ঝাড়গ্রাম জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের টোটো ধর্মঘট।রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত টাকা আদায় ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের জুলুমবাজির অভিযোগ এনে চালকরা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ঝাড়গ্রাম জেলা, পশ্চিমবঙ্গ—সোমবার ভোর থেকেই জেলার রাস্তা যেন শুনশান। সাধারণত সকালবেলা বাজারে যাওয়া মানুষদের ভিড়ে যেখানে ব্যস্ততা দেখা যায়, সেই চিত্র যেন উধাও। কারণ একটাই—ঝাড়গ্রাম জুড়ে শুরু হয়ে গেছে টোটো চালকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। বহুদিন ধরে চলতে থাকা অভিযোগ, প্রশাসনিক জটিলতা এবং অতিরিক্ত চাপের বিরুদ্ধেই এই প্রতিবাদ। চালকদের দাবি, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অতিরিক্ত টাকা আদায়, এবং শ্রমিক সংগঠনের একাংশের চাপানউতোর তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থাকে ক্রমশ কঠিন করে তুলেছে।
তাঁদের সাফ কথা—৭২ ঘণ্টার মধ্যে দাবিদাওয়া পূরণ না হলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে। ব্যাহত হবে জেলার গণপরিবহণ, ক্ষতির মুখে পড়বেন সাধারণ মানুষ—তাইও তাঁরা বাধ্য হয়েছেন এই কঠোর পথে হাঁটতে। এই ধর্মঘটের কারণে যে বিশাল প্রভাব পড়েছে, তা প্রথমদিন থেকেই স্পষ্ট।
ধর্মঘটের প্রথমদিন থেকেই ঝাড়গ্রাম শহর ও গ্রামাঞ্চলে গণদর্শন, যাতায়াত এবং বাজার-সংক্রান্ত কাজকর্মে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে অফিসযাত্রী—সবাইকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ অসুবিধায় পড়লেও টোটো চালকদের দাবি, এই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে তাঁদের অভিযোগ বছরের পর বছর অনুযায়ী চাপা পড়েই থাকবে। তাই সরকারের কাছে তাঁরা ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন সমস্যার সমাধান করার জন্য।
এদিকে, চালকদের ধর্না মঞ্চে উঠে এসেছে আরেকটি বিস্ফোরক অভিযোগ। তাঁদের দাবি, তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের কিছু নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জুলুমবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে চালকদের জোর করে তোলাবাজির শিকার হতে হয়েছে, অভিযোগ অনুযায়ী সংগঠনের একাংশ পরিকল্পিতভাবে RTO-র অনিয়মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। যদিও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয়েছে।
ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে। প্রশাসন এখনো পর্যন্ত চালকদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি, তবে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা—সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়তে থাকলে সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করতেই পারে। অন্যদিকে টোটো চালকদের বক্তব্য, সরকারের প্রতি তাঁদের আস্থা আছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না হয়, তবে তারা বৃহত্তর ও আরও কঠোর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন।
টোটো চালকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ রেজিস্ট্রেশন নিয়ে। তাঁদের দাবি অনুযায়ী—সরকার যেখানে নির্দিষ্ট হারে রেজিস্ট্রেশনের ফি বেঁধে দিয়েছে, বাস্তবে RTO অফিসে নানা অজুহাত দেখিয়ে সেই নির্ধারিত ফি-র বাইরে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে।
চালকদের কথায়—
“ফাইল এগোতে হলে আলাদা করে টাকা দিতে হয়।”
“যে কাগজপত্র সরকার নির্দিষ্ট করেছে তা জমা দেওয়ার পরেও নানা ভুল দেখিয়ে মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়।”
“রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে দালালশাহীর কাছে যেতে বাধ্য করা হয়।”
চালকদের অভিযোগ অনুযায়ী, এভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে গিয়ে তাঁদের মাসিক আয়ের বড় অংশ খরচ হয়ে যায়। ফলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এক টোটো চালকের ভাষায়—“আমরা রোজগার করি খেটে। দিনে ৩০০–৪০০ টাকা আয় হয়। তার মধ্যে যদি রেজিস্ট্রেশনের নামে হাজার হাজার টাকা দিতে হয়, তাহলে বাঁচব কীভাবে?”
এমন অভিযোগ নতুন নয়। জেলার পরিবহন মহলের মতে, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াকে সহজ ও স্বচ্ছ করতে বহুবার দাবি উঠলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে অনেক চালকই অবৈধভাবে গাড়ি চালাতে বাধ্য হন। আর এখানেই শুরু হয় নতুন সমস্যা—পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি, জরিমানা, এবং চাপ।
ধর্মঘটকারী চালকদের মতে, রেজিস্ট্রেশনের প্রকৃত খরচ সরকারি নথিতে স্পষ্ট। কিন্তু বাস্তবে কাজ করাতে গেলে ২–৩ গুণ বেশি টাকা দিতে হয়। তাঁদের বক্তব্য,
ফিটনেস সার্টিফিকেট
বীমা আপডেট
ডকুমেন্ট যাচাই
নম্বর প্লেট প্রদান
এসব প্রতিটি ধাপেই কোথাও না কোথাও বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে।
চালকদের একাংশ দাবি করেন, তাঁরা বাধ্য হয়ে এই অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন, কারণ রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালালে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়। তবে তাঁদের কথায়, “প্রশাসনই আমাদের এই অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।”
এমনকি অভিযোগ, কোনও কারণ ছাড়াই অনেকের ফাইল আটকে রাখা হয়। তাঁদের দাবি—যদি না বাড়তি টাকা দেওয়া হয়, কাজই এগোয় না।
ধর্মঘটের ধর্না মঞ্চে আরেকটি বিস্ফোরক অভিযোগ ওঠে—শ্রমিক সংগঠনের একাংশের বিরুদ্ধে জুলুমবাজির অভিযোগ। চালকদের দাবি অনুযায়ী, তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের কয়েকজন নেতা তাঁদের ওপর নিয়মিত চাপ সৃষ্টি করেন। কেউ কেউ নানান কারণে তাঁদের কাছ থেকে টাকা দাবি করেন বলেও অভিযোগ।
চালকদের বক্তব্য—
“কখনও জোর করে চাঁদা দিতে বলা হয়।”
“কোন সংগঠনে যোগ দেব বা দেব না, সেটাও বলে দেওয়া হয়।”
“সমস্যা নিয়ে মুখ খুললে অপমান করা হয়।”
উল্লেখ্য, এসব অভিযোগ শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য—এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং চালকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে কিছু মহল প্ররোচনা দিচ্ছে।
ঝাড়গ্রামের বড় অংশই টোটো নির্ভর এলাকা। ট্রেন বা বড় বাস যেখানে পৌঁছায় না, সেখানে টোটোই ভরসা। তাই সোমবার থেকেই সাধারণ মানুষের যাতায়াত চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
দেখা গেছে—
স্কুলে যেতে অসুবিধায় পড়েছে ছাত্রছাত্রীরা
অফিসগামী মানুষ হাঁটাপথে চলতে বাধ্য হয়েছেন
বাজারঘাটে ভিড় কমে গেছে
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে
এদিকে, চালকেরা বলেন—“মানুষের অসুবিধা আমরা বুঝি। কিন্তু বছরের পর বছর আমাদের ওপর যে অন্যায় হচ্ছে, সেটা আর সহ্য করা সম্ভব নয়। এই আন্দোলন আমাদের বাঁচার অধিকার নিয়ে।”
টোটো চালকদের চারটি প্রধান দাবি:
সরকারি নির্ধারিত হারের বাইরে কোনও বাড়তি টাকা যেন কেউ না নিতে পারে।
চালকদের অভিযোগ—রেজিস্ট্রেশনের কাজ দালালদের মাধ্যমে করাতে বাধ্য করা হয়।
যে কোনও রাজনৈতিক চাপ বা জবরদস্তির বিরুদ্ধেই তাঁরা ব্যবস্থা চান।
নিয়মিত পুলিশি হয়রানি কমাতে পরিষ্কার নীতি তৈরি করাও তাঁদের দাবি।
চালকরা প্রশাসনকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আশ্বাস না পেলে তাঁরা আরও বড় আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ধর্মঘটে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়তে থাকলেও জেলা প্রশাসন এখনো পর্যন্ত চালকদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসার কথা ঘোষণা করেনি। তবে সূত্রের খবর, পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে দ্রুত আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। পরিবহণ দপ্তরেরও নজর রয়েছে বিষয়টির ওপর।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহল মনে করছে—
একদিকে চালকদের ক্ষোভ
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সমস্যা
এই দুইয়ের মধ্যে সমাধান খুঁজে বের করতেই হবে প্রশাসনকে।
টোটো চালকদের ধর্মঘট শুধু একটি পরিবহণ সমস্যার কথা বলে না; এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যারও চিত্র তুলে ধরে। পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলায় বেকারত্বের কারণে অসংখ্য পরিবার টোটোর ওপর নির্ভরশীল। তারা বিনিয়োগ করে, ঋণ নিয়ে এই গাড়ি কেনেন। কিন্তু নিয়মিত ঝামেলা, বাড়তি খরচ, এবং রাজনৈতিক চাপ তাঁদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে।
তাঁদের বক্তব্য—“আমরা টোটো চালাই, আমরা কোনও অপরাধ করি না। তাহলে কেন আমরাই বারবার টার্গেট হই? সরকার যদি পাশে দাঁড়ায়, আমরা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারব।”
এই আন্দোলন তাই শুধু টোটো চালকদের নয়, পুরো জেলার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিফলন।
ঝাড়গ্রামে টোটো ধর্মঘট যে বড় আকার নিচ্ছে, তা প্রথমদিন থেকেই স্পষ্ট। রেজিস্ট্রেশনে অনিয়ম, অতিরিক্ত টাকা আদায়, দালালচক্রের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক চাপ—সব মিলে চালকদের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে।
এখন দেখার বিষয়—
প্রশাসন ও সরকারের ভূমিকা কী হয়
সমস্যা সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়
সাধারণ মানুষের চলাচল কতদিন বিপন্ন থাকে
টোটো চালকদের দাবি—
“ন্যায্য অধিকার চাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ব।”
এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কী পথে এগোবে, সেটাই এখন ঝাড়গ্রামের নজরকাড়া প্রশ্ন।