অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অনিয়ম ও পরিষেবার মান নিয়ে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন অভিযোগের জবাব না মেলায় কেন্দ্রের দরজায় তালা ঝুলিয়ে প্রতিবাদ জানান তারা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা
নভেম্বরের শেষ দিকের এক সাধারণ সকাল। গ্রামের চেনা পথ, ছায়াঘেরা গাছ, পাখির ডাক সব মিলিয়ে দিনটা যেন প্রতিদিনের মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সেই শান্ত সকাল ভেঙে গেল উত্তেজনা আর ক্ষোভে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সামনে ভিড় জমল গ্রামবাসীদের। মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই সেই ভিড় রূপ নিল বিক্ষোভে। প্রবল ক্ষোভে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিল স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, অঙ্গনওয়াড়ির পরিষেবায় একাধিক অনিয়ম, পুষ্টিকর খাদ্য বিলিতে দুর্নীতি, শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের অবহেলা, সময়মতো পরিষেবা না পাওয়া, পরিচ্ছন্নতার অভাব এমন আরও বহু সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন তাঁরা।
এই প্রতিবেদন সেই বিক্ষোভ, ক্ষোভের কারণ, কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া, অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থার সামগ্রিক দুরবস্থা, বিশেষজ্ঞ মত, এবং ভবিষ্যতে সমাধানের সম্ভাবনা সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানমূলক বিবরণ।
গ্রামের বারোমাসে ত্রিশ দিন চলা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রটি বহু বছর ধরে এলাকার অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটি পরিবারের ভরসা। এখানেই শিশুদের পুষ্টিকর খাবার, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের স্বাস্থ্যপরামর্শ, স্কুল-পূর্ব শিক্ষা, টিকাকরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা সব পরিষেবা দেওয়ার কথা।
কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, “কাগজে-কলমে” পরিষেবা থাকলেও বাস্তবে তার অর্ধেকও পাওয়া যায় না।
সেই হতাশা জমতেই জমতেই রবিবার সকালে ফেটে পড়ল।
একজন গ্রামবাসী জানান, এমন অবহেলা আর সহ্য হবে না। আমরা বহুবার বলেছি। কিন্তু কেউ শুনছে না। তাই বাধ্য হয়েই আজ তালা লাগালাম।”
সকাল সাড়ে আটটা নাগাদই কেন্দ্রের সামনে ভিড় বাড়তে শুরু করে। বেশির ভাগই শিশুদের মা, পরিবার-পরিজন, স্থানীয় পঞ্চায়েত এলাকার সাধারণ মানুষ। বয়স্করাও এসেছিলেন পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে।
মুহূর্তের মধ্যে কেন্দ্রের প্রধান দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভ শুরু হয় শান্তিপূর্ণ স্লোগান ও ব্যানার নিয়ে। গ্রামের মহিলারাই ছিলেন সামনে:
“অঙ্গনওয়াড়ি ঠিক চাই”, “শিশুদের খাবার দিতে হবে”, “মিথ্যা দেখাবেন না, কাজ দেখান”এমন স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে আশপাশের এলাকা।
গ্রামবাসীরা শুধুই আবেগে নয়, নির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়েই বিক্ষোভে নেমেছেন। তাঁদের অভিযোগগুলি কয়েকটি ভাগে সাজানো যায়:
পুষ্টি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো
০-৬ বছর বয়সী শিশু
গর্ভবতী মহিলা
স্তন্যদানকারী মা
এদের দৈনিক পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করা।
কিন্তু লোকজনের অভিযোগ
খাবারের মান পড়ে গেছে
অনেক সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণ দেওয়া হয় না
আসা খাবারের কাগজে সই নিতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু বাস্তবে বিতরণ হয় না
শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট ডিম, খিচুড়ি, সুজি, পুষ্টি মিশ্রণ সবই ঠিকমতো দেওয়া হয় না
একজন যুবক বলেন,
“ডিম সপ্তাহে তিন দিন দেওয়ার কথা। কিন্তু মাসে তিনটা পাওয়া কঠিন!”
এক মা জানান,
আমার ছেলের নাম রেজিস্টারে আছে। কিন্তু খাবার নিতে গেলে বলে যা এসেছে সব বিলি হয়ে গেছে।”
শিশুরা সকাল বেলায় আসে খেতে বা পড়তে।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য অনেক দিন দেখি,
কেন্দ্র খুলে দেরি
আবার মাঝেমধ্যেই আগেভাগে বন্ধ
আয়া বা কর্মীর অনুপস্থিতি
কেন্দ্রের ভিতরের পরিবেশ নাকি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
রান্নাঘর অপরিষ্কার
বাসন-কোসনে ঠিকমতো ধোয়া হয় না
টয়লেট ব্যবহার যোগ্য নয়
বাচ্চাদের খেলার জায়গায় ময়লা জমে থাকে
গর্ভবতী ও নতুন মায়েরা জানান,
ওজন নেওয়া হয় না নিয়মিত
টিকা বা আয়রন-ফলিক অ্যাসিডের মতো সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয় না ঠিক মতো
স্বাস্থ্যকর্মীদের কেউ আসে না
অঙ্গনওয়াড়িতে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, অভিযোগ
“শিক্ষা” কার্যক্রম প্রায় নেই
শিশুদের শুধু বসিয়ে রাখা হয়
শিক্ষাসামগ্রী নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে ব্যবহারের বাইরে
কেন্দ্রে তালা লাগানো খবর প্রথমে ছড়ায় স্থানীয় পঞ্চায়েতে। পরে ব্লক সমন্বয়ক, সিডিপিও অফিস এবং জেলা সমাজ কল্যাণ দফতরও বিষয়টি জানতে পারে।
পঞ্চায়েত প্রধান বলেন,
“মানুষের ক্ষোভের জায়গা আছে। আমরা তদন্ত করে দেখব। যদি কোনও অনিয়ম হয়ে থাকে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কর্মীরা পাল্টা দাবি করেন
তাঁরা নিয়ম মেনে কাজ করেন
খাবার কম আসে
দফতর থেকেই জিনিসপত্র নিয়মিত পাঠানো হয় না
কর্মীসংখ্যা কম হওয়ায় সমস্যা হয়
একজন সহায়ক বলেন,
“একাই সব সামলাতে হয়। খাবারও সময়মতো আসে না। অথচ দোষটা আমাদেরই।”
ব্লক চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের আধিকারিক জানান,
“অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে। প্রয়োজন হলে নতুন ভাবে মনিটরিং শুরু করা হবে।”
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির সমস্যা আজকের নয়। গোটা দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়ে আছে আইসিডিএস প্রকল্প। বিশেষজ্ঞরা বলছেন
কর্মীর সংখ্যা কম
সম্মানী কম হওয়ায় কাজের আগ্রহ হ্রাস
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব
নজরদারি কম
পুষ্টিকর খাবারের সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যা
প্রকল্পের ফান্ড কমে যাওয়া
এই বিক্ষোভ সেই বৃহত্তর সমস্যারই একটি চিত্র।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া ক্ষোভকে তাঁরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দাবিতে সাজিয়েছেন:
নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখতে হবে
খাবারের মান ও পরিমাণ নিশ্চিত করতে হবে
কেন্দ্র পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
স্বাস্থ্যপরামর্শ নিয়মিত দিতে হবে
কর্মীর আচরণ নিয়ে অভিযোগ হলে ব্যবস্থা নিতে হবে
মাসে অন্তত দু’বার মনিটরিং টিম পাঠাতে হবে
গ্রামবাসীদের ভাষায়, “আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা বন্ধ হোক।
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে
০–৬ বছর বয়স সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের পুষ্টির ঘাটতি আয়রন কমে যাওয়া, উচ্চতা-ওজন কমে যাওয়া, মেধা বিকাশে বাধা এভাবে শিশুর পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে।
অঙ্গনওয়াড়ি এই ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাই এই পরিষেবায় অনিয়ম মানে ভবিষ্যৎকে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া।
একজন শিশু বিশেষজ্ঞের ভাষায়:
“শিশুর পুষ্টি বা টিকা নিয়ে অবহেলা মানে শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতেরও ক্ষতি। তাই অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থায় কঠোর নজরদারি জরুরি।”
বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ থাকলেও ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে স্থানীয় পুলিশ আসে। তারা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশ জানিয়েছে
গ্রামবাসীরা শান্তভাবে দাবি তুলেছেন
কোনও ভাঙচুর হয়নি
তাদের উদ্বেগ যথার্থ
প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ করতে বলা হচ্ছে
ব্লক প্রশাসন নিশ্চিত করেছে
মাসিক পরিদর্শন
খাবার বিতরণের রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা
কেন্দ্রের সাফাই নিয়মিত খতিয়ে দেখা
গ্রামবাসীরা ফোনে অভিযোগ জানাতে পারবেন এমন একটি ব্যবস্থা চালুর কথা আলোচনা চলছে।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের
শিশু পরিচর্যা
খাদ্য নিরাপত্তা
স্বাস্থ্যসচেতনতা
এই বিষয়ে নতুন প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
রেজিস্টার ডিজিটাল করা
খাবার বিতরণের আগে ও পরে ছবি তুলে আপলোড করার পরিকল্পনা
বিক্ষোভ এখন শান্ত হয়েছে। তালা খুলে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের আশ্বাসে।
কিন্তু গ্রামবাসীদের আশা
“এই কেন্দ্র যেন আবার তার পুরনো মর্যাদা ফিরে পায়।
তাঁদের বক্তব্য আমরা বিক্ষোভ করেছি বাচ্চাদের কথা ভেবে। শত্রুতা নয়, সমাধান চাই
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র শুধু একটি ভবন নয় এটি গ্রামীণ ভারতের শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই কেন্দ্রগুলির কার্যকারিতা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তাই অনিয়ম, অবহেলা, দুর্নীতি, পরিষেবার অভাব এসব কোনওভাবেই সহনীয় নয়।
এই ঘটনার মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হলো
সচেতন গ্রামবাসীরাই প্রকল্পকে কার্যকর রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন
তাঁদের সক্রিয়তা প্রশাসনকে জবাবদিহি করায়, শিশুদের অধিকার রক্ষা হয়, এবং সমগ্র সমাজই উপকৃত হয়