সলিল চৌধুরী একজন প্রখ্যাত সুরকার শুধু পেশাগত জীবনে নয় ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক সত্তার অধিকারী ছিলেন প্রয়াত সুরকারের জন্মশতবর্ষে, তাঁর কন্যা অন্তরা চৌধুরী তাঁর জীবনের নানা দিক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন অন্তরা চৌধুরী তাঁর বাবার সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁর সাদামাটা জীবনধারা এবং পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন বাবার সহজ-সরল আচরণ এবং তাঁর সঙ্গীতজগতের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা নিয়ে অন্তরা লিখেছেন যা সলিল চৌধুরীকে শুধু একজন সুরকার হিসেবে নয় একজন মহান মানুষ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে
প্রায় ৩০ বছর কেটে গেছে, কিন্তু বাবার শূন্যতা আজও অনুভূত হয় প্রতিটি মুহূর্তে। সলিল চৌধুরী, একজন অমর সুরকার, যাঁর সঙ্গীত আজও আমাদের জীবনে জীবিত। কিন্তু তাঁর শূন্যতা কখনোই পূর্ণ হবে না। বাবা চলে যাওয়ার পর, সেই শূন্যতা মোকাবিলা করতে আমি তাঁর সঙ্গীতকে অবলম্বন করে বেঁচে আছি। বাবার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সন্ধ্যায় তাঁর গান গাইব। বাবার কথা মনে পড়বে, মনে পড়বে সেই সব মুহূর্তগুলো, যখন আমি তাঁর সঙ্গীতের সাথেই ছিলাম।
আজ, বাবার জন্মশতবার্ষিকীতে, তাঁর সঙ্গীত, জীবন এবং মানবিকতার নানা দিক নিয়ে স্মৃতিচারণার সময় এসেছে। বাবার সঙ্গীত এবং তাঁর জীবন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কখনোই কমেনি। সলিল চৌধুরী, একজন বিখ্যাত সুরকার, যাঁর গান আজও শোনা হয় এবং চর্চা করা হয়। কিন্তু বাবা শুধু একজন সুরকারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক, একজন সহজ-সরল মানুষ, যাঁর কাছে কাজ এবং পরিবার উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বাবা আমাকে মানু বলে ডাকতেন এবং আমি সবসময়ই বাবার সাথে থাকতাম। মুম্বইয়ে বেড়ে ওঠার সময়, বাবা কখনও বাবা কখনও ড্যাড,বলে ডাকতেন। আর বাবা তাঁর এই সহজ প্রাকৃতিক আচরণে কখনোই কোনও তফাৎ রাখতেন না। তিনি যে কতটা সহজ-সরল মানুষ ছিলেন, তা তাঁর প্রতিটি আচরণে স্পষ্ট। বাবার একজন বিখ্যাত সুরকার হওয়া সত্ত্বেও, বাড়িতে তিনি ছিলেন একেবারে অন্য মানুষ। বাড়ি ফিরেই তিনি নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, যেমন পাকা চুল দেখিয়ে সন্নাটা নিয়ে আসা বা পায়ে ব্যথা নিয়ে একটু বসে থাকা এসব ছিল তাঁর মানবিক দিক।
যখন আমি বাবাকে বিখ্যাত সুরকার হিসেবে দেখি, তখন বুঝতে পারি, আমার বাবা একজন বিশেষ মানুষ। বাড়িতে আসা অতিথিদের মধ্যে মান্না দে, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর এসব ছিল তাঁর কাজের অংশ। এসব ঘটনা দেখে আমি বুঝতে পারি, বাবা শুধু আমাদের কাছে নয়, সঙ্গীত জগতেও এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। বাবার সঙ্গীত জীবনের প্রতি একাগ্রতা ছিল অভূতপূর্ব। বাড়িতে একদম শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতেন। পিয়ানোতে সুর সৃষ্টি করার সময়, মা তাঁকে স্যুপ খাইয়ে দিতেন, আর আমি তাঁকে পাশে বসে দেখতাম। তাঁর কাজের প্রতি এতটা নিষ্ঠা ছিল, যে তিনি কখনোই কম সময় দেননি, ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে চলতেন।
বাবার জীবনের আরো এক বিশেষ দিক ছিল তাঁর পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা। যতটুকু সঙ্গীতের প্রতি, ঠিক ততটাই পরিবারকে নিয়ে তাঁর দায়িত্ববোধ ছিল। আমার অঙ্ক এবং ফিজিক্সের শিক্ষক ছিলেন বাবা। বাবা কখনোই বকাবকি করতেন না, তবে সঙ্গীতের ফ্লোরে যখন সঙ্গীতশিল্পীরা কোনো সুর বাজাতে পারতেন না, তখন বাবার মন খারাপ হয়ে যেত। তিনি কখনোই রেগে যেতেন না, বরং আমাকে বলতেন, "মানু, মুখটা খুলে গাও। তিনি চাইতেন, আমি যেন সঙ্গীত তৈরি করি, যেন সঙ্গীতের মধ্যে আমার ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।
একটি ছোট ঘটনা মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালে সিস্টার ছবির কোরাসে গান গেয়েছিলাম। পরের বছর, ৭ বছর বয়সে, বাবা আমাকে মিনু ছবিতে কাজ করতে বললেন। বাবা তখন একজন শিশুশিল্পীর কণ্ঠস্বরের সন্ধানে ছিলেন, এবং মা আমাকে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। বাবা রাজি হলেন এবং সেইভাবেই আমার সঙ্গীত সফর শুরু হয়। আমার প্রথম গান ও কালী রে মুম্বইয়ের মেহবুব স্টুডিয়োয় রেকর্ড হয়েছিল। ছোটবেলায় পুতুল খেলতে আমি খুব পছন্দ করতাম, তাই বাবা আমাকে পুতুল নিয়েও গান তৈরি করে দিয়েছিলেন।
বাবা শুধুমাত্র সঙ্গীতকারই ছিলেন না, তিনি একজন অত্যন্ত খাদ্যরসিক মানুষও ছিলেন। মাছের নানা পদ খেতে পছন্দ করতেন, বিশেষত ইলিশ এবং গুলে মাছ। তাছাড়া, তিনি নিজেও খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন। একবার হঠাৎ বাবার মনে হলো বাড়িতে দোসা তৈরি করবেন। পাথরের বিশাল দোসা মেকার নিয়ে এলেন, এবং বাড়ির নীচ থেকে চপ কিনে এনে আমাদের সঙ্গে খেতেন। তাঁর রান্নার কষা মাংসের স্বাদ আমি আজও ভুলতে পারি না। খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর এই অদ্ভুত হুজুগ ছিল, যেমন একদিন বাড়িতে মুড়ি তৈরি করতে বসে গেলেন, এবং সেই মুড়ি ছাতু দিয়ে খেয়ে ফেললেন।
বাবার জীবন ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু রসিকতারও অভাব ছিল না। মুম্বইয়ে থাকাকালীন সকালে পেডার রোডে হাঁটতে যেতেন, কলকাতায় এসে যোগাভ্যাসও করতেন। একবার তিনি মজা করে বলেছিলেন, কী রে, ফোনে ফোন করেছে? তাঁর এই সহজ স্বভাব এবং রসিকতা আমাকে সবসময় আনন্দিত করত।
বাবা একজন চিত্রনাট্যকারও ছিলেন, এবং তাঁর কাছে আমরা অনেক ভূতের গল্প শুনতাম। তাঁর গল্প বলার ধরন ছিল এতটাই অভিনব যে, ছোটবেলায় আমরা সত্যিই ভয় পেতাম। বাবা একটা কাচের বোতলে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে বলতেন, দেখ, ভূত আটকে গিয়েছে, আর ভয় নেই। এখন তোরা ভাল করে ঘুমো।
বাবার প্রতি আমার যে রাগ ছিল না, তা ছিল তাঁর জন্য, বিশেষত যখন তিনি আমাদের ভালোর জন্য কিছু করতেন। আমাকে এবং সঞ্চারীকে বাংলা শেখানোর জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমরা হোস্টেলে থাকতাম, মা-বাবার কাছ থেকে দূরে। প্রথমে অনেক রাগ হয়েছিল, তবে পরে বুঝতে পারলাম যে, বাবা আমাদের ভালোর জন্যই সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ সে সময় হোস্টেল থেকে পড়াশোনার কোন ক্ষতি হয়নি।
বাবা, সলিল চৌধুরী, ছিলেন সঙ্গীত জগতের এক কিংবদন্তী, যাঁর সঙ্গীত আজও আমাদের হৃদয়ে গভীর ছাপ রেখে যায়। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অগাধ, কারণ তিনি শুধু একজন সুরকার ছিলেন না, ছিলেন এক মানবিক ব্যক্তি, যিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলেছিলেন। বাবা সঙ্গীতের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁর প্রভাব শুধু আমাদের সঙ্গীত জীবনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছিল আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকেই।
বাবার সঙ্গীত জীবনে অনেক উত্থান পতন এসেছে, কিন্তু তিনি কখনোই ভেঙে পড়েননি। তাঁর সঙ্গীতের প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং কঠোর পরিশ্রমই ছিল তাঁর সফলতার মূল চাবিকাঠি। বাবা কখনোই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ত্যাগ করেননি, তা ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭৬ সালে সিস্টার ছবির কোরাসে গান গাওয়ার মাধ্যমে আমার সঙ্গীত জীবনের যাত্রা শুরু হয়। পরে বাবার তৈরি করা কিছু জনপ্রিয় গান যেমন ‘বুলবুল পাখি পুজোর গন্ধ এসেছে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে সঙ্গীতের প্রতি আমার ভালোবাসা আরও গভীর করার জন্য।
বাবার সঙ্গীত জীবনের নানা ঘটনা আমাকে শেখায় যে, পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা ছাড়া কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। তিনি একাধারে একজন সুরকার, চিত্রনাট্যকার এবং গায়ক ছিলেন, তবে তার জীবন সঙ্গীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করেছেন। তিনি ছিলেন একজন শিখনপ্রিয় শিক্ষক, যিনি আমাকে অঙ্ক এবং ফিজিক্সের পাঠও দিতেন। কখনো তিনি সঙ্গীত শিখতে বাধ্য করতেন না তবে তার প্রতি নিষ্ঠা এবং সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ভালবাসা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯৯০ সালে ‘আশ্রিতা’ ছবির আবহসঙ্গীত করার পর, মলায়লাম ইন্ডাস্ট্রি থেকেও কাজের সুযোগ আসতে শুরু করে। যদিও বাবা কখনোই তার জনপ্রিয়তা বা খ্যাতির দিকে খুব বেশি মনোযোগী ছিলেন না। তাঁর কাছে সঙ্গীত ছিল সত্যিকারের জীবনদর্শন, যা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল ১৯৯২ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী দিতে চেয়েছিল, তবে বাবার মতে, সঙ্গীতের জন্য স্বীকৃতি পাওয়া ছিল তার জীবনের উদ্দেশ্য নয়, বরং তিনি চান তার কাজ আগামী প্রজন্মের জন্য চিরকালীন হয়ে থাকুক।
বাবার সঙ্গীত এবং জীবনের এই মহান দর্শন আজও আমার পথপ্রদর্শক। বাবার কাজ সংরক্ষণ করার জন্য আমি একটি মিউজিয়াম তৈরির পরিকল্পনা করছি, যাতে তাঁর কাজ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায় এবং সঙ্গীতপ্রেমীরা তার সৃষ্টির প্রকৃত মূল্য জানতে পারে। বাবার জীবনের এই শিক্ষাগুলি আমাদের সকলের জন্য অমূল্য, এবং আমি গর্বিত যে, আমি তাঁর কন্যা হয়ে জন্মেছি।