অজয় নদীতে ফের প্রকাশ্যে শুরু হয়েছে অবৈধ বালি তোলা। স্থানীয় গ্রামবাসীদের অভিযোগ, বালি মাফিয়ারা দিনের পর দিন নদীর বিভিন্ন অংশে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বালি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে নদীর পাড় ভাঙন, কৃষিজমি ক্ষতি, জলস্তর পরিবর্তনসহ পরিবেশগত সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। বারবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও স্থায়ী প্রশাসনিক নজরদারি না থাকায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন স্থানীয়েরা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন এভাবে বালি তোলা চলতে থাকলে অজয় নদীর অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা অজয় নদী কেবল একটি জলধারা নয়—এটি দুই রাজ্যের পরিবেশ, কৃষি ও অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নদী এলাকাবাসীর জীবনে অমূল্য ভূমিকা রেখে এসেছে। নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য গ্রাম, চাষের জমি, স্থানীয় বাজার ও পরিবহন ব্যবস্থা।
প্রাকৃতিক জলের প্রবাহ, পলি জমে জমিকে উর্বর করা, নদীভিত্তিক মাছ ধরা, ছোটখাটো ব্যবসা—সব মিলিয়ে অজয় নদী একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা তৈরি করেছে। কিন্তু গত প্রায় দুই দশকে এই নদীর উপর নেমে এসেছে ভয়াবহ এক সংকট—অবৈধ বালি তোলা।
এখনকার চিত্রটি ভয়ংকর। অজয় নদীর তলদেশে দিনরাত চলছে যান্ত্রিক খনন, বালি তোলা, ট্রাক বোঝাই করে রুটিনে পাচার। এটি শুধু একটি অপরাধ নয়—এটি পরিবেশ, সমাজ, অর্থনীতি এবং মানবজীবনের উপর বহুমাত্রিক আঘাত।
অবৈধ বালি তোলা একদিনে শুরু হয়নি। এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক উদাসীনতা, রাজনৈতিক স্বার্থ, বালি মাফিয়াদের দাপট এবং অধিক মুনাফার লোভ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বালি তোলার জন্য প্রয়োজন লাইসেন্স, খনন এলাকা নির্ধারণ, পরিবেশগত অনুমোদন ও নিয়মিত পরিদর্শন।
কিন্তু বাস্তব চিত্র তার বিপরীত।
নদী বালি নির্মাণ শিল্পে অপরিহার্য।
বাড়ি নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, বড় বড় প্রকল্প—সব ক্ষেত্রেই নদীর বালির চাহিদা বিপুল। নদীর বালি মানসম্পন্ন এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা।
বেশি লাভ – কম খরচ।
মেশিন দিয়ে দ্রুত বালি তোলা যায়, খরচ কম হয়, আয় অনেক বেশি। তাই বৈধ খাদের বদলে বেআইনি খনন দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে।
মাফিয়াদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।
এদের রয়েছে নিজস্ব শ্রমিক, গাড়ি, যন্ত্রপাতি, অস্ত্রধারী দুষ্কৃতী ও প্রভাবশালী ব্যাকআপ। ফলে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে ভয় পান।
প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারির অভাব।
সময়মতো অভিযান না হওয়া, অভিযানের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়া এবং আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাফিয়ারা বারবার বাঁচছে।
বালি খাদ ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম।
সরকারি বালি খাদ সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় অবৈধ বাজার বিস্তার করেছে।
অজয় নদীর পাড়ে বাস করা সাধারণ মানুষ আজ অসহায়। তাদের মতে—
দিনরাত অবৈধ খনন চলায় বাড়িঘর ফাটছে
চাষের জমিতে বালি ঢুকছে
নদীর জলধারা বদলে ভাঙন বাড়ছে
ট্রাকের চাপ বাড়ায় গ্রামীণ রাস্তাগুলো ভেঙে যাচ্ছে
রাতের ট্রাক চলাচলে নিদ্রাহীনতা ও দুর্ঘটনা বাড়ছে
প্রতিবাদ করলে হুমকি ও ভয় দেখানো হয়
"রাত ভর ট্রাকের আওয়াজে ঘুম নেই। নদীর দিক থেকে এমন কাঁপুনি আসে যে মনে হয় বাড়ি ভেঙে পড়বে। আমরা কতবার জানিয়েছি, কিন্তু কেউ শুনছে না।"
এই বেদনা অজয় নদীর পাড়ের শত শত পরিবারের।
নদী থেকে বালি তোলা নিয়ম মেনে হলে পরিবেশে তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন বালি তোলা ভয়ংকর প্রভাব ফেলে।
অতিরিক্ত বালি তোলায় নদীর বেসিন অস্বাভাবিক গভীর হয়ে যায়। ফলে—
জলধারা পরিবর্তিত হয়
মাটি ক্ষয় বাড়ে
নদী তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারায়
যন্ত্রপাতির খননে নদীর বাঁক বদলে যায়। ফলে—
নদী নতুন জায়গায় আঘাত করতে শুরু করে
পাড় ভাঙন ভয়াবহ হয়
গ্রাম বসতি বিপদে পড়ে
গভীর খননার কারণে বর্ষাকালে নদী অতিরিক্ত স্রোতে ভাটির দিকে বন্যা তৈরি করে।
মাছের ডিম নষ্ট
পাখির আবাসস্থল নষ্ট
নদীজ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত
নদীর তলদেশ গভীর হওয়ায় কাছের কুয়ার পানি শুকিয়ে যেতে পারে।
এ সকল কারণে অজয় নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে।
অবৈধ খননের সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ মানুষ।
নদীর পাড় এতটাই নরম হয়ে যায় যে—
দেয়ালে ফাটল
মাটির ঘর ধসে পড়া
একাধিক পরিবার গৃহহীন
বালিতে ঢেকে—
ফসল নষ্ট
জমি অনুর্বর
কৃষকের আর্থিক ক্ষতি
ট্রাকে ভরা রাস্তা—
ধুলোর দূষণ
রাস্তায় গর্ত
দুর্ঘটনার ঝুঁকি
বালি মাফিয়া এখন একটি সংগঠিত চক্র। এদের রয়েছে—
আধুনিক খনন যন্ত্র
শত শত ট্রাক
প্রভাবশালী রাজনৈতিক সমর্থন
অবৈধ টোল সংগ্রহকারী বাহিনী
লাঠিয়াল ও ভাড়াটে দুষ্কৃতী
রাতে বা ভোরে খনন
নদীর তলদেশ থেকে দ্রুত বালি তোলা
নদীপাড়ে সাময়িক ডাম্পিং
ট্রাকে লোড করে পাচার
বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থায় বিক্রি
এটা একটি বহু-কোটি টাকার ব্যবসা, যা স্থানীয় প্রশাসন প্রভাবিত করতে সক্ষম।
অবৈধ বালি তোলায় রাষ্ট্রের ক্ষতি—
রাজস্ব হারানো
বৈধ বালি খাদ ব্যবসার ক্ষতি
পরিবেশ রক্ষায় অতিরিক্ত সরকারি ব্যয়
পাড় ভাঙন ঠেকাতে কোটি কোটি টাকা প্রয়োজন
কৃষকের আর্থিক দেউলিয়াত্ব
রাস্তা ও বাড়ি মেরামতে অতিরিক্ত ব্যয়
মাছ ধরা ও নৌযান বন্ধ হয়ে যাওয়া
স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষত ধুলোর কারণে শ্বাসকষ্ট
যে কারণগুলো প্রশাসনকে অকার্যকর করে তোলে—
সময়মতো অভিযান না হওয়া
অভিযানের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়া
নিম্ন স্তরের কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি
আইনের দুর্বলতা
রাজনৈতিক প্রভাব
বৈধ বালি খাদ পর্যাপ্ত না হওয়া
অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামবাসীর অভিযোগ লিপিবদ্ধ হলেও কোনও বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায় না।
অবৈধ খননে জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালত দ্রুত শাস্তি দিলে মাফিয়াদের দাপট কমবে।
আজকাল প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। ড্রোন নজরদারি করলে অনেক অনিয়ম ধরা পড়বে।
চাহিদা যতক্ষণ বেশি, ততক্ষণ অবৈধ খনন চলবে। সুতরাং বৈধ খাদগুলোকে আধুনিক করতে হবে।
নদী রক্ষা কমিটি গঠন করা গেলে স্থানীয় মানুষও নজরদারিতে যুক্ত হতে পারবেন।
নদীপথ স্থিতিশীল করতে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্প প্রয়োজন।
অজয় নদী বহু মানুষের স্মৃতি, সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবনের অংশ। নদীর পাড়ে উৎসব, মেলা, চাষাবাদ, মাছ ধরা, সমবায়ী কাজ—সবই নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
নদী শুকিয়ে গেলে, ভেঙে গেলে বা দূষিত হলে—
একটি সভ্যতাই হারিয়ে যায়।
অজয় নদীতে অবৈধ বালি তোলার দাপট প্রতিদিনই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, আর এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে নদীর স্বাভাবিক অস্তিত্ব ও আশপাশের মানুষের জীবনে। বালি মাফিয়ারা নিয়ম-আইনকে উপেক্ষা করে রাতদিন ভারী যান্ত্রিক খনন চালিয়ে নদীর তলদেশকে অস্বাভাবিকভাবে গভীর করে তুলছে। এর ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, নদীর পাড় ভেঙে পড়ছে, গ্রামবাসীদের বাড়িঘরে ফাটল ধরছে এবং কৃষিজমি বালিতে ঢেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবিদরা বারবার সতর্ক করে বলেছেন—এই ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকলে অজয় নদী ভবিষ্যতে তার স্বাভাবিক রূপ ও জলধারা হারাতে পারে, যা শুধু পরিবেশের ক্ষতিই করবে না, বরং পুরো অঞ্চলে মানবিক সঙ্কট তৈরি করবে।
গ্রামবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসে বলছেন—“নদী বাঁচাও, জীবন বাঁচাও।” তাদের দাবি, প্রশাসন যেন দ্রুত কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে বালি মাফিয়াদের দাপট বন্ধ করে। কিন্তু নিয়মিত নজরদারি ও কার্যকরী পদক্ষেপের অভাবে সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। এখন যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী দিনে অজয় নদীর ক্ষতি এমন স্তরে পৌঁছাতে পারে, যেখানে আর পুনরুদ্ধারের কোনও পথ খোলা থাকবে না।