Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়: চাপে রাজকোষ

মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় রাজকোষে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা, সামাজিক নিরাপত্তা ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রশাসনিক ও লজিস্টিক খরচ বৃদ্ধি ব্যয়ের বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একই সময়ে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবুও নারীশক্তিকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে এসব প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বচ্ছতা, কার্যকর তদারকি ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা বাড়ালে ব্যয় কমবে এবং প্রকল্পের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।

মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়: চাপে রাজকোষ
সরকারি প্রকল্প

মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়: চাপে রাজকোষ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীশক্তিকে মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্ত করা, তাদের কাজের সুযোগ সম্প্রসারণ, উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই এসব প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসব প্রকল্পের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় রাজকোষে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে পরিকল্পনা কমিশন পর্যন্ত গভীর উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নতুন সংকট তৈরি করছে। মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, কারিগরি প্রশিক্ষণ, নারী শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, মাতৃত্বকালীন আর্থিক সহায়তা, গ্রামীণ মহিলা সহায়তা কর্মসূচি এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা নারী ও শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম। উন্নত জীবনমান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে এসব প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। অর্থনৈতিক সাম্য অর্জনের জন্য এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোকে সাধারণত ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও, প্রকল্পগুলোতে অপচয়, দুর্বল তদারকি এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধির ফলে প্রকৃত সুফল অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ সেবাগ্রহীতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। এই বৈষম্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে—এত ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা কোথায়? অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো প্রশাসনিক খরচের লাগামহীন বৃদ্ধি। প্রকল্প পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ, পরামর্শক নিয়োগ, মাঠপর্যায় তদারকির জন্য যাতায়াত ও লজিস্টিক খরচ—সব মিলিয়ে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের তুলনায় খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। কোনো কোনো প্রকল্পে মোট বরাদ্দের প্রায় ৪০ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে প্রশাসনিক খাতে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অত্যন্ত বেশি। সরকারি হিসাব নিরীক্ষায় দেখা যায়, কিছু প্রকল্পে একই কাজের জন্য একাধিক সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ফলে ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে; আবার কোথাও তদারকির অভাবে কাজের মান নিম্নমানের হওয়ায় পুনরায় কাজ করতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির মতো কারণগুলোও প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে নির্মাণ সামগ্রী, পরিবহন এবং লজিস্টিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি প্রকল্পগুলোর ব্যয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেরিতে কার্যক্রম শুরু হওয়া, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া মানে খরচ আরও বাড়া, কারণ প্রতিটি বছরেই মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যান্য আর্থিক কারণ ব্যয় বাড়িয়ে তোলে। রাজকোষে চাপের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় যে সরকারের আয় বৃদ্ধির হার ব্যয়ের তুলনায় কম। রাজস্ব আয় লক্ষ্য পূরণে বারবার ঘাটতি দেখা দেওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা বহন করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। এর ওপর রয়েছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ, যা বাজেট ব্যয়ের একটি বড় অংশ দখল করছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যদি বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তবে অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হতে পারে অথবা নতুন করের মাধ্যমে জনগণের ওপর চাপ বাড়াতে হতে পারে। তবুও, মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, এবং এদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যারা সরকারি সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং উদ্যোক্তা হয়েছেন, তাদের আয় আগের তুলনায় গড়ে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ নারীদের মধ্যে সেলাই, হস্তশিল্প, কৃষি উদ্যোগ, পোলট্রি, আইটি প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে আগ্রহ বাড়ছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদের ঋণের পরিমাণ বাড়ানোয় ব্যবসা
news image
আরও খবর
শুরু করা এখন তুলনামূলক সহজ হয়েছে। অনেক নারীই ঘরে বসে ব্যবসা চালিয়ে পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করছেন। সমাজে নারীর অবস্থান দৃঢ় হচ্ছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকা বাড়ছে। কিন্তু ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি রয়েছে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রকল্পের সুবিধা যাদের জন্য বরাদ্দ, অর্থাৎ সমাজের প্রান্তিক নারীরা, তারা সঠিকভাবে সুবিধা পাচ্ছেন না। মাঝপথে অনিয়ম, বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রভাব এবং তথ্য-প্রযুক্তির অভাবের কারণে প্রকল্পগুলোর সুবিধা অনেক সময় প্রকৃত উপকারভোগীর কাছে পৌঁছায় না। আবার গ্রামীণ অঞ্চলের অনেক নারীই এখনও সরকারি সহায়তার বিষয়ে তেমন জানেন না, ফলে সচেতনতাহীনতার কারণে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে পড়েন। কিছু অঞ্চলে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ঋণ পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়; কেউ কেউ আবার স্বল্প সুদের ঋণ পাওয়ার নাম করে উচ্চ সুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ জালে পড়ে যান। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির রেশ ধরে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে—অপচয় আটকাতে এবং দক্ষতা বাড়াতে রাষ্ট্র কতটা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে? সরকার বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিয়েছে যে প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা বাড়াতে অনলাইন মনিটরিং, ডাটা ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং ডিজিটাল ভেরিফিকেশন ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবে বাস্তবে এসব ব্যবস্থার প্রয়োগ এখনো খুব সীমিত। কিছু প্রকল্পে পাইলট স্কেলে ডিজিটাল মনিটরিং চালু হলেও সারাদেশে এটি কার্যকর হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন পুরোপুরি ডিজিটাল ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা যায়, তবে ব্যয় কমবে এবং তহবিল অপচয় রোধ করা যাবে। এদিকে, রাজনৈতিক মহলেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিরোধীদল দাবি করছে যে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অকারণে ব্যয় বাড়িয়ে দুর্নীতি ঢাকতে চাইছে। তাদের অভিযোগ, মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নাম ব্যবহার করে এক ধরনের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যারা প্রকল্পের বড় অংশের অর্থ ভিন্ন খাতে সরিয়ে নিচ্ছে। যদিও সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে যে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা, এবং নারী উন্নয়নে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকেই আরও শক্তিশালী করবে। অর্থনীতিবিদরা একটি মধ্যপন্থার কথা বলছেন। তাদের মতে, নারী উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ করা বা ব্যয় কমিয়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই ক্ষতিকর হবে। বরং প্রকল্পগুলোর কাঠামো পুনর্বিন্যাস, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা জরুরি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহযোগিতায় নারীদের জন্য যে প্রকল্পগুলো চলছে, সেগুলোর কার্যপদ্ধতিও নবায়ন করার প্রয়োজন রয়েছে। অনেক সংস্থাই এখন প্রকল্পভিত্তিক ব্যয়ের উপরে নয়, বরং ফলাফলভিত্তিক তহবিল দিতে আগ্রহী। সরকারের উচিত এই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নীতি সংশোধন করা। এ ছাড়া মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে বেসরকারি খাতকে আরও বেশি যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে অনেক প্রতিষ্ঠান নারীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান তৈরিতে কাজ করছে। যদি সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে তাদের সমন্বয় করা যায়, তবে ব্যয় কমবে এবং কার্যকারিতা বাড়বে। একই সঙ্গে নারীদের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে, কারণ ভবিষ্যতের শ্রমবাজারে প্রযুক্তিগত দক্ষতার গুরুত্ব আরও বাড়বে। নারীদের এই খাতে যুক্ত করা গেলে অর্থনীতিতে তাদের অবদান বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। শেষ পর্যন্ত বলা যায়, মহিলা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি একদিকে যেমন রাজকোষে চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে এই প্রকল্পগুলো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রাখছে। সঠিক পরিকল্পনা, তদারকি, জবাবদিহিতা ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যয় কমিয়ে প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব। নারীশক্তিকে মূলধারায় এনে যে অর্থনৈতিক প্রগতি অর্জন সম্ভব, তার বিকল্প নেই। তাই ব্যয় বৃদ্ধিকে কেবল বোঝা হিসেবে না দেখে এটিকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। তবে সেই বিনিয়োগ যেন অপচয়ে পরিণত না হয়—এটি নিশ্চিত করাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য নারীদের উন্নয়ন অপরিহার্য, আর সেই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে প্রকল্পগুলোর দক্ষতা এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতেই হবে।

Preview image