মার্কাস র‍্যাশফোর্ডের ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন বার্সেলোনার ক্রীড়া পরিচালক ডেকো। তাঁর মতে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে র‍্যাশফোর্ড যেভাবে সংগ্রামের মুখে পড়েছিলেন, তার মূল কারণ ছিল ক্লাবের অস্থির পরিবেশ, ধারাবাহিক ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন এবং দলে সঠিক ভূমিকা না পাওয়া। ডেকো বলেন, র‍্যাশফোর্ড সবসময়ই প্রতিভাবান ফুটবলার, কিন্তু ইউনাইটেডে তাঁর আত্মবিশ্বাস বারংবার আঘাত পেয়েছিল, যার ফলে মাঠের পারফরম্যান্সেও প্রভাব পড়ে। বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। ডেকোর ভাষায়, এখানে র‍্যাশফোর্ডকে নির্দিষ্ট ভূমিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁর শক্তির জায়গাগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাকে মানসিকভাবে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। বার্সার আক্রমণভাগে র‍্যাশফোর্ড নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারছেন, যার ফলে তাঁর গতি, দক্ষতা এবং গোল করার ক্ষমতা আবারও জ্বলে উঠছে। ডেকো আরও জানান, বার্সেলোনার সামগ্রিক খেলার দর্শন র‍্যাশফোর্ডের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে। দলীয় বোঝাপড়া, স্থির পরিকল্পনা এবং কোচিং স্টাফের বিশ্বাস তাঁকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। ফলে ইউনাইটেডে ক্লান্ত ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত র‍্যাশফোর্ড এখন বার্সেলোনায় হয়ে উঠেছেন এক দুর্দান্ত, ধারালো ও ঝলমলে ফরোয়ার্ড। র‍্যাশফোর্ডের এই রূপান্তর ফুটবলবিশ্বে বড় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
ডেকোর মতে, র্যাশফোর্ডের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাঁর চারপাশের অস্থির পরিবেশ। ইউনাইটেডে গত কয়েক বছরে ম্যানেজার পরিবর্তন হয়েছে বারবার—জোসে মরিনহো, ওলে গানার সোলশায়ের, রাল্ফ রাংনিক থেকে এরিক টেন হাগ—প্রতিটি কোচের দর্শনই ছিল আলাদা। ফলে র্যাশফোর্ডকে কখনো উইঙ্গার, কখনো স্ট্রাইকার, আবার কখনো এমন একটি ‘ফ্লোটিং রোল’-এ খেলানো হতো যে যেখানে তাঁর নিজের শক্তির জায়গাগুলো ব্যবহার করা যেত না।
ডেকোর মন্তব্যের মূল সুরটি ছিল: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গত পাঁচ বছর ধরে দল পুনর্গঠনে হিমশিম খেয়েছে, এবং এমন এক অস্থির সময়ে একজন তরুণ খেলোয়াড়ের উপর অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা চাপানো হয়েছিল।
ডেকো বলেন, "র্যাশফোর্ডের মধ্যে সবসময়ই স্কিল ছিল। কিন্তু তাঁকে সঠিক ভূমিকা ও স্থিরতা দেওয়া হয়নি। প্রতিটি ম্যাচে তাঁর দায়িত্ব বদলানো হতো—এতে একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে পারে না।"
ট্রান্সফারমার্কেটের তথ্য অনুযায়ী, ইউনাইটেডে র্যাশফোর্ড লেফট উইঙ্গার (LW), সেন্টার ফরোয়ার্ড (CF), এবং রাইট উইঙ্গার (RW)—এই তিনটি প্রধান ভূমিকায় খেলেছেন। এর মধ্যে LW হিসেবেই তিনি সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেললেও, CF এবং RW-এর মধ্যে ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন তাঁকে তাঁর সেরা ছন্দে পৌঁছাতে দেয়নি।
ইউনাইটেডে জটিল ভূমিকা: কখনো তাঁকে গভীর থেকে বল আনা, কখনো ডানদিকে কাট-ইন করা, কখনো আবার কেন্দ্রের মধ্যে পিভট প্লে করার মতো জটিল ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
শক্তিকে কাজে লাগানোর অভাব: অথচ তাঁর শক্তির জায়গা ছিল তৈরি জায়গায় দৌড়, ফাঁক গলিয়ে ঢোকা, এবং ডিফেন্ডারদের ওয়ান-অন-ওয়ান মোকাবিলা করা। এই ধরনের খেলা কৌশলগত অস্থিরতার কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দীর্ঘ সময় ধরে ট্রফিবিহীন। এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি খেলোয়াড়ই ভয়ঙ্কর চাপের মুখে থাকে—বিশেষত র্যাশফোর্ডের মতো হোমগ্রোন খেলোয়াড়রা। মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রথম দলের দায়িত্ব পাওয়ার পর, তিনি ক্লাবের মুখ হয়ে ওঠেন।
ডেকো এ বিষয়ে বলেছেন—
“ইউনাইটেডে র্যাশফোর্ড মানসিকভাবে সবসময় চাপের মধ্যে ছিল। বার্সেলোনায় আমরা তাঁকে সেই চাপ থেকে মুক্ত করেছি। এখানে তাঁর ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানো হয় না। আমরা চাই সে স্বাভাবিক খেলুক।”
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ক্লাবের পুনর্গঠনের দায়িত্ব যখন একজন তরুণ খেলোয়াড়ের কাঁধে চাপে, তখন সেই মানসিক চাপ তাঁর পারফরম্যান্সের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইংরেজ মিডিয়ার সমালোচনা, সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল, আর ক্লাবের ভেতরের প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, যা তাঁর শারীরিক ভাষার মধ্যেও স্পষ্ট ছিল।
র্যাশফোর্ডের গতি, রান, বডি স্ট্রেংথ—এসব কাজে লাগিয়ে তাঁকে 'ট্রান্সিশন ফুটবলে' খেলা উচিত ছিল, যেখানে দ্রুত আক্রমণ গড়ে তোলা যায়। কিন্তু ইউনাইটেডে অনেক সময় টিম প্রেশার-ভিত্তিক ফর্মেশনে খেলার চেষ্টা করত, যেখানে র্যাশফোর্ডকে রক্ষণে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হতো। এর ফলে তাঁর প্রাকৃতিক আক্রমণাত্মক খেলাটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়।
বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর তাঁর জীবন বদলে গেছে বলেই মনে করেন ডেকো। এই পরিবর্তনের পেছনে মূল কারণগুলি হলো: সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পরিকল্পনা এবং মানসিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।
বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর তাঁর ভূমিকা খুব স্পষ্ট। ডেকো জানাচ্ছেন—
“আমরা র্যাশফোর্ডকে জানাই, তার জায়গা বাঁ-দিকের আক্রমণে। এখানেই সে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, এখানেই তার গতি ও ড্রিবলিং সবচেয়ে কার্যকর।”
বার্সেলোনার কৌশলগত মানচিত্রে র্যাশফোর্ডের দায়িত্ব:
বামদিক থেকে ভেতরে ঢোকা (Cutting Inside)
দ্রুত আক্রমণ গড়া (Spearheading Attacks)
ডিফেন্ডারকে হারিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি (Goal Creation)
দলের ট্রান্সিশনের সময় ফাঁক তৈরির কাজ (Creating Space for Teammates)
এই নির্দিষ্ট রোল তাঁকে আবার আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। কোনো ম্যাচেই তাঁর অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা থাকছে না, যা তাঁকে সম্পূর্ণ মনোযোগ আক্রমণে দিতে সাহায্য করছে।
ডেকো বলেন, "আমরা তাকে বলেছি, ভুল করলে সমস্যা নেই। তুমি নিজের ন্যাচারাল খেলা খেলো। তুমি স্বাধীন।" এই কথাটি একজন খেলোয়াড়ের মানসিকতায় বিশাল প্রভাব ফেলে। বার্সেলোনা কোচিং স্টাফের এই নিঃশর্ত আস্থা র্যাশফোর্ডকে তাঁর খেলা উপভোগ করতে সাহায্য করছে। ইউনাইটেডে যেখানে তাঁকে প্রতিটি ভুলের জন্য সমালোচিত হতে হতো, বার্সায় সেখানে তাঁকে সাহস যোগানো হচ্ছে। এই মানসিক স্বাধীনতা তাঁকে ঝুঁকি নিতে এবং তাঁর ড্রিবলিং ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করেছে।
বার্সেলোনার তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সঙ্গে র্যাশফোর্ডের বোঝাপড়া খুব দ্রুতই তৈরি হয়েছে। বালদে, পেদ্রি, গাভি, লামিন ইয়ামাল—এই খেলোয়াড়েরা ছোট পাসে এবং দ্রুত গতিতে আক্রমণে বিশ্বাসী। মধ্যমাঠে পেদ্রি বল এগিয়ে দিলে র্যাশফোর্ড পিছন থেকে তাঁর প্রাকৃতিক গতিতে দৌড় শুরু করে।
দ্রুত বল সরবরাহ: বার্সার মিডফিল্ড র্যাশফোর্ডের জন্য বলের দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করে, যা ইউনাইটেডে প্রায়শই অনুপস্থিত ছিল।
সম্মিলিত আক্রমণ: দল হিসেবে বার্সা আক্রমণে ওঠায়, র্যাশফোর্ডের উপর থেকে ‘একাই সবকিছু করার’ চাপ কমেছে।
ইউনাইটেডের খেলা ছিল কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো কাউন্টার-অ্যাটাক সর্বস্ব। কিন্তু বার্সেলোনা সবসময় বল ধরে রাখা (Ball-Possession), ছোট ছোট পাসে ডিফেন্স ভাঙা, এবং শেষ তৃতীয়াংশে আক্রমণ সাজিয়ে সুযোগ তৈরি করার উপর জোর দেয়। এই ধরণের ফুটবল র্যাশফোর্ডকে আরও বেশি বলের কাছাকাছি রাখে। ফলে তিনি আগের মতোই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
পরিসংখ্যানই এই পরিবর্তনের সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ। ট্রান্সফারমার্কেটের তথ্য অনুযায়ী:
| পরিসংখ্যান | ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (৪২৬ ম্যাচ) | বার্সেলোনা (১৮ ম্যাচ) | তুলনা (প্রতি ৯০ মিনিট) |
| গোল ও অ্যাসিস্ট (মোট) | ১৩৮ + ৭৮ = ২১০ | ৬ + ৯ = ১৫ | N/A |
| গোল/অ্যাসিস্ট প্রতি ৯০ মিনিট | $approx ০.৪৮$ | $approx ০.৮৩$ | বার্সায় প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি |
| গোল/অ্যাসিস্ট প্রতি ম্যাচ | $approx ০.৪৯$ | $approx ০.৮৩$ | N/A |
| বার্সার লা লিগায় উপস্থিতি | N/A | ১৩ ম্যাচ (২ গোল, ৭ অ্যাসিস্ট) | N/A |
বার্সেলোনায় মাত্র ১৮টি খেলায় ১৫টি গোল বা গোলে সহায়তা (Goal Contributions) ইঙ্গিত দেয় যে তাঁর আউটপুট ইউনাইটেডের তুলনায় অনেক বেশি ধারাবাহিক এবং কার্যকরী হয়েছে।
ডেকোর মন্তব্য অনুযায়ী, “র্যাশফোর্ড এখন আবার সেই খেলোয়াড়, যাকে ইউরোপ ভয় পেত।” র্যাশফোর্ডের গোল করার ধার এবং অ্যাসিস্টের সংখ্যায় এই পরিবর্তন স্পষ্ট। লা লিগায় ১৩ ম্যাচে ২ গোল ও ৭ অ্যাসিস্ট—এই পরিসংখ্যান বার্সার দলের সঙ্গে তাঁর দ্রুত মানিয়ে নেওয়া এবং ফর্মে ফেরার প্রমাণ।
ডেকো স্পষ্ট বলেছেন—
“একজন খেলোয়াড়ের প্রতিভা থাকলে তাকে সঠিক প্ল্যাটফর্ম দিতে হয়। র্যাশফোর্ড এখানে সেই প্ল্যাটফর্মই পেয়েছে।”
তিনি তিনটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, যা র্যাশফোর্ডের পুনর্জন্মের মূল চাবিকাঠি:
বার্সা বছর বছর পরিকল্পনা বদলায় না। দর্শন একই থাকে: পজেশনাল ফুটবল এবং আক্রমণাত্মক মানসিকতা। এই স্থির কৌশলগত পরিবেশ র্যাশফোর্ডকে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে এবং নিজের খেলার উপর মনঃসংযোগ করতে সাহায্য করেছে।
খেলোয়াড়ের মানসিক সুস্থতা বার্সেলোনায় খুব গুরুত্ব পায়। র্যাশফোর্ডকে 'দায়িত্বের অতিরিক্ত বোঝা' থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা তাঁকে একজন তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে ইউনাইটেডে বারবার ভুগিয়েছে। এই মানসিক সমর্থন তাঁকে আবার হাসতে ও স্বাভাবিক খেলতে সাহায্য করেছে।
বল-পজিশন, আক্রমণাত্মক ফুটবল এবং প্রতিভাকে স্বাধীনতা দেওয়া—এই তিনটি মিলেই র্যাশফোর্ডের মতো খেলোয়াড়েরা ফুলে ফেঁপে ওঠেন। বার্সার স্টাইল তাঁর গতি এবং ওয়ান-অন-ওয়ান ড্রিবলিংয়ের জন্য আদর্শ।
আজ র্যাশফোর্ড শুধুই একজন ফুটবলার নন; তিনি নিজের হারানো আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। তাঁর ক্যারিয়ার যেন প্রমাণ করে—পরিবেশ বদলালে, একজন ফুটবলারের জীবনও বদলে যেতে পারে। ডেকোর বক্তব্য তা আরও একবার স্পষ্ট করে দেয়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তিনি সংগ্রাম করলেও, বার্সেলোনায় তিনি আবার আলোর মত উজ্জ্বল। তাঁর গতি, গোল করার ধার, আক্রমণভাগে হুমকি সৃষ্টি—সবই আবার ফিরে এসেছে পূর্ণ রূপে।