Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

ঝলমলে রোদের তাপে, হালকা হিমেল হাওয়ায় অরণ্য-পাহাড়ের কাছে ঘুরে আসার আহ্বান

শীত এখনও পুরো দাপটে নামেনি, তবে আবহাওয়া বেশ মনোরম। এমন পরিবেশে দু’-তিন দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসার ইচ্ছে হতেই পারে। দূরে কোথাও নয়—আমাদের নিজেদের বাংলাতেই রয়েছে অসংখ্য মোহময় গন্তব্য, যেখানে পাহাড়ের শান্ত সৌন্দর্য আর জঙ্গলের সবুজ নীরবতা আপনাকে মুহূর্তে মুগ্ধ করবে।

ঠান্ডার দাপট এখনও তেমনভাবে জাঁকিয়ে বসেনি। তবে সকাল-সন্ধ্যার হালকা শিরশিরানি যেন মনকে আলতো করে ছুঁয়ে যায়। উজ্জ্বল ঝকঝকে রোদও এখন একেবারেই বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় না। বরং নরম মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারা সেই রোদের উষ্ণতা আর হিমেল হাওয়ার মৃদু পরশ মিলেমিশে এমন এক আবহ তৈরি করে, যা মুহূর্তেই মনকে টেনে নিয়ে যায় ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নে। শীতের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন মনোরম পরিবেশে দু’-তিন দিনের একটা ছোট্ট ট্রিপের পরিকল্পনা না করলে যেন নিজেকেই বঞ্চিত করা হয়।

এই সময়টা ঘুরে দেখার জন্য দারুণ উপযুক্ত, কারণ প্রকৃতি তখন নিজের রূপটাকে যেন আলতোভাবে খুলে ধরে। দূর-দূরান্তে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের নিজেদের বাংলাতেই রয়েছে অসংখ্য মনকাড়া জায়গা, যেখানে পাহাড়-টিলা, শাল-পিয়ালের বন, নদী-নালা আর গ্রামের নিস্তব্ধতা মিলেমিশে এক নিখুঁত শান্তির আবহ তৈরি করে। কোথাও দেখা মিলবে সবুজ পাহাড়ের কোমল রেখা, কোথাও আবার অরণ্যের গহিন পথে বয়ে চলা নদীর ঝিরঝির সুর। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য এমনভাবে চোখে ধরা দেয়, যেন প্রতিটি জায়গা আপনাকে নতুন করে স্বাগত জানাচ্ছে।

সব জায়গায় হয়তো পাহাড় নেই, কিন্তু বাংলার অরণ্যরাজি আর নদীর সৌন্দর্য যে কাউকে মোহিত করার ক্ষমতা রাখে। কোথাও গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে জমিনে আঁকে অপূর্ব ছায়াছবি, আবার কোথাও ঘন জঙ্গলের ভেতরে কুয়াশা জমে থাকে এক রহস্যময় নীরবতায়। শহুরে ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে এই ধরনের জায়গায় কয়েকটা দিন কাটানো মানেই নতুন উদ্যমে ফিরে আসা।

শরৎ আর হেমন্তের মাঝামাঝি এই মনোরম আবহই যেন বাংলার প্রকৃতিকে সবচেয়ে সুন্দর রূপে দেখা যায়। তাই ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেওয়ার এর চেয়ে ভালো সময় আর হতেই পারে না। পাহাড়-জঙ্গল-নদীর সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটালে ক্লান্ত মন-শরীর নতুন করে জেগে ওঠে, আর মনে হয়—এই ছোট্ট সফরটাই ছিল বছরের সেরা সিদ্ধান্ত।

বিসিন্দা পাহাড় — বাঁকুড়ার সবুজ সৌন্দর্য
বাঁকুড়া শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে বিসিন্দা পাহাড়। চারদিকে চাষজমি, টিলা আর অজস্র গাছপালা—যেন প্রকৃতি নিজের সবুজ আঁচল পুরোটা জুড়ে বিছিয়ে রেখেছে। পাহাড়ের মাথায় উঠলে চোখ যত দূর যায় সবুজের চাদরই দেখা যায়। এখানেই রয়েছে দেবী নাচনচণ্ডীর ছোট্ট পাথুরে মূর্তি, ঘেরা সিঁদুরলেপা মাটির ঘোড়ায়।

বিসিন্দা আসলে পাহাড় নয়, বরং টিলা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে উঠলে প্রথমে পাওয়া যায় হনুমানের মূর্তি, তারপর শিবলিঙ্গ। আরও উপরে উঠে পৌঁছানো যায় নাচনচণ্ডীর থান পর্যন্ত। সেখান থেকে শুরু হয় জঙ্গলের ভিতরের পায়ে চলা পথ—যেটি ধরে গেলে পৌঁছে যাবেন টিলার সর্বোচ্চ চূড়ায়। উপরের দৃশ্য সত্যিই নিঃশ্বাস কাড়ার মতো।

কীভাবে যাবেন:
কলকাতা থেকে দূরত্ব ২০৪ কিলোমিটার। গাড়িতে গেলে সময় লাগবে ৫–৬ ঘণ্টা। ট্রেন বা বাসে বাঁকুড়া গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন:
বিসিন্দা পাহাড়ে একটি সাধারণ অতিথিনিবাস রয়েছে। আগাম বুকিং না করলে ঘর পাওয়া কঠিন।

তুলিন — ঝালদার লুকোনো সৌন্দর্য
পুরুলিয়ার রূপ চার ঋতুতে চার রকম—বর্ষায় মোহনীয়, শীতে মনোমুগ্ধকর আর বসন্তে সজীব। অযোধ्या পাহাড় কিংবা গড়পঞ্চকোটের মতো জায়গা যতটা জনপ্রিয়, ঝালদা মহকুমার তুলিন ততটাই শান্ত, নিরিবিলি আর সুন্দর। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তের ছোট গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গিয়েছে সুবর্ণরেখা নদী।

তুলিন থেকে চাইলে বেরিয়ে পড়তে পারেন মুরুগুমা জলাধারের দিকে—মাত্র ২৩ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ঘেরা মুরুগুমার লেক যেন প্রকৃতির খেয়ালী তুলিতে আঁকা। সবুজ অরণ্যের ফাঁক দিয়ে নীল জলরাশি দেখতে দারুণ লাগে।

কীভাবে যাবেন:
হাওড়া থেকে রাতের ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেস ধরলে ভোরে পৌঁছবেন মুরী জংশনে। রাঁচী ইন্টারসিটি, শতাব্দী, বন্দে ভারত—সবকটিই যায়। মুরী থেকে তুলিন মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে।

কোথায় থাকবেন:

তুলিনে পর্যটকদের থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের হোমস্টে ও হোটেলের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে, যা ভ্রমণকে আরও আরামদায়ক করে তোলে। পুরুলিয়ার এই শান্ত, সবুজে ঘেরা গ্রামটিতে হোমস্টে সংস্কৃতি বিশেষভাবে জনপ্রিয়, কারণ এগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তা প্রত্যক্ষভাবে উপভোগ করা যায়। সাধারণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন কক্ষ, ঘরোয়া খাবারের স্বাদ, আর নিরিবিলি পরিবেশ—সব মিলিয়ে হোমস্টেগুলো ভ্রমণকারীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।

একই সঙ্গে, তুলিনে বেশ কিছু ছোট হোটেলও রয়েছে, যেগুলোতে আধুনিক সুবিধা, আরামদায়ক বিছানা, পরিষ্কার বাথরুম এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবা পাওয়া যায়। দামও তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, ফলে পরিবার, বন্ধু বা সলো ট্রাভেলার—সব ধরনের পর্যটকের জন্যই উপযোগী জায়গা।

news image
আরও খবর

তুলিনের আশপাশে প্রকৃতির নীরবতা এবং সবুজের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে চাইলে এসব থাকা-খাওয়ার জায়গা দারুণ উপযোগী। যেকোনো মৌসুমে পর্যটকদের ভিড় বাড়ে, তাই আগাম বুকিং করলে সুবিধা হয়।

বাড়ি — নদী, জঙ্গল আর বন্যতার টান

ঝাড়গ্রামের সবচেয়ে শান্ত আর নিরিবিলি জায়গাগুলোর মধ্যে হাতিবাড়ি অন্যতম। নামেই রয়েছে হাতির উপস্থিতির আভাস—এ এলাকা হাতির করিডরের কাছে। শালজঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে গিয়েছে সুবর্ণরেখা নদী। গভীর রাতে হাতির ডাকও শোনা যায় কখনও কখনও, যা এই জায়গাকে আরও রহস্যময় করে তোলে।

জঙ্গল এবং নদীর মাঝেই কেটে যেতে পারে এক–দু’টি দিন। পাশেই রয়েছে ঝিল্লি পাখিরালয়, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, কনকদুর্গা মন্দির—সবকটাই ঘুরে দেখা যায়।

কীভাবে যাবেন:

হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছানো অত্যন্ত সহজ এবং আরামদায়ক। প্রতিদিনই একাধিক এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেন ঝাড়গ্রামমুখী রুটে চলাচল করে, তাই সময়মতো ট্রেন পাওয়া নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তা থাকে না। সাধারণত এক্সপ্রেস ট্রেনে হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। ভোরবেলা, দুপুর কিংবা সন্ধে—দিনের বিভিন্ন সময়ে ট্রেন রয়েছে, তাই যাত্রীরা নিজেদের সুবিধামতো সময় বেছে নিতে পারেন। যাত্রাপথও বেশ আরামদায়ক; হাওড়ার কোলাহল পেরিয়ে ট্রেন ধীরে ধীরে পশ্চিম মেদিনীপুরের সবুজে ভরা গ্রামীণ পরিবেশে ঢুকে পড়ে, যা ভ্রমণপিপাসুদের মনকে রীতিমতো প্রফুল্ল করে।

ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নামলেই আপনাকে স্বাগত জানাবে ছায়াঘেরা রাস্তা, শাল-পিয়ালের গাছ আর আদিবাসী সংস্কৃতির আবহ। এখান থেকেই শুরু হয় হাতিবাড়ির পথে যাত্রা। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে গোপীবল্লভপুরের দিকে যেতে হবে গাড়ি বা ট্যাক্সিতে। রাস্তা মোটামুটি ভালো, আর পুরো পথটাই সবুজে ভরা। যাত্রার প্রতিটি মুহূর্তেই অরণ্যঘেরা প্রকৃতির ছোঁয়া মিলবে।

ঝাড়গ্রাম থেকে হাতিবাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়, তাই সময় লাগে এক ঘণ্টারও কম। শহুরে ব্যস্ততা থেকে ধীরে ধীরে যখন প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করেন, তখনই বোঝা যায়—হাতিবাড়ির আসল সৌন্দর্য তার নির্জনতায়। ঝাড়গ্রাম হয়ে হাতিবাড়ি যাওয়ার এই যাত্রাই ভ্রমণকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।

কোথায় থাকবেন:

পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম জেলার সবচেয়ে শান্ত, নিরিবিলি এবং প্রকৃতিসমৃদ্ধ এলাকাগুলোর মধ্যে হাতিবাড়ি অন্যতম। ঘন শালবনের বুক চিরে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদী, আশেপাশে হাতির করিডরের উপস্থিতি, আর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অরণ্যের গভীর নীরবতা—সব মিলিয়ে হাতিবাড়ি এমন এক পরিবেশ তৈরি করে, যা ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে সত্যিই স্বর্গের মতো। এই মনোরম পরিবেশে থাকার জন্য সবচেয়ে আদর্শ জায়গাটি হল পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়ন নিগমের অতিথি আবাস।

হাতিবাড়ির ভিতরেই অবস্থিত এই অতিথি আবাসটি প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি মিশে থাকার অভিজ্ঞতা দেয়। সাধারণ হোটেল বা লজের মতো নয়, এখানে থাকার মানেই অরণ্যের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকা। ঘরগুলো সাধারণ হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পর্যাপ্ত আরামদায়ক। চারপাশের জানলা খুললেই চোখে পড়ে সবুজের অবারিত রাজ্য, দূর থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক, আর সন্ধ্যা নামতেই জঙ্গলের নীরবতার সঙ্গে মিশে যায় নদীর কলকল ধ্বনি।

অতিথি আবাসের অন্যতম আকর্ষণ হল তার অবস্থান। এখানে থাকলে খুব সহজেই হাতিবাড়ির আশেপাশের প্রধান আকর্ষণগুলো ঘুরে দেখা যায়—ঝিল্লি পাখিরালয়, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, কনকদুর্গা মন্দির এবং সুবর্ণরেখা নদীর বিভিন্ন ঘাট। পাশাপাশি, গভীর রাতে ভাগ্য ভালো থাকলে দূর থেকে হাতির ডাকও শোনা যায়, যা ভ্রমণে এক অন্যরকম রোমাঞ্চ যোগ করে।

সুরক্ষার দিক থেকেও এই অতিথি আবাস বেশ নির্ভরযোগ্য, কারণ এটি সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। থাকার খরচ তুলনামূলক কম এবং পরিষেবা যথেষ্ট ভালো। তবে পর্যটনের মৌসুমে বুকিং পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে যায়, তাই আগেই রিজার্ভেশন করে রাখা ভালো।

হাতিবাড়ির অরণ্যঘেরা আবহে একটি–দুটি দিন কাটাতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গ বনোন্নয়ন নিগমের এই অতিথি আবাসই নিঃসন্দেহে সেরা পছন্দ। এখানে থাকার অভিজ্ঞতা আপনাকে শুধু প্রকৃতির কাছেই নিয়ে যাবে না, বরং শহুরে কোলাহল থেকে দূরে এনে দেবে শান্তি, প্রশান্তি এবং এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি।
 

Preview image