Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

শিব আরতির সময়ে মুখে থালা নিয়ে হাজির বিশাল সাপ—এআই ভিডিওতে নতুন বিতর্ক

ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে দেখা যায় শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে চলছে আরতি তবে অবাক করার মতো বিষয় আরতি করছেন না কোনও পুরোহিত বরং এক বিশাল সাপ মুখে আরতির থালা ধরে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবমূর্তির সামনে সেটি নিখুঁত ভঙ্গিতে থালা ঘোরাচ্ছে অদ্ভুত এই দৃশ্য দেখে হতবাক নেটিজেনরা আর সেই নিয়েই শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক এ কি বাস্তব নাকি এআইয়ের কারসাজি

সাম্প্রতিক সময়ে সমাজমাধ্যমে কৃত্রিম মেধা বা এআই-নির্ভর প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারে নানা ধরনের ভিডিও, ছবি এবং অডিও কনটেন্ট ভাইরাল হচ্ছে। এদের অনেকগুলিই প্রথম দেখায় এতটাই বাস্তব মনে হয় যে সাধারণ মানুষ সহজেই ভুল বুঝে বসেন। কখনও রাজনৈতিক মন্তব্য, কখনও কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের মুখ বদলে দেওয়া ভিডিও, কখনও বা অস্বাভাবিক ঘটনার নকল ফুটেজ—সব মিলিয়ে ইন্টারনেট যেন এক অদ্ভুত ‘বাস্তব–অবাস্তব’-এর দুনিয়ায় পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভুয়ো কনটেন্ট তৈরিও হয়েছে সহজ, আর সেই সুযোগে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে আরও দ্রুত। এই প্রেক্ষাপটেই সমাজমাধ্যমে আবারও ভাইরাল হয়েছে এক অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য ভিডিও—শিবমন্দিরে আরতির থালা মুখে নিয়ে বিশাল সাপের আরতি করার দৃশ্য। ভিডিওটি সামনে আসতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে নেটমাধ্যমে, আর তারপরই শুরু হয় তীব্র বিতর্ক।

ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে মানুষ নানা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন—একটি সাপ কি সত্যিই এমন আচরণ করতে পারে? সাপের পক্ষে কি মানুষের মতো আচরণ অনুকরণ করা সম্ভব? ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কোনও সরীসৃপের এমন নিখুঁত অংশগ্রহণ আদৌ কি বাস্তব হতে পারে? এই প্রশ্নগুলি মাথায় রেখেই বহু মানুষ ভিডিওটি বহুবার দেখেন, বিশ্লেষণ করেন, আশ্চর্য হন এবং শেষমেশ সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে প্রথমে ভিডিওটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে সাধারণ দর্শকরা সেটিকে সম্পূর্ণ বাস্তব বলে ধরে নিতে বাধ্য হন।

ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে—একটি শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে বেশ কয়েকজন পুণ্যার্থী ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ ফোনে ভিডিও করছেন, কেউ আবার বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছেন সামনে ঘটে চলা দৃশ্যটির দিকে। মন্দিরের আলোর কোমল ঝলক, ঘণ্টার ধ্বনি এবং ধূপের ধোঁয়ায় ঘেরা সেই পরিবেশে যেন আরও অলৌকিক হয়ে উঠেছে দৃশ্যটি। গর্ভগৃহের ঠিক কেন্দ্রে শিবমূর্তির সামনে একটি বিশাল সাপ দাঁড়িয়ে আছে গাঁথুনি পাকিয়ে। তার মুখে ধরা আরতির থালা—যার উপর একটি জ্বলন্ত প্রদীপ জ্বলছে। সাপটি থালাটি এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে যেন নিয়ম মেনে আরতি করছে। দর্শনার্থীরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ শিবের মহিমা বলে প্রশংসা করছেন, কেউ আবার এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে পিছু হটছেন।

একটি সাপ, বিশেষ করে কোবরা বা পাইথন জাতীয় বড় সরীসৃপ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বুঝে আরতির মতো জটিল আচরণ করছে—এমন দৃশ্য মানুষ এর আগে কখনও দেখেননি। আর তাই ভিডিওটি মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকে এটিকে ‘মিরাকল’ বলে দাবি করেন। কেউ কেউ লেখেন, “শিব স্বয়ং নীলকণ্ঠ, সাপ তাঁরই প্রতীক। তাই সাপের আরতি করা অদ্ভুত নয়।” আবার অনেকে লেখেন, “এটিই প্রমাণ করে প্রকৃতি কখনও কখনও মানুষের চেয়েও ধর্মীয় আচারের গভীরতা বোঝে।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা মত, নানা আবেগে ভিডিওটি ঘিরে গড়ে ওঠে বিরাট আলোচনা।

ভিডিওটি পোস্ট করা হয় ‘ওপিহেড’ নামের একটি রেডিট অ্যাকাউন্ট থেকে। ভিডিওটি পোস্ট হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষাধিক মানুষ সেটি দেখেন, শেয়ার করেন এবং লাইক করেন। কমেন্ট সেকশন ভরে ওঠে বিস্ময়, কৌতূহল এবং সন্দেহে ভরা প্রতিক্রিয়ায়। অনেকেই ভিডিওটির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কেউ লেখেন, “সাপ কখনও মানুষের মতো থালা ঘোরানোর মতো সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ দেখাতে পারে না।” আরেকজন মন্তব্য করেন, “এটি হয়তো কোনও ধরনের ভুয়ো ফুটেজ। আজকাল এআই দিয়ে সব কিছুই করা সম্ভব।” তবে প্রথমে ভিডিওটির ভিজ্যুয়াল এতটাই বাস্তব বলে মনে হয় যে অনেকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হন এটি সত্যি।

এরপর বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ভিডিওটি খতিয়ে দেখতে শুরু করে। স্লো-মোশন, ফ্রেম-বাই-ফ্রেম বিশ্লেষণ, টেক্সচার প্যাটার্ন এবং আলোছায়ার সামঞ্জস্য দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন—ভিডিওটিতে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। সাপের গতিবিধি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিউরোমাসকিউলার মুভমেন্টের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। মুখের অংশে থালা ধরার দৃশ্যে দেখা যায় দৃশ্যটি কৃত্রিমভাবে তৈরি। আলো প্রতিফলনের ক্ষেত্রেও কিছু অসমতা ধরা পড়ে। শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে ভিডিওটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম মেধার সাহায্যে তৈরি। গভীর নিউরাল নেটওয়ার্ক-ভিত্তিক ভিডিও জেনারেশন টেকনোলজি ব্যবহার করে এ ধরনের দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে। আর সেই কারণেই ভিডিওটি প্রথম দেখায় এত বাস্তব মনে হয়।

এই সত্য প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয় নতুন বিতর্ক। এক দিকে মানুষ প্রযুক্তির এই অগ্রগতিতে বিস্মিত হন, অন্য দিকে এমন বিভ্রান্তিমূলক কনটেন্ট তৈরি করে তা ধর্মীয় আবেগ বা সামাজিক মানসিকতায় প্রভাব ফেলতে পারে—এই আশঙ্কা নিয়ে ওঠে প্রতিবাদের সুর। অনেকেই বলেন, “এভাবে এআই ব্যবহার করে ভুয়ো ঘটনা ছড়ানো খুবই বিপজ্জনক। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয় হলে তা সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।” আবার কেউ কেউ বলেন, “প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ভুয়ো খবর চিনে নেওয়া তত কঠিন হয়ে উঠছে। মানুষ প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।”

news image
আরও খবর

সমাজমাধ্যমে অসংখ্য ব্যবহারকারী ক্ষোভ উগরে দিতে থাকেন। কেউ লেখেন, “কৃত্রিম মেধা দিয়ে তৈরি এসব ভিডিও মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করছে।” আরেকজন বলেন, “এআই দারুণ প্রযুক্তি, কিন্তু এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিপদ বাড়বে।” কেউ লিখেছেন, “এই ধরনের ভিডিও দেখে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই যেকোনও ভাইরাল কনটেন্ট দেখার আগে যাচাই করা উচিত।”

সরকারী স্তরেও এই ধরনের কনটেন্টের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই এআই-জেনারেটেড ভুয়ো কনটেন্ট প্রতিরোধে আইন তৈরি হচ্ছে। কারণ ভিডিও, ছবি বা অডিও—যে কোনও মাধ্যমেই ডিপফেক বা কৃত্রিম ফুটেজ মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই বড় প্রভাব ফেলতে পারে। শিবমন্দিরে সাপের আরতির মতো ভিডিও হয়তো নেহাত ধর্মীয় বা বিনোদনমূলক মনে হতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে সামাজিক আবেগকে ভুল পথে পরিচালিত করার ঝুঁকি রয়েছে, যা মোটেই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।

ভিডিও ঘিরে যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে, তা থেকেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষ যেমন প্রযুক্তিগত উন্নতিকে স্বাগত জানাচ্ছেন, তেমনই তারা এই উন্নতির অপব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্তও। কেউ কেউ ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে শিক্ষামূলক দিক তুলে ধরেন—“আমরা যদি বুঝতে না পারি কোনটা বাস্তব আর কোনটা এআই, তাহলে ভবিষ্যতে তথ্যপ্রবাহ কতটা সঠিক থাকবে?” কেউ আবার বলেন, “এআই প্রযুক্তির সুবিধা যেমন অসংখ্য, তেমনই এর অপব্যবহারও খুব সহজ।”

সবশেষে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কোনও ভাইরাল ভিডিও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা সময়ে বিপজ্জনক ফল বয়ে আনতে পারে। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের এই যুগে ‘দেখা মানেই বিশ্বাস’—এই ধারণা আর নিরাপদ নয়। কৃত্রিম মেধার সাহায্যে এমন সব দৃশ্য তৈরি করা সম্ভব যা বাস্তবের সঙ্গে হুবহু মিল রেখে তৈরি হয়, কিন্তু আসল ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই সমাজমাধ্যমে কোনও অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য বা আবেগঘন ভিডিও দেখলে তা যাচাই করা জরুরি। নাহলে ভুয়ো তথ্য, ভুয়ো দৃশ্য এবং কৃত্রিম গল্প মানুষের ধারণা, অনুভূতি এমনকি সামাজিক স্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

শিবমন্দিরে সাপের আরতি করার ভিডিওটি তার খুব বড় উদাহরণ। প্রথমে ভিডিওটি দেখে বহু মানুষ বিস্মিত হন, কেউ কেউ আবার এটিকে অলৌকিক ঘটনা বলে দাবি করেন। সমাজমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রতিক্রিয়া, মন্তব্য এবং বিভ্রান্তি। কিন্তু পরে যখন ভিডিওটি কৃত্রিম মেধার তৈরি বলে প্রমাণিত হয়, তখনই আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। মানুষ বুঝতে পারেন, এই ধরনের প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই বাস্তবতা আর ভুয়ো কনটেন্টের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে।

এই ভিডিওকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা শুধু একটি ভাইরাল ক্লিপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি আমাদের সামনে ভবিষ্যতের ঝুঁকির বার্তাও তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম মেধার সুফল যেমন অপরিসীম, তেমনই এর অপব্যবহারও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তাই প্রয়োজন প্রযুক্তি ব্যবহারের সতর্কতা, সচেতনতা এবং যাচাই-বাছাইয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা। তা না হলে সমাজমাধ্যমে ভুয়ো কনটেন্টের বিস্তার ভবিষ্যতে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

 

Preview image