হায়দরাবাদ থেকে কলকাতা এবং দিল্লি থেকে মুম্বই সহ দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে টার্মিনালে যাত্রীদের ব্যাগপত্র স্যুটকেস জমা হয়ে থাকছে অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে টার্মিনালের মেঝেতে রাত কাটাচ্ছেন ইন্ডিগোর বাতিল বিমান পরিষেবা যাত্রীদের চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে
দ্বিতীয় দিনেও ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরল না এবং দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে যাত্রীদের অসুবিধা আরও বেড়ে গেল। বৃহস্পতিবার সারা দিনে মোট পাঁচশত পঞ্চাশটি বিমান বাতিল করেছে এই বিমানসংস্থা এবং রাত পর্যন্ত পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যাত্রীদের অভিযোগ ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য ভিডিও এবং অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায় পরিবার শিশু প্রবীণ সবাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে আটকে রয়েছেন। তাদের হাত ব্যাগ স্যুটকেস সব করে টার্মিনালের মেঝেতে পড়ে আছে এবং অনেকেই বাধ্য হয়ে সেখানেই রাত কাটাচ্ছেন।
ইন্ডিগো কর্তৃপক্ষের তরফে রাতে একটি বার্তা জারি করে অসুবিধার জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়। জানানো হয় যে পরিষেবা স্বাভাবিক করতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ উড়ান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে যাত্রীদের সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। কারণ বাতিল হওয়া বিমান সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
যাত্রীদের অভিযোগ ছিল অত্যন্ত গুরুতর। তারা জানাচ্ছেন যে তাদের যথাযথ খাবার দেওয়া হয়নি এবং কোথাও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে করতে ক্ষোভে অনেকের ধৈর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এক যাত্রী জানান তিনি বারো ঘণ্টা ধরে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন কিন্তু সংস্থার কর্মীরা সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। উড়ান কখন ছাড়বে সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে যাত্রীদের একাংশ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং ইন্ডিগোর বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে শুরু করেন।
দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে একই ছবি দেখা গেল। হায়দরাবাদ থেকে কলকাতা দিল্লি থেকে মুম্বই সহ বিভিন্ন শহরের বিমানবন্দরে টার্মিনাল ব্যাগপত্রে ভরে ওঠে এবং বহু যাত্রীকে বসতে বা শুতে জায়গা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই বাধ্য হয়ে মেঝেতে শুয়ে রাত কাটান এবং কেউ কেউ পানীয় জল ও খাবার না পাওয়ায় আরও বিপদের মুখে পড়েন।
বৃহস্পতিবার ইন্ডিগো বহু আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল করে এবং শুধু দিল্লি বিমানবন্দরে বাতিল হওয়া উড়ানের সংখ্যা ছিল একশত বাহাত্তর। মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুতে বাতিল সংখ্যা যথাক্রমে একশত এবং পচাত্তর। এই সংখ্যা এতটাই বড় যে বিমান পরিচালনা বিভাগ পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করে। বেঙ্গালুরু মুম্বই দিল্লি কলকাতা সহ সব বিমানবন্দরে সার্বিক অব্যবস্থা দেখা যায় এবং যাত্রীদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
বেসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের নজরে বিষয়টি যায় এবং বিমানমন্ত্রী রামমোহন নায়ডু বিমান মন্ত্রকের আধিকারিক এবং ইন্ডিগোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। ইন্ডিগো কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে জানায় যে তাদের পরিষেবা পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে দশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিতে হবে কারণ বর্তমানে তারা নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
ইন্ডিগো জানিয়েছে তাদের পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার মূল কারণ হল প্রযুক্তিগত ত্রুটি শীতকালীন সময়সূচির পরিবর্তন প্রতিকূল আবহাওয়া বিমান চলাচলে বাড়তি যানজট এবং ক্রু সদস্যদের কাজের সংশোধিত সময়সীমা। নতুন নিয়ম অনুযায়ী পাইলট এবং কেবিন ক্রু দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবেন না সপ্তাহে পঁয়ত্রিশ ঘণ্টা মাসে একশত পঁচিশ ঘণ্টা এবং বছরে সর্বোচ্চ এক হাজার ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন। এই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়ার পর থেকেই ইন্ডিগোর ক্রু সংখ্যা কমে যায় যার ফলে অনেক উড়ান চালানো সম্ভব হয়নি।
ইন্ডিগো সূত্রে জানা যায় যে ক্রু সদস্যদের ঘাটতির কারণে অনেক উড়ান বাতিল করা ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ পাইলট এবং কেবিন ক্রু না থাকলে বিমান চালানো যায় না। তার উপর যাত্রী সংখ্যা বাড়ায় অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে কর্তব্যরত কর্মীদের এবং এতে অসুবিধা আরও বাড়ছে। কখনও কখনও টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিচ্ছে আবার কখনও উড়ানের সময়সূচি পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
মাত্র একদিন আগে বুধবারও ইন্ডিগোর দুই শতাধিক উড়ান বাতিল হয়েছিল যার জেরে দিল্লি মুম্বই বেঙ্গালুরু সহ বিভিন্ন বিমানবন্দরে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। নভেম্বর মাসে মোট বারোশত বত্রিশটি উড়ান বাতিল করেছে এই সংস্থা এবং পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে অনেক যাত্রী ইন্ডিগোর টিকিট বাতিল করে অন্য বিমানসংস্থার শরণাপন্ন হচ্ছেন এবং অনেকেই মনে করছেন যে তাতে টিকিটের দাম আরও বেড়ে যাবে।
এই পরিস্থিতিতে যাত্রীদের আর্থিক ক্ষতি মানসিক চাপ এবং শারীরিক ক্লান্তি সবই বাড়ছে। কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সভা পরীক্ষা কিংবা চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে অন্য শহরে যাচ্ছিলেন তাঁদের যাত্রা ব্যাহত হওয়ায় অনেকের পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে একইদিনে একাধিকবার সময় পরিবর্তনের বার্তা পাঠানো হয়েছে যার ফলে তারা আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
বিমানসংস্থার কর্মীরা নিজেরাও চাপে রয়েছেন কারণ বিপুল যাত্রী ভিড়ের মধ্যে সঠিক পরিষেবা দেওয়া এবং সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যাত্রীরা জানাচ্ছেন যে কাউন্টারে গিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না অ্যাপ আপডেট হচ্ছে না এবং ঘোষণাও সব সময়ে ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
ভারতের বিমান পরিবহণ খাতে এটি এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এত অল্প সময়ে এত সংখ্যক উড়ান বাতিল হওয়া সচরাচর দেখা যায় না। সাধারণত কিছু উড়ান টেকনিক্যাল সমস্যা আবহাওয়া কিংবা ভিড়ের কারণে দেরি হয় বা বাতিল হয় কিন্তু একসঙ্গে পাঁচশো পঞ্চাশটি উড়ান বাতিল হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এই সংকটের ফলে দেশের বিমান পরিষেবার প্রতি যাত্রীদের আস্থা কিছুটা হলেও নড়ে গিয়েছে। যাত্রীরা মনে করছেন যে বিমানসংস্থাগুলিকে যাত্রীদের সুবিধা এবং নিরাপত্তার দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে পরিকাঠামো উন্নত করা এবং ক্রু সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ যাত্রী ভিড় বাড়ছে এবং বিমান পরিষেবাও প্রতিদিন আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।
ইন্ডিগোর বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের পরিস্থিতি না তৈরি হয় সেজন্য কেন্দ্র সরকার বিমানসংস্থা এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। ডিজিসিএ ইতিমধ্যেই নির্দেশিকা জারি করেছে যেন যাত্রীদের যথাযথ তথ্য দেওয়া হয় এবং কোনও অব্যবস্থা হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
অন্যদিকে যাত্রীরা আশা করছেন যে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং বাতিল হওয়া উড়ানগুলি পুনরায় চালু করা হবে। যাত্রী সংখ্যার চাপ এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটির মধ্যেও বিমান চলাচল নিশ্চিত করতে ইন্ডিগোকে আরও শক্তিশালী পরিকল্পনা করতে হবে। বিমানসংস্থা জানিয়েছে যে তারা চেষ্টা করছে যাত্রীদের সুস্থ নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক ভ্রমণ নিশ্চিত করতে। তবে এই মুহূর্তে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা যাত্রীদের আতঙ্ক দুঃখ এবং ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীয় বিমান পরিবহণ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে দেশে বিমান পরিষেবার উপর ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতে আরও সুসংগঠিত পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী পরিকাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিদিন যাত্রী সংখ্যা বাড়ছে নতুন রুট শুরু হচ্ছে বিমান সংস্থার বহর বাড়ছে কিন্তু সেই তুলনায় পরিকাঠামো উন্নয়ন বিশেষ গতিতে এগোচ্ছে না। এর ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা সাচ্ছন্দ্য এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বারবার ভেঙে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক উড়ান বাতিল হওয়া দেরি হওয়া এবং পরিষেবা সংক্রান্ত বিশৃঙ্খলা এমন সব ঘটনা দেখিয়েছে যে বিমান পরিচালনা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে আটকে থাকছেন প্রয়োজনীয় তথ্য পাচ্ছেন না এবং বহু ক্ষেত্রে খাবার জল বিশ্রাম এর মতো প্রাথমিক সুবিধাও পাচ্ছেন না। দেশের বিমান সংস্থাগুলিকে যাত্রীদের অভিজ্ঞতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে যাতে উড়ান পরিচালনা আরও প্রযুক্তিনির্ভর এবং সুসংহত হয়। একই সঙ্গে সরকারকে এই খাতে তদারকি কঠোর করতে হবে যাতে বিমান সংস্থাগুলি নিয়ম মেনে চলে এবং যাত্রী স্বার্থ রক্ষা হয়। পরিকল্পনার অভাব এবং জনবল সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে ভবিষ্যতে বিমান ভ্রমণ আরও জটিল অনিশ্চিত এবং অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নীতি যা বিমান পরিষেবাকে আবার স্থিতিশীল নির্ভরযোগ্য এবং যাত্রীবান্ধব করে তুলবে।