ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি আবারও সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা কাজের পক্ষে মত দিলেন। ভারতীয় তরুণদের উদ্দেশে তিনি চীনের বিতর্কিত ‘৯-৯-৬’ কাজের মডেলের উদাহরণ তুলে ধরে দেশের উন্নতির স্বার্থে বেশি সময় শ্রম দেওয়ার পরামর্শ দেন।
ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি ভারতের কর্পোরেট বিশ্বে এমন একটি নাম, যাকে সম্মান এবং সমালোচনা—দুটিই সমানভাবে অনুসরণ করে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে মত প্রকাশ করে আসছেন। সম্প্রতি তিনি আবারও এমন একটি মন্তব্য করেছেন, যা ভারতের তরুণ সমাজ, শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞ, কর্পোরেট নেতা এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি আবারও বলেছেন, দেশের উন্নতির স্বার্থে তরুণদের সপ্তাহে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা কাজ করা উচিত। তাঁর মতে, ভারতকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির পথে নিয়ে যেতে হলে কঠোর পরিশ্রমই একমাত্র পথ। আর এই মতকে সমর্থন করার জন্য তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন চীনের বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত ‘৯-৯-৬’ কাজের মডেল—যেখানে কর্মীরা সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে থাকে।
নারায়ণ মূর্তির কথায় স্পষ্ট যে, তিনি দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম এবং কর্মচেতনার বৃদ্ধিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, ভারত এখনও বৈশ্বিক অর্থনীতির দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। এটি কাটিয়ে ওঠার জন্য দরকার অতিরিক্ত শ্রম এবং নিষ্ঠা। যদিও তাঁর এই বক্তব্য অনেকেই প্রশংসা করেছেন, কারণ তাঁরা মনে করেন ভারতের উন্নতির জন্য সত্যিই কঠোর পরিশ্রম অপরিহার্য। অন্যদিকে, অনেকে আবার তাঁর বক্তব্যকে অযৌক্তিক, অমানবিক এবং বর্তমান যুগের শ্রমসংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান বলে উল্লেখ করেছেন।
নারায়ণ মূর্তি প্রশ্ন তুলেছেন—ইউরোপ বা আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর মতো জীবনযাপন করতে চাইলে ভারতীয়রা কেন পরিশ্রমের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে? তিনি বলেন, তারুণ্যকালেই যদি কেউ কঠোর পরিশ্রম না করেন, তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাঁর মতে, তরুণদের হাতে রয়েছে দেশের ভবিষ্যৎ আর সেই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হলে প্রচণ্ড নিষ্ঠা প্রয়োজন। তিনি এ-ও বলেছেন যে উন্নতির ইতিহাসে এমন কোনো দেশ নেই, যারা নিজেদের কর্মঘণ্টা বাড়ানোর মাধ্যমে দ্রুত উন্নতি অর্জন করেনি। এবং ইতিহাস তাঁর এই বক্তব্যকে অনেকাংশে সমর্থন করে।
তবে এই বক্তব্য যতটা ইতিবাচক শোনায়, ততটাই বিতর্কও তৈরি করে। কারণ আধুনিক কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য (work-life balance) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমান প্রজন্ম মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবার, সামাজিক জীবন এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের দিকটিকে সমান গুরুত্ব দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা কাজ করার পরামর্শ অনেকের কাছেই অমানবিক মনে হয়েছে। ভারতের শ্রম আইন অনুযায়ী সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা কাজের কথা বলা হয়েছে, এবং তার বেশি কাজ করালে ওভারটাইম দেওয়া বাধ্যতামূলক। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব কেন দেশের শ্রমনীতির বিরুদ্ধে এমন মতামত দিলেন?
নারায়ণ মূর্তির বক্তব্যের কেন্দ্রবিন্দু হলো চীনের তথাকথিত ৯-৯-৬ মডেল। এটি এমন একটি মডেল যেখানে কর্মীরা সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে। মোট ৭২ ঘণ্টা। চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে এই মডেল অবদান রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন। চীনের বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি—আলিবাবা, টেনসেন্ট, বাইদু এবং আরও অনেক প্রতিষ্ঠান—এই মডেল দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করেছে। জ্যাক মা নিজেও একসময় এই মডেলের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তরুণদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হবে যদি তারা দ্রুত সফল হতে চায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মডেল নিয়ে বিতর্ক বাড়তে থাকে। কর্মীরা বাড়তি কাজের চাপ, মানসিক চাপ, পরিবারে সময় না পেতে পারা এবং শারীরিক স্বাস্থ্য অবনতির অভিযোগ করতে শুরু করেন। একাধিক মৃত্যু ও অসুস্থতার ঘটনা সামনে আসতে থাকে, যা চীনা সমাজে ক্ষোভের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত চীনা সরকার এই মডেলকে অবৈধ ঘোষণা করে বলে জানা যায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—চীনে যে মডেল এখন আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে সেটিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার যৌক্তিকতা কতটুকু? সমালোচকরা বলছেন, ভারতীয় তরুণরা ইতিমধ্যেই প্রচুর চাপের মধ্যে কাজ করছেন—কম বেতন, কর্মসংস্থানের অভাব, প্রতিযোগিতা, দক্ষতা অর্জনের চাপ, এবং উপরন্তু কাজের অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে ৭২ ঘণ্টা কাজের পরামর্শ তরুণদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে আরও বিপন্ন করবে।
অন্যদিকে কর্পোরেট নেতাদের একটি বড় অংশ মনে করেন, নারায়ণ মূর্তির বক্তব্যের উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য এমন নয় যে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ৭২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। বরং তিনি বলতে চেয়েছেন—যারা উন্নতির জন্য লড়াই করবে, যারা ক্যারিয়ারে বড় কিছু করতে চায়, তাদের জন্য কঠোর পরিশ্রমই একমাত্র উপায়। অতীতে ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের তরুণরা রাত দিন কাজ করে ভারতকে বৈশ্বিক IT মানচিত্রে তুলে ধরেছিলেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে দিয়েছে। আজকের প্রজন্ম সেই মনোভাব কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে—এমনটাই মনে করেন মূর্তি।
তিনি আরও বলেছেন, ভারতীয়দের মধ্যে প্রতিভার কোনো অভাব নেই। কিন্তু এই প্রতিভা কাজে লাগাতে হলে দরকার দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা এবং নিষ্ঠা। ভারত যদি চায় আমেরিকা বা চীনের মতো সুপার পাওয়ার হতে, তবে কর্মঘণ্টা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। তাঁর মতে, এখন আর আরামে কাজ করে সফল হওয়া যাবে না। বিশ্ব দ্রুত এগোচ্ছে, প্রযুক্তি দ্রুত বদলাচ্ছে, আর প্রতিযোগিতা দ্বিগুণ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সফল হতে হলে আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে।
তবে এখানেই শুরু হয় বিতর্কের দ্বিতীয় পর্ব। প্রশ্ন উঠেছে—দেশের উন্নতির জন্য কি শুধুমাত্র কর্মীদেরই বেশি কাজ করতে হবে? কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কি কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা, উপযুক্ত বেতন, নিরাপদ পরিবেশ, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং পর্যাপ্ত ছুটি দিচ্ছে? যদি না দেয়, তবে কর্মঘণ্টা বাড়ানোর কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে কি?
তরুণদের একটি বড় অংশ মনে করেন, সমস্যার মূল কারণে না গিয়ে শুধু পরিশ্রম বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া কখনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। ভারতের অনেক কর্মস্থলে আজও রয়েছে মাইক্রোম্যানেজমেন্ট, অদক্ষ নেতৃত্ব, ভুল পরিকল্পনা, বাড়তি চাপ, এবং ন্যায্য বেতন না পাওয়ার সমস্যা। এই সমস্যাগুলো সমাধান না করে, কেবল সময় বাড়িয়ে কাজ করালে মূল সমস্যা থেকেই যাবে। বরং কাজের গুণমান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকেই।
যাঁরা নারায়ণ মূর্তির বক্তব্যের বিরোধী, তাঁরা আরও একটি যুক্তি দেন—সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা কাজ মানে ব্যক্তিজীবন পুরোপুরি উপেক্ষা করা। এতে পরিবার, সন্তান, সামাজিক জীবন সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। কর্মীরা বার্নআউটের শিকার হবে এবং তার ফলে সমাজে মানসিক রোগ বাড়বে। তাই উন্নতির নামে মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করা যায় না।
অন্যদিকে সমর্থকরা মনে করেন, সফল মানুষরা কখনোই সাধারণ নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তাঁরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন, বাড়তি সময় দেন, এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব নেন। তাই কোনো দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সেই দেশের তরুণদের মধ্যেও একই মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
ভারতের IT শিল্পে কাজের চাপ নতুন কিছু নয়। বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পুনে এবং চেন্নাইয়ের মতো শহরগুলোতে তরুণরা প্রায়ই দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করেন। অনেক সময় এর বেশি। ফলে সমালোচকদের বক্তব্য—ইতিমধ্যেই ভারতীয় কর্মীরা যথেষ্ট কঠোর পরিশ্রম করছে। অতিরিক্ত ২৪ ঘণ্টা যোগ করলে তা বাস্তবসম্মত হবে না।
সবশেষে বলা যায়, নারায়ণ মূর্তির এই বক্তব্য কেবল শ্রমনীতি নয়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধুনিক কর্মসংস্কৃতির একটি বড় বিতর্ক তৈরি করেছে। দেশের উন্নতি কি শুধুই শ্রমের উপর নির্ভর করবে, নাকি তার জন্য দরকার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, সরকারী নীতি সংস্কার, এবং কর্পোরেট দায়িত্বশীলতা—এই প্রশ্নগুলো এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মূর্তির মতে, পরিশ্রমই পথ। তাঁর সমালোচকদের মতে, ভারসাম্যই পথ। আর সত্যি বলতে গেলে, বাস্তবতা হয়তো মাঝামাঝি কোথাও অবস্থান করছে।
এটি স্পষ্ট যে, ভারতের তরুণ প্রজন্ম, শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং কর্পোরেট বিশ্ব এই বিতর্ক থেকে সহজে বের হবে না। সময়ই শেষ পর্যন্ত বলে দেবে—নারায়ণ মূর্তির এই বক্তব্য ভারতের কর্মসংস্কৃতি পরিবর্তন করে কি না, কিংবা তা শুধু আরেকটি বিতর্ক হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে।