৯ বছরের চাকরির পর একজন কর্মী কত টাকা গ্র্যাচুইটি পাবেন, তা নির্ভর করে তার শেষ বেতন ও প্রতিষ্ঠানে কাজের সময়কাল অনুযায়ী নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট সূত্রের উপর। এই প্রতিবেদনে সহজ ভাষায় গ্র্যাচুইটির হিসাব, নিয়ম এবং প্রাপ্ত অর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
চাকরিজীবনের শেষ পর্বে যখন কেউ অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা দীর্ঘ সময় পর একটি চাকরি ছাড়ছেন, তখন মাথায় আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—গ্র্যাচুইটি (Gratuity)। এটি শুধুমাত্র একটি আর্থিক প্রাপ্তি নয়, বরং একজন কর্মীর দীর্ঘদিনের শ্রম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার স্বীকৃতি।
কিন্তু অনেকেই জানেন না—গ্র্যাচুইটি কীভাবে হিসাব করা হয়, কে পেতে পারেন, কত বছর চাকরি করলে পাওয়া যায়, এবং কী পরিমাণ কর দিতে হয়।
এই প্রতিবেদনে আপনি জানতে পারবেন:
গ্র্যাচুইটি কী
কারা পেতে পারেন
৯ বছরের চাকরির পর কত টাকা পাওয়া যায়
হিসাব করার নিয়ম ও সূত্র
কর সংক্রান্ত বিষয়
সরকারি ও বেসরকারি চাকরির পার্থক্য
চাকরি ছাড়ার সময় কী কী কাগজপত্র লাগবে
প্রাসঙ্গিক আইন ও সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় গ্র্যাচুইটির গুরুত্ব
গ্র্যাচুইটি হল একটি আর্থিক সুবিধা যা কোনও প্রতিষ্ঠান তার কর্মচারীকে একটি নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত ৫ বছর বা তার বেশি) কাজ করার পর দেয়। এটি শ্রমিক বা কর্মীর নিষ্ঠা ও সেবার পুরস্কারস্বরূপ।
গ্র্যাচুইটি পেমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭২ অনুসারে এই সুবিধা সংরক্ষিত থাকে। এটি সরকারের অধীনস্ত সংস্থা এবং ১০ বা ততোধিক কর্মচারীযুক্ত বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ভারতের Payment of Gratuity Act, 1972 অনুসারে, ১০ বা ততোধিক কর্মচারীসম্পন্ন কোনও বেসরকারি সংস্থায় যদি কেউ ধারাবাহিকভাবে ৫ বছর বা তার বেশি সময় কাজ করেন, তবে তিনি গ্র্যাচুইটির জন্য যোগ্য হন।
সরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে গ্র্যাচুইটি পাওয়ার নিয়ম আরও বেশি অনুকূল।
কোনও কর্মচারীকে গ্র্যাচুইটি পেতে হলে নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে:
একই প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৫ বছর কাজ করতে হবে (সামান্য ব্যতিক্রম সহ)
কর্মচারীকে পূর্ণ সময়ের ভিত্তিতে নিযুক্ত থাকতে হবে
চাকরি ছাড়ার কারণ হতে পারে অবসর, পদত্যাগ, চাকরিচ্যুতি (নির্দিষ্ট শর্তে), বা মৃত্যু
যদি কর্মীর মৃত্যু হয় বা দুর্ঘটনার কারণে তিনি স্থায়ীভাবে অক্ষম হন, তাহলে ৫ বছরের নিয়ম শিথিল হয়। সেক্ষেত্রে মনোনীত ব্যক্তি বা পরিবার গ্র্যাচুইটি পেতে পারেন।
গ্র্যাচুইটি নির্ধারিত হয় একটি নির্দিষ্ট সূত্র অনুযায়ী। সূত্রটি হলো:
(সর্বশেষ মূল বেতন + ডিএ) × চাকরির বছর × 15 ÷ 26
মূল বেতন + ডিএ (Dearness Allowance): শেষ মাসের হিসাবে ধরা হয়
১৫ দিন: প্রতি বছর ১৫ দিনের বেতনের সমান
২৬: প্রতি মাসে ২৬ কার্যদিবস ধরে হিসাব করা হয়
ধরি, একজন কর্মীর শেষ মাসের মূল বেতন ও ডিএ সহ মোট ₹৫০,০০০। তিনি একই প্রতিষ্ঠানে ৯ বছর পূর্ণ কাজ করেছেন।
তাহলে, গ্র্যাচুইটি হবে:
₹50,000 × 9 × 15 ÷ 26 = ₹50,000 × 135 ÷ 26 = ₹6,75,000 ÷ 26 ≈ ₹25,961.5 × 9 ≈ ₹2,33,653.85
৯ বছরের চাকরির পর এই কর্মী ₹২,৩৩,৬৫০ (প্রায়) গ্র্যাচুইটি পাবেন।
| বিষয় | সরকারি চাকরি | বেসরকারি চাকরি |
|---|---|---|
| কর প্রযোজ্যতা | পুরোপুরি করমুক্ত | নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে করমুক্ত |
| সীমা | কোনো সীমা নেই | সর্বোচ্চ ₹২০ লক্ষ পর্যন্ত করমুক্ত |
| হিসাব পদ্ধতি | নির্ধারিত সূত্র অনুযায়ী | একই সূত্র, কিন্তু নিয়োগপত্র ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে |
| নথিপত্র | অবসর পত্র, বেতন স্লিপ, পরিচয়পত্র | রিলিভিং লেটার, কাজের প্রমাণ, পরিচয়পত্র |
ভারত সরকারের Income Tax Act, Section 10(10) অনুসারে, বেসরকারি কর্মচারীরা ₹২০ লক্ষ পর্যন্ত গ্র্যাচুইটি করমুক্ত পান।
সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমা – ₹২০ লক্ষ
প্রাপ্ত গ্র্যাচুইটির প্রকৃত অঙ্ক
হিসাব অনুযায়ী প্রাপ্য অর্থ
এই তিনটির মধ্যে যেটি সবচেয়ে কম, সেটিই করমুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
চাকরি ছাড়ার পর কর্মী নিজে বা তার মনোনীত ব্যক্তি আবেদন করতে পারেন।
শেষ মাসের বেতন স্লিপ
নিয়োগপত্র
রিলিভিং লেটার
পরিচয়পত্র ও প্যান কার্ড
ফর্ম G (Gratuity Claim Form)
চাকরি ছাড়ার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে ১২০ দিন পর্যন্ত সময় দেওয়া যেতে পারে।
অনেকেই গ্র্যাচুইটি ও পিএফ (Provident Fund) গুলিয়ে ফেলেন। নিচে পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
| বিষয় | গ্র্যাচুইটি | পিএফ |
|---|---|---|
| নিয়ন্ত্রণকারী আইন | Payment of Gratuity Act, 1972 | Employees’ Provident Fund Act, 1952 |
| প্রাপ্তির শর্ত | ৫ বছর চাকরি | কর্মজীবনের পুরো সময় |
| কর্মীর অবদান | কর্মী অবদান করেন না | কর্মী ও নিয়োগকর্তা উভয়ে অবদান রাখেন |
| কর প্রযোজ্যতা | নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত করমুক্ত | সাধারণত করমুক্ত |
যদি কোনও কর্মীর চাকরির সময় মৃত্যু বা স্থায়ী অক্ষমতা ঘটে, তাহলে ৫ বছরের শর্ত প্রযোজ্য নয়।
এই ক্ষেত্রে তার মনোনীত ব্যক্তি বা আইনি উত্তরাধিকারী সম্পূর্ণ গ্র্যাচুইটি পেতে পারেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধিক মামলায় বলেছে—
“গ্র্যাচুইটি কর্মীর অধিকার, এটি করুণার বিষয় নয়।”
এমনকি যদি কোনও কর্মী ডিসমিস (চাকরিচ্যুত) হন, তবুও বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি গ্র্যাচুইটি পাওয়ার যোগ্য হতে পারেন, যদি তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধ গুরুতর না হয়।
গ্র্যাচুইটি কেবলমাত্র একটি প্রাপ্ত অর্থ নয়, বরং এটি:
অবসরের পর আর্থিক সুরক্ষা
জরুরি সময়ের জন্য সঞ্চয়
স্বাস্থ্যবিমা বা পেনশন প্ল্যানের প্রাথমিক তহবিল
ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস
চাকরি জীবনের শেষ পর্বে এই অর্থ অনেক বড় সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়।
হ্যাঁ, যদি সেই ১১ মাসে ২৪০ দিন বা তার বেশি কাজ করেন, তাহলে ধরা হয় ৬ বছর।
মূল বেতন এবং ডিএ। অন্যান্য ভাতা (HRA, Conveyance ইত্যাদি) ধরা হয় না।
প্রাইভেট কোম্পানিতে গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক?
হ্যাঁ, যদি কোম্পানিতে ১০ বা তার বেশি কর্মী থাকেন।
পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। অনৈতিক কাজের প্রমাণ থাকলে গ্র্যাচুইটি বাতিল হতে পারে।
| বিষয় | তথ্য |
|---|---|
| গ্র্যাচুইটি পাওয়ার যোগ্যতা | ৫ বছর বা তার বেশি কাজ, পূর্ণকালীন কর্মচারী |
| হিসাব সূত্র | (শেষ বেতন + ডিএ) × চাকরির বছর × 15 ÷ 26 |
| ৯ বছরের চাকরির পরে সম্ভাব্য প্রাপ্তি | ₹২.৩৩ লক্ষ (বেতন ₹৫০,০০০ হলে) |
| করমুক্ত সীমা | বেসরকারি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ₹২০ লক্ষ পর্যন্ত |
| সরকারি চাকরি | পুরোপুরি করমুক্ত |
| নথি প্রয়োজন | বেতন স্লিপ, রিলিভিং লেটার, প্যান কার্ড, ফর্ম G |
| আবেদন সময় | চাকরি ছাড়ার ৩০ দিনের মধ্যে |
গ্র্যাচুইটি আপনার চাকরি জীবনের দীর্ঘ সময়ের প্রতিদান। এটি কেবল একটি টাকার অঙ্ক নয়, বরং আপনার প্রাপ্য। অনেকেই এই বিষয়ে সচেতন না থাকায় কোম্পানির কাছ থেকে ন্যায্য অর্থ পান না।
তাই প্রত্যেক কর্মচারীর উচিত:
নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা
চাকরি ছাড়ার সময় প্রয়োজনীয় হিসাব চাওয়া
প্রয়োজনে পিএফ অফিস বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা
সঠিক তথ্য জানলে আপনি আপনার প্রাপ্য অর্থ নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন।