লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের কাছে আকস্মিক বিস্ফোরণে মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তীব্র কম্পন ও ধোঁয়ায় ঢেকে যায় স্টেশন এলাকা যাত্রীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় হুড়োহুড়ি ঘটনায় দ্রুত নিরাপত্তা বাহিনী পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে
লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠা সকাল: আতঙ্ক, অনুসন্ধান ও শহরের শ্বাসরুদ্ধ অপেক্ষা
পুরো দিল্লির সকালটা সেদিন ছিল অন্য দিনের মতোই। শীতের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো নভেম্বর মাসের ঘন কুয়াশা শহরটাকে ঢেকে রেখেছিল। পুরনো দিল্লির সরু রাস্তা, দোকানদারদের চা তৈরি করার শব্দ, স্কুলের ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চারা সবই যেন স্বাভাবিক ছন্দে চলছিল। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সাতটা বেজে বত্রিশ মিনিট ছুঁতেই সেই ছন্দ এক মুহূর্তে ছিঁড়ে যায়।
লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের ভেতরে সেই সময় ছিল অফিসগামী মানুষের ভিড়। লালকেল্লা, চাঁদনি চৌকের মতো ব্যস্ত অঞ্চলের সংযোগ হওয়ায় এখানে নাগরিকদের ভিড় প্রতিদিনই বেশি। সকালের কর্মব্যস্ততা, রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা টোকেন অভিভাবকদের হাতে ধরা বাচ্চারা সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। কেউই জানত না যে এক মূহূর্তের মধ্যেই তারা এমন এক দৃশ্যের সাক্ষী হতে চলেছেন, যা পরবর্তী কয়েক ঘন্টা নয় পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে তাদের মনে গভীর আতঙ্কের ছাপ ফেলে যাবে
হঠাৎ সেই গর্জন
মেট্রোর প্ল্যাটফর্ম নম্বর ২ এ দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কিছু যাত্রী তখন ট্রেনের আগমনের ঘোষণা শোনার অপেক্ষায়। লাউডস্পিকারে মেট্রো কর্তৃপক্ষের সাধারণ নির্দেশনা ভেসে আসছিল Mind the gap Stay behind the yellow line
ঠিক সেই সময়েই ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি
প্রথমে শোনা যায় একটি অস্বাভাবিক ধাতব ঘর্ষণের শব্দ, এরপর মাত্র আধ সেকেন্ডের মধ্যে সেই শব্দকে ছাপিয়ে যায় এক প্রচণ্ড গর্জনধ্বনি সেটি এত প্রবল ছিল যে স্টেশনের কংক্রিটের ছাদ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। কয়েকজন যাত্রী প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো ট্রেনের ব্রেক বা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কোনও সমস্যা। কিন্তু পরবর্তী মুহূর্তেই পরিস্থিতি পরিষ্কার এটা কোনও সাধারণ প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি বিস্ফোরণ।
গর্জনের সাথে সাথে প্ল্যাটফর্মের ওই অংশটিতে দেখা যায় ঘন ধোঁয়া। আলো কমে এসে জায়গাটা যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্ধকার হয়ে যায় ধুলো কণিকা ভাঙা ইট সিমেন্টের টুকরো বাতাসে উড়তে শুরু করে আর তারপরই শুরু হয় প্রকৃত আতঙ্ক।
আতঙ্কে ছুটোছুটি
বিস্ফোরণের শব্দ থেমে যায় কিন্তু আতঙ্ক থামে না ভিড়ের মানুষের চিৎকারে স্টেশন মুহূর্তে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে
মহিলারা চেঁচাতে থাকেন শিশুদের কান্না শুরু হয় কেউ দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কেউ হঠাৎ পড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে তুলে ধরতে চেষ্টা করে
কিছু যাত্রী বিস্ফোরণের সঠিক উৎস বুঝতে না পেরে ভাবেন এটি হয়তো মেট্রোর ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ বা তারে শর্ট সার্কিট অনেকে আবার ভেবেছিলেন এটা কি কোনও সন্ত্রাসী হামলা ওই অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও পর্যটকসমাগমের কথা মাথায় রাখলে আতঙ্ক আরও বাড়া স্বাভাবিক
যারা প্ল্যাটফর্মের কাছে ছিলেন তারা ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেন এক্সিট গেটের দিকে কিন্তু ধোঁয়ায় দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় অনেকেই বিপরীত দিকে ছুটে যান রেলিং ধরে একজন বৃদ্ধা মহিলা টলতে টলতে বেরোনোর চেষ্টা করছেন আরেকদিকে দুই কলেজ পড়ুয়া একে অপরের হাত ধরে দৌড়াচ্ছেন মনে হচ্ছিল মুহূর্তটা যেন বাস্তব নয়।
স্টেশনের ভেতরের অবস্থার দ্রুত অবনতি
বিস্ফোরণের প্রভাবে স্টেশনের নির্দিষ্ট সেকশনে বিদ্যুৎ সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে লাইট ফ্লিকার করতে থাকায় আতঙ্ক আরও বাড়ে। এয়ার সার্কুলেশন সিস্টেম কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিঘ্নিত হওয়ায় ধোঁয়া ঘনীভূত হয়ে ওঠে এবং যাত্রীরা শ্বাসকষ্টের অভিযোগ করতে থাকেন
মেট্রো স্টাফরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন, কিন্তু প্রথম কিছু মিনিট পরিস্থিতি তারা নিজেরাও বুঝতে পারেননি মেট্রো পুলিশের কয়েকজন কর্মী দ্রুত প্ল্যাটফর্ম ২ এর দিকে দৌড়ে যান, আর অন্যরা মাইকের মাধ্যমে ঘোষণা করেন
দয়া করে শান্ত থাকুন। ধীরে ধীরে এক্সিট গেটের দিকে যান কোনও অবস্থাতেই দৌড়াবেন না
কিন্তু পরিস্থিতি তখন দৌড় প্রতিরোধ করার মতো ছিল না। আতঙ্ক গ্রাস করেছিল সবাইকে ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন পড়ে যান অনেকে ব্যাগ হারান, কিছু বাচ্চা বাবা মায়ের হাত থেকে ছিটকে যায় সব মিলিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য দৃশ্যটা হয়ে ওঠে একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন।
বাইরের পরিস্থিতি ও প্রথম প্রতিক্রিয়া
বিস্ফোরণের কম্পন স্টেশন ভবনের বাইরে পর্যন্ত অনুভূত হয়। লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের ঠিক বাইরে যে ভিড় রাস্তার বিক্রেতা, ট্যাক্সি, অটো, পর্যটক সবাই হঠাৎ থমকে যান। অনেকেই ভেবেছিলেন ভূমিকম্প হয়েছে কিছু দোকানদার তো আতঙ্কে দোকানের শাটার নামিয়ে ফেলেন
মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ সিআইএসএফ এবং ফায়ার সার্ভিস সেখানে পৌঁছে যায়। আশপাশের রাস্তা ঘিরে ফেলে ব্যারিকেড মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষকে সরে যেতে বলা হয়
ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ভিতরে ঢুকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে শুরু করে। ধোঁয়া বের করার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভেন্টিলেটর চালানো হয়। মেডিক্যাল টিম আহতদের বের করে আনতে শুরু করে। কয়েকজনকে অক্সিজেন দেওয়া হয়, কয়েকজনকে সাইটে প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়।
বিস্ফোরণের উৎস নিয়ে জল্পনা
ঘটনার কিছুক্ষণ পরে তদন্তকারী দল স্টেশনের সেই সেকশনে পৌঁছে যায় যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেখানে দেখা যায় মাটিতে একটি বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙে গেছে সিসিটিভিতে দেখা যায় বিস্ফোরণের আগে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আগুনের ছোট একটি ঝলক
তদন্তকারীরা সন্দেহ করতে থাকেন
এটি কি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির বিস্ফোরণ
নাকি কোনও তাপীয় চাপের ফলে পাইপ বিস্ফোরণ
নাকি কারও অসতর্কতার কারণে পড়ে থাকা দাহ্য পদার্থে আগুন লেগেছিল
অথবা, আরও ভয়ঙ্কর এটি কি কোনও পরিকল্পিত বিস্ফোরক ডিভাইস
প্রথম দুই ঘন্টা এই সবকিছুই ছিল অনুমান। কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছিল না
সাক্ষী যাত্রীদের বয়ান
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে নানা তথ্য দেন। একজন মধ্যবয়স্ক অফিসগামী বলেন
“আমি ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ মনে হল যেন পায়ের নীচ থেকে মাটি নড়ে গেল। তারপরই দেখি আলো নিভে গেল আর ধোঁয়া ছড়াতে শুরু করল
একজন নারী যাত্রী বলেন
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মেট্রো এসে গেছে কিন্তু এরপরই চিৎকার শুনি মনে হচ্ছিল সবাই দিকভ্রান্ত হয়ে গেছে
স্টেশনের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান
“শব্দটা অস্বাভাবিক। আমাদের প্রশিক্ষণে ছোটখাটো শর্ট সার্কিট বা ট্রান্সফরমারের শব্দ শোনা হয়েছে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। আমি তখনই বুঝেছিলাম বড় কিছু হয়েছে
মেট্রো পরিষেবা বন্ধ ও শহরের প্রভাব
বিস্ফোরণের তীব্রতার কারণে পুরো রেডলাইন-এর নির্দিষ্ট অংশ বন্ধ করে দিতে হয়। হাজার হাজার মানুষ হঠাৎ আটকে পড়ে দিল্লির ট্রাফিক ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে বিকল্প রুটে বাস নামানো হয়, কিন্তু ভিড় সামলানো যায়নি
পুরনো দিল্লি অঞ্চলে বাজার খুলতে দেরি হয়। পর্যটকদের অনেকেই লালকেল্লা, চাঁদনি চৌক এলাকা এড়িয়ে চলতে শুরু করেন কিছু দোকান সারাদিনই বন্ধ থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনাটি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা পোস্ট। অনেকেই ভিডিও আপলোড করেন, কেউ কেউ আবার ভুল তথ্য ছড়াতে শুরু করে। পুলিশ কয়েকটি ভুয়ো খবর শনাক্ত করে সতর্কতা জারি করে
তদন্তে প্রাথমিক অগ্রগতি
দুপুর নাগাদ তদন্তকারী দল স্টেশনের ভেতরে একটি ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক বক্স খুঁজে পায়। সেটিকে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করে ফরেনসিক টিম। তবে বক্সের আশপাশে কিছু অংশে দাহ্য পদার্থের চিহ্ন পাওয়া যায়, যা বিস্ফোরণের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে বলে মনে করা হয়
ফরেনসিক সদস্যরা নমুনা সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেন ল্যাবে। সিসিটিভি ফুটেজ স্ক্যান করে দেখা হয় কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তি কি বিস্ফোরণের আগেই সেখানে ঘুরছিল। কয়েকজন মানুষের নড়াচড়া পরীক্ষা করা হয়, তবে প্রাথমিকভাবে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি
মানুষের মনে রয়ে যাওয়া ভয়
দুপুরের পর যখন পরিস্থিতি আংশিক নিয়ন্ত্রণে আসে, তখনও যাত্রীদের মনে আতঙ্ক কাটছিল না অনেকেই মেট্রোতে না উঠে অটো বা বাসে বাড়ি ফেরেন। কেউ কেউ আগামী সপ্তাহজুড়ে মেট্রো এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলেন আজ বেঁচে ফিরলাম কিন্তু ভয়টা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি
অন্যদিকে স্টেশন কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের আশ্বাস দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়
“বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পুরো স্টেশন পরীক্ষা করা হচ্ছে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও পরিষেবা চালু হবে না
সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক
সন্ধ্যা নাগাদ ধোঁয়া পুরোপুরি পরিষ্কার, আহতদের চিকিৎসা চলছে স্টেশনটি সিল করা হয়েছে এবং তদন্তকারীরা ধাপে ধাপে কাজ করছেন যাত্রীরা খবরের চ্যানেলে আপডেট দেখতে থাকেন এবং ধীরে ধীরে পরিস্থিতির গুরুত্ব কিছুটা কমে আসে
যদিও চূড়ান্ত কারণ তখনও প্রকাশিত হয়নি তবুও কর্তৃপক্ষ বুঝিয়ে দেয় যে আতঙ্ক ছড়ানোর মতো কিছু মেলেনি এই আশ্বাসে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পান
একটি দিনের স্মৃতি হয়ে ওঠা আতঙ্ক
যারা সেদিন বিস্ফোরণের সময় স্টেশনে ছিলেন, তাদের কারও কাছেই এটি শুধু একটি “দুর্ঘটনা” ছিল না
এটি ছিল
বিশৃঙ্খলার হঠাৎ বিস্ফোরণ
মানুষের প্রকৃত অসহায়ত্বের প্রমাণ
আর একটি মুহূর্তের মধ্যেই যে শহর বদলে যেতে পারে তার স্মৃতি
একজন যাত্রী পরে একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন
জীবনে প্রথমবার বুঝলাম ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আর ভাবছিলাম কত কাজ বাকি কিন্তু একটি শব্দেই মনে হল সব শেষ হয়ে যেতে পারত
লালকেল্লা মেট্রো স্টেশনের সেই সকাল আসলে ছিল দিল্লির সাধারণ দিনের মধ্যেই অস্বাভাবিক ভয়াবহ এবং মানুষের মনে স্থায়ী দাগ ফেলে যাওয়া একটি অধ্যায়