পাকিস্তান পুলিশ জানিয়েছে কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস নাসিরাবাদের শহিদ আব্দুল আজ়িজ় বুল্লো এলাকায় পৌঁছানোর পরই রেললাইনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রেন যাওয়ার মুহূর্তের পরেই এই হামলা চালানো হয় যা এলাকায় তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশে ফের নিশানায় জাফর এক্সপ্রেস। যাত্রীবোঝাই এই ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে পর পর হামলার ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা দেশে। নিরাপত্তা বাহিনী থেকে শুরু করে রেলকর্তারা পর্যন্ত চরম সতর্কতা জারি করেছেন। কিন্তু এর মধ্যেই রবিবার নাসিরাবাদের কাছে ফের নতুন করে হামলা চালানো হয় এই ট্রেনটিকে লক্ষ করে। বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় রেললাইনের একটি বড় অংশ। পাশাপাশি রকেট লঞ্চার দিয়েও হামলার চেষ্টা করা হয়। যদিও সেই রকেটগুলোর কোনওটাই সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছয়নি। ফলে অল্পের জন্য রক্ষা পায় বহু যাত্রী বহনকারী জাফর এক্সপ্রেস। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ট্রেনটির উপর এই ধারাবাহিক হামলার নেপথ্যে কারা?
পাকিস্তান পুলিশের প্রাথমিক সূত্রে জানা গিয়েছে, কোয়েটা থেকে পেশোয়ারের দিকে যাচ্ছিল জাফর এক্সপ্রেস। নাসিরাবাদের শহিদ আব্দুল আজ়িজ় বুল্লো এলাকা দিয়ে ট্রেনটি যাওয়ার ঠিক পর মুহূর্তেই রেললাইনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। তদন্তকারীদের দাবি, বিস্ফোরণের সময় নির্ধারণে হামলাকারীরা ভুল করেছিল। যদি সেই বিস্ফোরণ কয়েক সেকেন্ড আগে হতো, ট্রেনটির উপর নেমে আসতে পারত প্রবল বিপর্যয়। সেই ভুলের জন্যই অল্পের জন্য বেঁচে যায় কয়েক শো যাত্রী।
যদিও এখানেই শেষ নয়। বিস্ফোরণের কয়েক মিনিটের মাথায় ট্রেনটিকে লক্ষ্য করে পর পর চারটি রকেট ছোড়ে হামলাকারীরা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই চারটি রকেটের একটিও ট্রেনের শরীরে কিংবা লাইনের কোনও জায়গায় আঘাত করেনি। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী মনে করছে, পরিকল্পনাটি ছিল আরও ভয়াবহ। কিন্তু নিখুঁত লক্ষ্য স্থির করতে না পারায় হামলাকারীদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। নাসিরাবাদের এসএসপি গুলাম সারওয়ার জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। চারদিক ঘিরে শুরু হয় তল্লাশি। কিন্তু হামলাকারীদের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। সারওয়ারের কথায়, ‘‘হামলাকারীরা যে জাফর এক্সপ্রেসকেই লক্ষ্য করেছিল, তা স্পষ্ট। রেললাইনের ক্ষতি থেকে শুরু করে রকেট হামলার লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া সব মিলিয়ে বড় একটি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে যাত্রিবাহী ট্রেনটি। এই ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও যাত্রীদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
রেল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে রেললাইনের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণেই কোয়েটার সঙ্গে দেশের অন্যপ্রান্তের রেল যোগাযোগ আপাতত বন্ধ রাখতে হয়েছে। যদিও ট্রেনটি নিরাপদে জেকোবাবাদ পৌঁছতে সক্ষম হয়। পরে সেখান থেকেই পেশোয়ারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। রেলকর্তারা আরও জানান, নিরাপত্তাজনিত কারণে টানা চার দিন বন্ধ ছিল এই ট্রেনটি। রবিবার থেকে ফের চালু করা হয়েছিল। আর তার পরদিনই এমন ভয়াবহ হামলার ঘটনা সামনে আসে।
ঘটনার পর পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত কোনও সংগঠনই এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, বালোচ বিদ্রোহী সংগঠনগুলির দিকেই ঝুঁকছে সন্দেহ। কারণ এর আগেও বারংবার জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা করেছে বালোচ বিদ্রোহীরা। গত অক্টোবরে ঠিক একইভাবে রেললাইনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। তাতে ট্রেনের কয়েকটি কামরা লাইনচ্যুত হয়। তারও কয়েক মাস আগে, চলতি বছরের মার্চে, আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যখন সশস্ত্র বালোচ বিদ্রোহীরা পুরো ট্রেনটিকে অপহরণ করে যাত্রীদের পণবন্দি করে। সেই ঘটনার রেশ আজও ভুলতে পারেননি পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। যাত্রীদের উদ্ধার করতে নেমে প্রাণ হারায় পাকিস্তানের সেনা জওয়ানসহ মোট ২৬ জন। পাল্টা অভিযানে মারা যায় ৩৩ জন বালোচ বিদ্রোহী। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর শেষমেশ ৩৫৪ জন যাত্রীসহ ট্রেনটি উদ্ধার করেছিল পাক সেনা।
এখানেই শেষ নয়। চলতি বছরের জুন মাসেও সিন্ধ প্রদেশের জাকোবাবাদের কাছে বিস্ফোরণে জাফর এক্সপ্রেসের চারটি কামরা লাইনচ্যুত হয়। পরে অগস্টের ৪ এবং ১০ তারিখেও হামলার মুখে পড়তে হয় এই যাত্রীবাহী ট্রেনটিকে। একের পর এক ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, কেন বারবার এই ট্রেনকেই লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে? পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, বিদ্রোহী সংগঠনের আধিপত্য, কোয়েটা পেশোয়ার রুটের কৌশলগত গুরুত্ব সব মিলিয়ে জাফর এক্সপ্রেস যেন কোনওভাবে একটি সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
রেলমন্ত্রকের এক কর্তা জানিয়েছেন, জাফর এক্সপ্রেস পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট। কোয়েটা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত বহু মানুষ এই ট্রেনে যাতায়াত করেন। যাত্রীদের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন ব্যবসায়ী, শ্রমিক, ছাত্র, এমনকি সরকারি দফতরের কর্মীরাও। ফলে এই ট্রেনের উপর হামলা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে যেখানে বিপর্যস্ত করছে, সেখানে সরকার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপরও তৈরি করছে বড় চাপ। প্রতিবারই নতুন করে নিরাপত্তা বাড়ানোর আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে সেই সুরক্ষা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছে। নাসিরাবাদের বহু মানুষ জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। ঘটনার পর বহু পরিবার ট্রেনে চড়তে ভয় পাচ্ছেন। বালোচিস্তানে চলমান বিদ্রোহী কার্যকলাপ দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের মাথাব্যথার কারণ। এই অঞ্চলে রেললাইন, তেল পাইপলাইন, পুলিশ স্টেশন, সেনা ক্যাম্প বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালানো নতুন নয়। তার মধ্যে জাফর এক্সপ্রেসকে বারবার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে কেন তা নিয়ে তদন্তকারীরা এখন নতুন করে বিশ্লেষণ শুরু করেছেন।
জাফর এক্সপ্রেসে ধারাবাহিক হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষত নাসিরাবাদে রবিবারের বিস্ফোরণ এবং রকেট হামলার পর থেকেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এই ঘটনায় পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ও রেললাইনের মতো জাতীয় অবকাঠামো সুরক্ষায় সরকারের কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। যেখানে টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর আবার চালু করা হয়েছিল জাফর এক্সপ্রেস, সেখানে যাত্রীদের নিরাপত্তার খাতিরে আরও কঠোর নজরদারি এবং নিরাপত্তা মোতায়েনের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই নিরাপত্তা কতটা দুর্বল ছিল, রবিবারের হামলাই তার স্পষ্ট প্রমাণ।
বিরোধীরা দাবি করেছে, সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফলেই একই ট্রেন বারবার সন্ত্রাসীদের নিশানা হয়ে উঠছে। বালোচিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্রোহী কার্যকলাপ চলছে। তবুও রেলপথে বিস্ফোরক পুঁতে রাখা, রকেট হামলার চেষ্টা এসবই দেখাচ্ছে যে নিরাপত্তা বাহিনী আগাম কোনও তথ্য পায়নি। এই গোয়েন্দা ব্যর্থতাও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আগুনে ঘি ঢেলেছে। প্রশ্ন উঠছে চার দিন বন্ধ থাকার পর রবিবার থেকে ট্রেন চালু করা হল কেন, যখন নিরাপত্তা বাহিনীরা জানতই না যে ওই রুটে হামলার আশঙ্কা রয়েছে?
নাসিরাবাদে রেললাইনের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দেখে রেল কর্তৃপক্ষকেও বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বিস্ফোরণে লাইনের বড় অংশ ভেঙে গেছে, যার ফলে কোয়েটার সঙ্গে দেশের অন্যপ্রান্তের রেল যোগাযোগ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে হয়েছে। শুধুমাত্র যাত্রী নয়, বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহণেও বড় প্রভাব পড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে রেলপথের উপর এই ধরনের একের পর এক হামলা পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা উভয়কেই বিপন্ন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা, যদি দ্রুত কোনও সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন না করা হয়, তাহলে জাফর এক্সপ্রেসের মতো আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ রুট ভবিষ্যতে একইভাবে বিপদের মুখে পড়বে। কারণ এ পর্যন্ত কোনও বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার না করলেও অতীতের ঘটনাগুলি বালোচ বিদ্রোহীদের দিকেই ইঙ্গিত করছে। অক্টোবরে রেললাইন উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা হোক বা মার্চে ট্রেন অপহরণের ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রতি বারই জাফর এক্সপ্রেসই নিশানা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা যে নিছক কাকতালীয় নয়, তা বুঝতে কারও অসুবিধা নেই।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো বিদ্রোহীদের হামলার প্যাটার্ন এবং উদ্দেশ্য বুঝেও কোনও স্থায়ী সমাধান তৈরি করতে না পারা। প্রতিবারই হামলার পর তদন্ত শুরু হয়, নিরাপত্তা বাহিনী তল্লাশি চালায়, কিন্তু হামলাকারীদের ধরতে পারেনি এখন পর্যন্ত। এই ব্যর্থতা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জাফর এক্সপ্রেসকে কেন্দ্র করে যে সন্ত্রাস এবং আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামোর দুর্বলতাকে আবারও সামনে এনে দিয়েছে। একের পর এক হামলার পরও এই ট্রেনটি কতটা নিরাপদ থাকবে এ প্রশ্নের উত্তর এখনই মেলে না। বরং পরিস্থিতি ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। সরকার কত দ্রুত এবং কতটা শক্ত হাতে নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।