধিক সময় ব্যয় হয়। ফলে অফিসভিত্তিক ডেটা এন্ট্রির জন্য আলাদা সময় বের করা তাঁদের পক্ষে কঠিন। BLO রা দাবি করেন, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং অতিরিক্ত কর্মী সহায়তা ছাড়া এ ধরনের কাজ তাঁদের উপর চাপানো উচিত নয়। এই দাবিগুলি জানিয়ে তাঁরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সামিল হন।

রামপুরহাট-১ নম্বর ব্লকের বিডিও অফিসের সামনে শুক্রবার সকাল থেকেই দেখা গেল এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য। সাধারণত বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ, জনসেবামূলক কার্যক্রম ও রুটিন কাজকর্মে সরগরম থাকে এই অফিস চত্বর। কিন্তু সেদিন সেই পরিচিত পরিবেশের সঙ্গে যোগ হয়েছিল কর্মীদের ক্ষোভের সুর। রামপুরহাট অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন বুথের বহু BLO—অর্থাৎ ব্লক লেভেল অফিসার—সকালে থেকেই একত্রিত হয়ে অবস্থান-বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন। তাঁদের হাতে ছিল বিভিন্ন দাবি-দাওয়া লেখা প্ল্যাকার্ড, সামনে টাঙানো ছিল বিক্ষোভের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা ব্যানার, আর মুখে ছিল প্রতিবাদের স্লোগান।

তাঁদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি বিষয়—SIR ফর্মের ডেটা এন্ট্রি করার অতিরিক্ত দায়িত্ব। BLO–দের দাবি, তাঁদের কাজের প্রকৃতি ঐতিহ্যগতভাবে মাঠপর্যায়ের। ভোটার তথ্য সংগ্রহ, ফিল্ড ভেরিফিকেশন, নথি যাচাই, ভোটার তালিকা সংশোধনী ক্যাম্পে উপস্থিতি—এসব কাজই স্বভাবতই সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য। তার উপর অতিরিক্তভাবে অফিসভিত্তিক ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রির কাজ তাঁদের উপর চাপিয়ে দিলে কাজের ভার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা বাস্তবে পালন করা প্রায় অসম্ভব।

এছাড়াও BLO–দের অভিযোগ, এই ডেটা এন্ট্রি সংক্রান্ত কোনও বিশেষ প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তিগত সাহায্য তাঁদের দেওয়া হয়নি। ফলে অভিজ্ঞতা ও পরিকাঠামোর অভাবে এমন জটিল তথ্যভিত্তিক কাজ তাঁদের পক্ষে ঠিকভাবে সম্পন্ন করা কঠিন। তাঁদের মতে, অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে শুধু কাজের মানই কমে যাবে না, বরং তাঁদের নিয়মিত ফিল্ডভিত্তিক দায়িত্বও বাধাগ্রস্ত হবে।

শান্তিপূর্ণ এই অবস্থান-বিক্ষোভের মাধ্যমে BLO–রা প্রশাসনের কাছে পরিষ্কার বার্তা দেন—কাজের চাপ যদি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে মাঠকর্মীদের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। তাঁদের আশা, প্রশাসন তাঁদের দাবি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।

 BLO-দের দায়িত্বের বিস্তার এবং নতুন চাপের প্রতিবাদ
BLO বা ব্লক লেভেল অফিসাররা নির্বাচনী কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য যাচাই করা, নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত করা, ভুল সংশোধন করা, নথি সংগ্রহ করা, ভোটারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা এবং প্রতিটি বুথে সঠিক ও আপডেট তথ্য নিশ্চিত রাখা। প্রতি বছরই নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে বিভিন্ন বিশেষ সংশোধনী অভিযান, ক্যাম্প, ফিল্ড ভেরিফিকেশন—এ সব কাজ তাঁদের করতে হয়। ফলে তাঁদের কাজের চাপ স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

BLO–দের মতে, তাঁরা ইতিমধ্যে যে পরিমাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত, তার সঙ্গে SIR ফর্মের জটিল ডেটা এন্ট্রির দায়িত্ব যোগ হলে কর্মক্ষেত্রে অসম্ভব চাপ তৈরি হবে। তাঁরা বলেন, “আমরা মাঠ পর্যায়ের লোক। আমাদের দিনের বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাই করতে। আমাদের কাজের ধরনই এমন যে অফিসে বসে ডেটা এন্ট্রি করার মতো সময় পাওয়া প্রায় অসম্ভব।”

 কেন SIR ফর্মের ডেটা এন্ট্রি তাঁদের জন্য সমস্যাজনক?
SIR ফর্ম সাধারণত বিশদ তথ্য-নির্ভর একটি জটিল ফর্ম, যার প্রতিটি তথ্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রবেশ করাতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, সময় এবং একটি প্রযুক্তিগত সাপোর্ট সিস্টেম। কিন্তু BLO–দের অভিযোগ — তাঁদের কোনওরকম বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি, প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাবও স্পষ্ট। অনেক এলাকার BLO–রা তো সঠিক ইন্টারনেট সংযোগ পর্যন্ত পান না। ফলে ডেটা এন্ট্রি–র মতো সময়সাপেক্ষ ডিজিটাল কাজ তাঁদের উপর চাপানো হলে তা অত্যন্ত অযৌক্তিক।

একজন BLO জানান —
“যে কাজের জন্য আলাদা কর্মী থাকা উচিত, তা আমাদের উপর চাপানো হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ফিল্ডে থাকি, ডেটা এন্ট্রি করতে গেলে তো অফিসে বসতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব?”

 প্রশাসনিক চাপে ক্ষোভ বৃদ্ধি
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া BLO–রা আরও অভিযোগ করেন, তাঁদের কাজের পরিমাণ দিন দিন বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনও সুবিধা বাড়ছে না। না বাড়ছে আর্থিক ভাতা, না দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত কর্মী সাহায্য, এমনকি অনেক সময় তাদের সরঞ্জামও নিজেদের কিনে রাখতে হয়। তাঁরা জানান, দায়িত্ব বাড়ছে, কিন্তু নিরাপত্তা, ভাতা, প্রযুক্তিগত সহায়তা—এসব ক্ষেত্রে কোনও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হচ্ছে না।

এক BLO ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন —
“আমাদের কাছ থেকে সব কাজই করানো হয়। কিন্তু সমস্যা বা উদ্বেগ জানালে কেউ গুরুত্ব দেয় না। মাঠে গিয়ে নথি সংগ্রহ করা এক বিষয়, আর অফিসে বসে ডেটা এন্ট্রি করা সম্পূর্ণ আলাদা দক্ষতার কাজ।”

শান্তিপূর্ণ অবস্থান-বিক্ষোভ: দাবি ও প্রতিবাদ
এই বিক্ষোভ ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। BLO–রা বিডিও অফিসের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে বসেন। কারও হাতে পোস্টার — “অতিরিক্ত দায়িত্ব নয়, ন্যায্য কাজ চাই”, “ডেটা এন্ট্রি আমাদের কাজ নয়”, “প্রশিক্ষণ ছাড়া অতিরিক্ত কাজ নয়”। প্ল্যাকার্ডের পাশাপাশি ছিল দাবি-দাওয়া সম্বলিত ব্যানার। তাঁরা বারংবার জানাচ্ছিলেন—প্রশাসনের উচিত বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা এবং BLO–দের দায়িত্ব অনুযায়ী যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া।

তাঁদের মতে, দায়িত্ব বাড়ানোর আগে প্রশাসনের উচিত BLO–দের কাজের ধরন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানা। কারণ মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গেলে প্রতিদিনই তাঁদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কখনও বাড়ির লোকজন উপস্থিত থাকে না, কখনও তথ্য মেলে না, কখনও কোনও নথি ঠিক মেলে না। আবার অনেক সময় বাইরের গ্রামাঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়ায় অ্যাপ-এর কাজও আটকে যায়। ফলে তাঁদের কাজের সময়সীমা অনেক সময় লম্বা হয়ে যায়।

news image
আরও খবর

 সরকারি নীতি ও বাস্তবতার ব্যবধান নিয়ে অভিযোগ
বিক্ষোভস্থলে উপস্থিত BLO–দের দাবি—সরকারি নীতি অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। নীতি প্রণয়ন করা হয় অফিসের ভিতরে বসে, কিন্তু তার প্রয়োগ করতে হয় মাঠ পর্যায়ে BLO–দের। ফলে দুয়ের মধ্যে একটি বড় ফাঁক তৈরি হয়। তাঁরা মনে করেন প্রশাসন যদি বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিত, তবে SIR ফর্মের ডেটা এন্ট্রির এমন দায়িত্ব তাঁদের উপর চাপানোর কথা উঠতই না।

তাঁরা আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের অনেক অ্যাপ বা ডিজিটাল পোর্টাল ফিল্ডে গিয়ে অনেক সময় কাজ করে না। ফলে ডেটা আপলোড বা ইনপুট করতে গিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত সময় পর্যন্ত ক্ষতি হয়। এই পরিস্থিতিতে নতুন ডেটা এন্ট্রি–র দায়িত্ব যুক্ত হওয়া মানে তাঁদের উপর আরও অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করা।

 কি চান BLO–রা?
তাঁদের প্রধান দাবি:

SIR ফর্মের ডেটা এন্ট্রির দায়িত্ব অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

BLO–দের কাজের সীমা নির্দিষ্ট ও যুক্তিসঙ্গতভাবে নির্ধারণ করতে হবে।

প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদান করতে হবে।

অতিরিক্ত কাজের জন্য ভাতা বা অতিরিক্ত বেতন প্রদান করতে হবে।

ফিল্ডওয়ার্ককে গুরুত্ব দিয়ে ডেটা এন্ট্রির মতো কাজ আলাদা কর্মীদের মাধ্যমে করাতে হবে।

 প্রশাসনের ভূমিকা ও সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত
বিক্ষোভের খবর দ্রুত প্রশাসনিক মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনও সরকারি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তবে আন্দোলনকারীদের আশা প্রশাসন খুব শীঘ্রই তাঁদের দাবি বিবেচনা করবে। BLO–দের বক্তব্য—সরকারি কাজের গতি বাড়াতে হলে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের বাস্তব সমস্যাগুলি বুঝে তাদের কাজের চাপ হ্রাস করাই প্রশাসনের উচিত।

 আন্দোলনের গুরুত্ব: কর্মীদের কণ্ঠস্বর
রামপুরহাট-১ ব্লকের BLO–দের সাম্প্রতিক আন্দোলন শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত কাজের চাপ বা অতিরিক্ত দায়িত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়—এই ঘটনাটি সরকারি প্রশাসনিক কাঠামো, দায়িত্ব বণ্টন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন তুলে ধরে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অভিযোগ বহুদিনের; নীতি প্রণয়ন হয় অফিসকক্ষে, কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁদেরই। BLO–দের মতে, মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ, যাচাই, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ—এসবই অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং শারীরিক-মানসিক পরিশ্রমের কাজ। এর পাশাপাশি জটিল ডেটা এন্ট্রির দায়িত্ব তাঁদের উপর চাপানো হলে কাজের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কাজের মানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই আন্দোলন তাই শুধুমাত্র একটি কাজ প্রত্যাহারের দাবি নয়, বরং সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে মাঠ কর্মীদের বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতার গভীর ফাঁককে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। BLO–রা মনে করেন—যে কোনও প্রশাসনিক নীতি বাস্তবায়নের মূল শক্তি তাঁরা, কিন্তু তাঁদের মতামত বা সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় খুব কমই। সেই কারণেই তাঁদের এই আন্দোলন প্রশাসনকে মনে করিয়ে দেয় যে, কোনও কাজের সুফল নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রয়োজন, সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতাকে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

তাঁরা আশা করছেন, প্রশাসন তাঁদের এই বার্তা গুরুত্ব সহকারে নেবে এবং ভবিষ্যতে দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত, যুক্তিযুক্ত এবং মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কাজের চাপ সঠিকভাবে ভাগ করা গেলে শুধু BLO–রাই নয় সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী হয়ে উঠবে। অতিরিক্ত চাপ কমলে তাঁদের কাজের মান বাড়বে, ভুল কম হবে এবং জনগণের কাছে পরিষেবার মানও উন্নত হবে। তাই এই আন্দোলন শুধু একটি দাবি নয়; এটি মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কণ্ঠস্বরকে সামনে আনার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

Preview image