পশ্চিমবঙ্গে সিআইআর বিতর্কের মাঝেই বাংলাদেশি নাগরিক রুকনুজ্জামান রনি তার স্বপ্ন হারালেন। দেশে ফেরার পথে তিনি জানান, এই বিতর্কের কারণে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারতের মাটিতে দীর্ঘদিন থাকার পর, দেশে ফিরে যাওয়ার সময় কিভাবে তাদের জীবনের পরিকল্পনাগুলি ধ্বংস হয়ে গেল, সে বিষয়ে কথা বলেন রনি।
পশ্চিমবঙ্গে সিআইআর (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট রুলস) নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনে ব্যাপক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক মাসে, বিশেষ করে ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) নিয়ে উত্তেজনা বাড়ানোর পর, বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য ভারতীয় মাটিতে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। সিআইআর বিতর্ক এবং এর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সাংবিধানিক সমস্যা ভারতীয় রাষ্ট্রে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি করেছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে রুকনুজ্জামান রনি, যিনি একজন বাংলাদেশি নাগরিক, সম্প্রতি নিজের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান ঘটতে দেখেছেন। তিনি জানান, সিআইআর বিতর্কের মধ্যে ভারতের মাটিতে স্বপ্ন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও বর্তমানে এই পরিস্থিতির কারণে সব কিছু ভেঙে গেছে। তার মতো আরও অনেক বাংলাদেশি নাগরিক যাদের ভবিষ্যৎ ভারতীয় রাষ্ট্রে বসবাসের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল, তারা এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
রুকনুজ্জামান রনি, যিনি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন কাজের উদ্দেশ্যে, দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা শহরে কাজ করছিলেন। তিনি তার জীবনের পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন এবং একটি স্থায়ী জীবন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই ভারতে এসেছিলেন। তার মতে, “আমি যখন এখানে এসেছিলাম, তখন আমার চোখে স্বপ্ন ছিল, আমি ভারতীয় সমাজের অংশ হবো, আমার পরিবারকে ভালোভাবে থাকতে সাহায্য করব।”
তবে, সিআইআর বিতর্ক এবং সরকারী সিদ্ধান্তগুলির পর, রনির মতো অনেক মানুষের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। বিশেষ করে, যাদের দীর্ঘদিন ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার অধীনে ছিল, তাদের জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রনি জানান, “এখন আমি নিজেকে নিঃসঙ্গ এবং হতাশ মনে করছি। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, আর এই পরিস্থিতিতে স্বপ্নগুলি একে একে ভেঙে পড়েছে।”
সিআইআর বিতর্কের প্রভাব শুধু ভারতীয় নাগরিকদের উপর পড়েনি, বরং বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্যও তা গভীর প্রভাব ফেলেছে। সরকারী তথ্যানুসারে, সিআইআর বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের আওতায়, যেসব বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানি মুসলিমরা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকের আবেদন বাতিল বা অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় মাটিতে বসবাস করে এসেছেন, তাদের জন্য এই নতুন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে উঠেছে। রুকনুজ্জামান রনি তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, “অনেকেই আমাদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু সিআইআর বিতর্কের পর থেকে আমাদের জন্য সবকিছু কঠিন হয়ে উঠেছে। আমরা যখনই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে যাই, তখনই সরকারী নিয়মের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যায়।”সিআইআর বিতর্কের প্রভাব শুধু ভারতীয় নাগরিকদের উপর সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্যও তা একটি গভীর সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশি মুসলিম নাগরিকরা যারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করছেন, তারা আজ নাগরিকত্বের জন্য যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন না। সরকারী সূত্রে জানা যায়, অনেক বাংলাদেশি নাগরিক নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সিআইআর বিতর্কের পর তাদের আবেদন অগ্রাহ্য বা বাতিল হয়ে গেছে। বিপদ বাড়ানোর আরেকটি কারণ হলো, ভারতীয় সরকার সিআইআর ও NRC প্রক্রিয়া নিয়ে যেভাবে আলোচনা করেছে, তা বাংলাদেশি মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে ধরা পড়েছে। কারণ, যেসব বাংলাদেশি মুসলিমরা সিআইআর অধীনে নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করেছিলেন, তাদের আবেদন অসম্পূর্ণ বা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে, তারা যে স্থায়ী বসবাসের স্বপ্ন নিয়ে ভারতীয় মাটিতে এসেছিলেন, তা এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রুকনুজজ্জামান রনি একজন বাংলাদেশি নাগরিক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কলকাতায় বসবাস করে আসছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা ২০০৮ সাল থেকে ভারতে বসবাস করছে এবং তিনি এখানে একটি স্থায়ী জীবন গড়তে চেয়েছিলেন। রনি জানাচ্ছেন, “আমি ভারতের মাটিতে স্বপ্ন দেখে এসেছিলাম, আমি বিশ্বাস করতাম আমি এখানে একদিন ভারতের নাগরিক হবো। কিন্তু এখন তা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।” সিআইআর বিতর্ক এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের কারণে তার জীবনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে, যা তাকে হতাশ করে দিয়েছে।
রনি আরও বলেন, “আমাদের যে জীবনের স্বপ্ন ছিল, তা আজ শেষ হয়ে গেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় সমাজের অংশ ছিলাম, কিন্তু আজ আমরা রাষ্ট্রীয় আইনের কবলে পড়েছি। আমাদের মানবাধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে এবং আমাদের নাগরিকত্বের অধিকার তোলপাড় হচ্ছে।” এই পরিস্থিতি শুধু রনির জন্য নয়, আরও বহু বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং সিআইআর (CIR) নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তার মূল কারণ হল ভারতের নাগরিকত্বের নতুন সংজ্ঞা। এই আইনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং পার্সিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই আইনের বিরুদ্ধে অনেক মানবাধিকার সংগঠন, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক দলগুলি সরব হয়েছে। তাদের দাবি, এটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিক।
ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে, তবে সিআইআর এই ধর্মীয় ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এই আইন ও সিআইআর বিশেষত বাংলাদেশি মুসলিমদের জন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
ভারতীয় নাগরিকত্ব নীতির এই পরিবর্তন বা সংশোধন কতটা প্রয়োজনীয় ছিল, তা নিয়ে দেশের মধ্যে সমালোচনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারতের নাগরিকত্ব আইনের প্রক্রিয়া পুরনো হলেও, সময়ের সঙ্গে এটি সমন্বিত হতে পারে। তবে, সিআইআর আইন বাস্তবায়ন করলেই ভারতের নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার সাথে আরও অনেক জটিলতা সৃষ্টি হবে।
বিপরীতে, কিছু সমাজকর্মী এবং নাগরিক অধিকার সংগঠনরা দাবি করছেন, সিআইআর আইন ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। তারা মনে করেন, এই আইন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সত্তাকে ধ্বংস করবে এবং বহু মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেবে।
ভারতীয় সমাজে সিআইআর বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সমাজকর্মী, অধিকার সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ে। তারা বলছেন, সিআইআর, সিএএ এবং NRC কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নও তোলে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সিআইআর বিতর্কের প্রভাব শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের জন্যও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত, যারা বহু বছর ধরে ভারতীয় ভূখণ্ডে বসবাস করছেন, তাদের জন্য এই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা অনেক বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রুকনুজ্জামান রনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, কিন্তু তার জন্য তা সহজ নয়। “আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে, আমি তো এখানে নতুন জীবন শুরু করতে এসেছিলাম, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এই পরিস্থিতি আমাকে আমার স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে।”
রনি তার মতো আরও অনেক মানুষকে পাশে চান যারা এখন সিআইআর বিতর্কের কারণে দেশত্যাগের পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের মতো মানুষদের জন্য দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। আমাদের কাছে আর কোন উপায় নেই। আমরা যদি নিজেদের জীবনের জন্য একটা স্থিতিশীল পরিবেশ না পায়, তবে আমাদের কাছে যে স্বপ্ন ছিল, তা সত্যিই ধ্বংস হয়ে যাবে।”
সিআইআর বিতর্ক ভারতের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণভাবেই নয়, বরং প্রতিবেশী দেশগুলির নাগরিকদের জন্যও এটি একটি দুঃখজনক পরিণতি তৈরি করছে। বিশেষত, যারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় মাটিতে বসবাস করছে, তাদের জন্য এটি একটি অস্থির ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি করেছে।
রুকনুজ্জামান রনির মতো মানুষের পরিস্থিতি আমাদের সবার জন্য একটি বড় বার্তা হয়ে উঠেছে—এটি শুধুমাত্র একটি আইন বা রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি মানবাধিকার এবং জীবনের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রশ্ন। এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং সুশীল সমাজের উচিত, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটির সমাধান করা।