ভারতীয় রুপি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৯০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে মার্কিন ডলারের বিপরীতে, যা অর্থনীতি ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রুপির এই দুর্বলতা নিয়ে যখন সারাদেশে আলোচনা চলছে, তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাডরা একটি বক্তব্য দিয়েছেন যা মুহূর্তে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক তাঁকে রুপি পতন নিয়ে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন আপনি কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন তাদের জিজ্ঞাসা করুন। অর্থাৎ, BJP কে কটাক্ষ করে তিনি প্রশ্নটি সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের দিকে ফিরিয়ে দেন।
ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেশের সামগ্রিক জনমনে বড় প্রভাব ফেলে। রুপি–ডলার বিনিময় হার সেই বিশেষ সূচকগুলোর একটি, যা অর্থনীতি, বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ এবং মানুষের আস্থা— সবকিছুকে একসাথে মাপতে দেয়।
সেই সূচক যখন নতুন রেকর্ড ভাঙে, অর্থাৎ ভারতীয় রুপি প্রথমবার ৯০ টাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে, তখন শুধু অর্থনীতিই নয়— রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতেই দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাডরা। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি এমন একটি মন্তব্য করেন, যা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়—
তারপর তিনি স্মরণ করিয়ে দেন—
২০১৩ সালে যখন রুপি দুর্বল হয়েছিল, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং–কে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
আজ সেই দৃশ্য ঠিক উল্টো— রুপি সর্বকালের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে এবং বিরোধীদের অভিযোগ— “এখন সরকার কি একই প্রশ্নের উত্তর দেবে?”
এই প্রতিবেদনটি রুপি পতন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বক্তব্যের গভীর বিশ্লেষণমূলক উপস্থাপন।
ভারতীয় রুপির ওপর চাপ গত কয়েক মাস ধরেই বাড়ছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উপাদানের কারণে ডলার শক্তিশালী হচ্ছিল, আর ভারতীয় রুপি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে আসছিল।
সবশেষে রুপি Rs 90/USD–এর কাছে পৌঁছে যায়— যা একটি মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে “বড় ধাক্কা” হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি
ভারতের আমদানি বিল বাড়া (বিশেষ করে তেল)
বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের FPI আউটফ্লো
বৈদেশিক রিজার্ভের চাপ
বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা
মার্কিন সুদের হার বৃদ্ধি
Geopolitical tension— রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিম এশিয়া পরিস্থিতি
এই কারণগুলোর সমন্বয়ে রুপি দুর্বল হয়েছে।
কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল—
“রুপি পড়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?”
তিনি সোজাসুজি বলে দেন—
They questioned Dr Manmohan Singh when the rupee fell.
Ask them the same question now.”**
বাংলায় অর্থ—
“আপনি কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন? তাদের জিজ্ঞাসা করুন।
রুপি পতনের সময় তারা মনমোহন সিং–কে জিজ্ঞাসা করেছিল, ব্যঙ্গ করেছিল।
এখন একই প্রশ্ন তাদেরকেই করুন।”
তার বক্তব্য তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
২০১৩ সালের সময়, রুপির দাম ৬৮–৭০ টাকার দিকে যাচ্ছিল।
তখন নরেন্দ্র মোদী (তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী) বলেছিলেন—
আরও একটি বক্তব্য—
এই বক্তব্যগুলো বিরোধীরা এখন আবার সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মন্তব্যও মূলত এই পুরনো প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত।
রুপি পতন রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের জন্য শক্তিশালী অস্ত্র।
কংগ্রেস বলছে—
মোদী সরকার ১০ বছর ধরে অর্থনীতি পরিচালনা করেছে
কিন্তু এখন রুপি সর্বনিম্ন
“২০১৩-র মতো জবাব দিন”
BJP পালটা বলেছে—
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ
শুধু ভারত নয়, সব দেশই মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা চাপের মুখে
“তুলনা করতে হলে বৈশ্বিক উপাদান যুক্ত করুন”
অর্থনীতিবিদরা বেশি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছেন—
“মুদ্রার মান শুধু সরকারের কারণে পড়ে না। বৈশ্বিক উপাদান বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
রুপি দুর্বল হওয়ার সরাসরি প্রভাব—
জ্বালানি
গাড়ি
ইলেকট্রনিক্স
মোবাইল
গম-ডাল-তেল (আমদানি নির্ভর পণ্য)
টিউশন ফি
হোস্টেল
লোডজিং খরচ
ওষুধ → খাদ্য → পোশাক → পরিবহন
IT সেক্টর
টেক্সটাইল
হ্যান্ডিক্রাফট
সুতরাং রুপি দুর্বলতার একদিকে চাপ, অন্যদিকে সুযোগ।
দেশবিদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন—
“রুপি পড়ছে— এটি বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ। ভারত একা নয়।”
কিন্তু আরেকদল বলছেন—
“যখন আমদানি এত বেশি, তখন রুপির ওপর চাপ আরও বেশি পড়ে। এটি সরকারের নীতি ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের ইঙ্গিত।”
রুপি পতনে RBI বাজারে ডলার বিক্রি করে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করছে।
কারণ—
২০১৩ সালে BJP রুপি পতনে কংগ্রেসকে দোষারোপ করেছিল।
এবার পরিস্থিতি উল্টো।
এটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বার্তা।
এ যেন— “আপনারাই বলেছিলেন, এখন আপনারাই উত্তর দিন।”
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রিয়াঙ্কার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
এ ধরনের মন্তব্য দলকে সংগঠিত করে।
বেশিরভাগ মানুষ পুরনো ভিডিও দেখে তুলনা করছেন।
এ তৈরি করেছে রাজনৈতিক বিতর্ক।
এই সবকিছু মিলিয়ে রুপি চাপের মুখে।
দুটোই।
একদিকে তিনি অর্থনৈতিক দিক থেকে সরকারের দায় চাপিয়েছেন—
“রুপি দুর্বল, সরকার ব্যাখ্যা দিক।”
অন্যদিকে তিনি রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন—
“২০০৯-১৩ সালে BJP যেমন প্রশ্ন করেছিল, এবার তাদের উত্তর দিতে হবে।”
এ বিষয়ে ভুল ধারণা ছড়ায় প্রায়ই।
রুপি দুর্বল মানে—
আমদানি বেশি
ডলার চাহিদা বেশি
বৈশ্বিক অস্থিরতা বেশি
RBI হস্তক্ষেপ সীমিত
কিন্তু এটি সর্বদা সরকারের ব্যর্থতা নয়।
তবে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি রুপি স্থিতিশীল করতে ভূমিকা রাখে।
কারণ—
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ে
মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক
রাজনৈতিকভাবে তুলনা করা সহজ
পূর্বের মন্তব্য থেকে সরকারকে ‘ডিফেন্স’-এ রাখা যায়
মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রে আসে
কংগ্রেস চায়— বিষয়টি জনমনে প্রশ্ন তুলে দিক—
“যারা ২০১৩ সালে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন এখন নীরব?”
BJP বলছে—
রুপি শুধু ভারতেই নয়, অনেক দেশে দুর্বল
বৈশ্বিক অর্থনীতি চাপের মুখে
ভারতের GDP, FDI, ডিজিটাল পরিকাঠামো দ্রুত বাড়ছে
মডেল উন্নয়নই রুপিকে স্থিতিশীল করবে
এটি একটি “ম্যাক্রো ইকোনমিক কন্ট্রোলড রেসপন্স”।
কিছু বিশ্লেষকের মতে—
যদি তেলের দাম আরও বাড়ে
যদি বৈদেশিক রিজার্ভ কমে
যদি যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়ায়
তাহলে রুপি ৯৩–৯৫–এর দিকে যেতে পারে।
এটি ভারতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।
বিরোধী ভাষ্যে শক্তি
পুরনো বক্তব্য মনে করিয়ে দেওয়া
সরকারকে প্রতিরক্ষায় রাখা
“বিশ্বও একই সংকটে” ব্যাখ্যা দেওয়া
ভারতের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সূচক দেখানো
রুপি দুর্বল হওয়া অর্থনীতির জটিল বাস্তবতা।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশে এই ঘটনাকে “বহুমাত্রিক অস্ত্র” হিসেবে দেখা হয়।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বক্তব্য সেই বাস্তবতাকে আরও সামনে এনেছে—
প্রশ্নের উত্তর প্রাপ্য।
শুধু বিরোধীদের নয়— সরকারেরও।
অর্থনীতি ও রাজনীতি এখানে এক জায়গায় এসে মিলেছে।