Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

বাহিরি গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু ঘিরে উত্তেজনা

বীরভূমের নানুর ব্লকের বাহিরি গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিকের আকস্মিক মৃত্যু ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। মৃত যুবকের নাম স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের বাইরে শ্রমিকের কাজ করতেন। কয়েকদিন আগে অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর হঠাৎ তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, রাতে আচমকা অচেতন হয়ে পড়লে তাঁকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর থেকেই এলাকায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এটি স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে? পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামে উত্তেজনা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, মৃত্যু নিয়ে স্বচ্ছ তদন্ত হোক এবং প্রকৃত কারণ প্রকাশ পাক।

বীরভূম জেলার নানুর ব্লকের অন্তর্গত বাহিরি গ্রাম সাধারণত তার শান্ত পরিবেশ, কৃষিনির্ভর জীবনযাপন এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীলতার জন্য পরিচিত। বছরের বেশিরভাগ সময় গ্রামের বহু যুবকই কর্মসংস্থানের খোঁজে ভিনরাজ্যে চলে যান, আর তাঁদের আয়ের ওপরই অনেক পরিবারের সংসার চলে। এই শান্ত গ্রামের পরিবেশই গত কয়েকদিন ধরে নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। কারণ, এক পরিযায়ী শ্রমিকের রহস্যজনক মৃত্যু গোটা গ্রামকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ মৃত্যু যেন গ্রামবাসীর মনে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

গ্রামের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান রাস্তা, চায়ের দোকান কিংবা বাজার—যেখানেই চোখ যায়, শুধু একটাই আলোচনা: সেই যুবকের মৃত্যু কীভাবে ঘটল? এটা কি নিছক স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও কোনো অজানা ঘটনা? প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওই শ্রমিক কয়েকদিন আগে ভিনরাজ্য থেকে ফিরেছিলেন এবং সামান্য অসুস্থও ছিলেন। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যু স্থানীয়দের মধ্যে আরও সন্দেহ জাগাচ্ছে।

পরিবারের কান্না, প্রতিবেশীদের বিভ্রান্তি এবং গ্রামজুড়ে আতঙ্কের আবহ মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কেউ বলছেন এটি স্বাভাবিক মৃত্যু, আবার কেউ দাবি করছেন ঘটনার নেপথ্যে থাকতে পারে অন্য কোনো কারণ। এসব নিয়েই এখন চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বাহিরি গ্রামে।

 মৃত শ্রমিকের পরিচয় ও পরিবারের অবস্থা

স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, মৃত যুবক বহুদিন ধরেই রাজ্যের বাইরে শ্রমিকের কাজ করে নিজের পরিবার চালাতেন। গ্রামে কৃষিকাজের অনিশ্চয়তা এবং সীমিত আয়ের কারণে গ্রামের বহু যুবকের মতো তিনিও কয়েক বছর আগে ভিনরাজ্যে কাজ করতে শুরু করেন। বছরভর পরিশ্রম করে কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামের পরিবারকে সামলে রাখতে গিয়েই তাঁর জীবন চলছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যু পরিবারকে ঘিরে ফেলেছে গভীর অনিশ্চয়তা ও আর্থিক সংকটে।

পরিবারের সদস্যরা ভেঙে পড়েছেন। তাঁর মা বারবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন, “ছেলে যখন বাড়ি ফিরল, তখনও তো ঠিকই ছিল। হঠাৎ এমন কী হলো!” স্ত্রীও শোকে বিহ্বল—স্বামীকে হারানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতের সংগ্রামের ভয় তাকে আরও অসহায় করে তুলেছে।

 বাড়ি ফেরার পর হঠাৎ অসুস্থতা

পরিবার জানায়, ভিনরাজ্য থেকে বাড়ি ফেরার দু-একদিন পর থেকেই তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। প্রথমে জ্বর, মাথাব্যথা ও দুর্বলতা দেখা দেয়। তাঁকে গ্রাম্য চিকিৎসকের দেখানোও হয়। কিন্তু পরিবারের দাবি, অসুস্থতার মাত্রা এতটা গুরুতর মনে হয়নি। তাই তাঁরা ভাবেন কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু শুক্রবার গভীর রাতে পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে। হঠাৎ করে তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি তাঁকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

এই ঘটনার পর থেকেই গ্রামের মানুষ হতবাক। কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে একজন সুস্থ-সবল যুবকের মৃত্যু হলো? তাঁর অসুস্থতা কি আসলেই সাধারণ জ্বর ছিল, নাকি তার নেপথ্যে ছিল আরও বড় কোনো জটিল শারীরিক সমস্যা—এ নিয়ে এখন নানা জল্পনা চলছে।

 মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জল্পনা-কল্পনা ও সন্দেহ

গ্রামের একাংশ মনে করছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ স্বভাবতই কঠোর ও ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ সময় শারীরিক পরিশ্রম, ভিনরাজ্যের আবহাওয়ার বৈরিতা, পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব, এবং থাকা-খাওয়ার অনিয়ম—সব মিলিয়ে তাঁদের শরীরের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। ফলে অনেক সময় তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা যায়, যা যথাযথ চিকিৎসার অভাবে আরও বেড়ে ওঠে। গ্রামবাসীর ধারণা, মৃত শ্রমিকও হয়তো ভিনরাজ্যে কাজ করার সময় থেকেই শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন, যা বাড়ি ফেরার পর আরও প্রকট হয়। তাঁরা মনে করছেন, এই অসুস্থতাই হয়তো তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

তবে গ্রামের আরেক অংশ বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁদের মতে, ঘটনাটি যতটা সাধারণ মনে হচ্ছে, এর পেছনে থাকতে পারে আরও গুরুতর কিছু। প্রথম প্রশ্নই উঠেছে—মৃতের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল কি না? হঠাৎ করে কেন তাঁর মৃত্যু হল? বাড়ি ফেরার আগে কর্মক্ষেত্রে তাঁর কোনো ঝামেলা হয়েছিল কি? ভিনরাজ্যের কর্মপরিবেশ অনেক সময় শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ থাকে না—মজুরি নিয়ে বিরোধ, কাজের জায়গায় দুর্ঘটনা, বা সহকর্মীদের সঙ্গে বিবাদ—এ ধরনের সমস্যার কথা প্রায়শই শোনা যায়। ফলে সন্দেহ করা হচ্ছে, এমন কিছু ঘটেছিল কি না, যা তিনি পরিবারকে জানাননি।

পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজের জায়গায় সুরক্ষার অভাব, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার অনুপস্থিতি এবং নিয়োগকর্তার অবহেলা—এসব কারণে তাঁদের জীবনযাত্রা অনেক সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাই অনেকেই মনে করছেন, এই আকস্মিক মৃত্যু হয়তো সেই বৃহত্তর সমস্যারই প্রতিফলন। ফলে ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মনে সন্দেহ আরও গভীর হচ্ছে এবং বহু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি রয়ে গেছে।

news image
আরও খবর

 পুলিশের তদন্ত ও ময়নাতদন্ত

ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত গ্রামে পৌঁছে দেহ উদ্ধার করে। নিয়ম মেনে দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের দাবি, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয়। তবে তারা সবদিক খতিয়ে দেখছে—স্বাভাবিক মৃত্যু, অসুস্থতা, নাকি অন্য কোনো কারণ।

পুলিশ সূত্রের দাবি, বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, চিকিৎসকের পরামর্শপত্র জোগাড় করা হয়েছে এবং মৃত্যুর আগের ২৪ ঘণ্টায় তিনি কী কী করেছিলেন, তারও খতিয়ান নেওয়া হচ্ছে। মৃতের মোবাইল ফোনও পরীক্ষা করা হচ্ছে—কারও সঙ্গে শেষ মুহূর্তে কথা হয়েছিল কি না, কোনো বার্তা পাওয়া যায় কি না, সবই তদন্তের অন্তর্ভুক্ত।

 গ্রামে উত্তেজনা ও আতঙ্ক

মৃত্যুর পর থেকেই বাহিরি গ্রামে অস্বাভাবিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বহু মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় করেন, কেউ চিকিৎসকদের প্রশ্ন করেন, কেউ পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। অনেকে আবার বাড়ির সামনে জটলা করে ঘটনার বিশদ জানতে চান। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যরাও ঘটনাস্থলে যান এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার অনুরোধ করেন।

গ্রামের মানুষদের আশঙ্কা—যদি এটি রোগজনিত মৃত্যু হয়, তাহলে সেই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা আছে কি না? আবার কেউ বলছেন, পরিযায়ী শ্রমিকরা যেহেতু বাইরে কাজ করেন, তাই তাঁরা নানা ঝুঁকিতে থাকেন; ফলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।

 মৃতের পরিবারের দাবি—সঠিক তদন্ত হোক

মৃতের পরিবার পুলিশের কাছে দাবি করেছে, মৃত্যুর পেছনে যদি কোনো গাফিলতি বা সন্দেহজনক কিছু থাকে, তবে তা যেন প্রকাশ পায়। তাঁরা বলেন, “আমরা দরিদ্র মানুষ, কিন্তু আমাদের ছেলের মৃত্যুর সত্যিটা জানতে চাই। এটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি কেউ কিছু করেছে—আমরা জানতেই চাই।”

পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে গ্রামের বহু মানুষও। মৃতের সৎ তদন্ত ও পরিবারের ক্ষতিপূরণের দাবি উঠছে।

 সামাজিক ও মানবিক দিক

পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনযাপন ও বাস্তব সংকট এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও গভীরভাবে সামনে উঠে এসেছে। গ্রাম থেকে দূরে গিয়ে কাজ করা অনেক মানুষেরই জীবনে স্থায়ী নিরাপত্তা থাকে না। তাঁরা কঠিন পরিবেশে দীর্ঘ সময় শ্রম দেন, কিন্তু কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত সুরক্ষা, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা, উপযুক্ত বিশ্রাম বা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। আর্থিক অনটন দূর করার জন্য তাঁরা বাধ্য হয়ে ভিনরাজ্যে কাজ করতে যান, কিন্তু সেই কর্মজীবন তাঁদের শারীরিক ও মানসিক দু’দিক থেকেই বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু বা অসুস্থতার ঘটনা তাই মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনাম হয়। এই মৃত্যু শুধু একজন মানুষের বা একটি পরিবারের ব্যক্তিগত শোক নয়—এটি সমাজের সামনে বড় প্রশ্ন চিহ্ন তুলে ধরে। যেখানে দরিদ্র, দিনমজুর, শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান এখনও অনিশ্চিত, সেখানে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসুবিধা বাড়ানো এবং ভিনরাজ্যে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ নজরদারি ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে আলোচিত হয়ে ওঠে। এই ঘটনাই সেই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

 উপসংহার

মৃত্যুর তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাহিরি গ্রামজুড়ে এই উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা থেকেই যাবে। গ্রামবাসী অপেক্ষা করছেন ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য, কারণ সেটিই স্পষ্ট করে জানাবে—এটি কি সত্যিই অসুস্থতার কারণে ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। পরিবারের শোকের পাশাপাশি গ্রামবাসীর মনে সন্দেহ, আতঙ্ক ও নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সকলেই আশা করছেন, তদন্তের মাধ্যমে সত্য উন্মোচিত হবে এবং মৃত্যু ঘিরে সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটবে।

Preview image