বিভিন্ন দেশের চিকেন আইটেম নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার আয়োজিত প্রতিযোগিতায় স্বাদের দিক থেকে শীর্ষস্থান দখল করেছে এই অনন্য তুর্কি রান্নাটি। একই তালিকায় ভারতের বিখ্যাত বাটার চিকেন জায়গা করে নিয়েছে পঞ্চম স্থানে।
বিরিয়ানির নাম উচ্চারণ করলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে সোনালি ভাজা পেঁয়াজ, সুগন্ধি মশলায় মাখানো লম্বা দানার ভাত আর তার মাঝখানে নরম রসালো চিকেন বা মাটনের টুকরো। বহু শতাব্দী ধরে উপমহাদেশে বিরিয়ানি মানেই ভাত–মাংসের সুষম মিলন। কিন্তু কখনও ভেবেছেন কি—এই পরিচিত ছবিটা পুরো উল্টে দিলে কেমন দেখাবে? যদি ভাত থাকে ভিতরে, আর বাইরে থাকে মাংসের আবরণ?
তুরস্কে আছে এমনই এক ব্যতিক্রমী, চমকপ্রদ ও রাজকীয় রেসিপি—টোপকাপি। অটোমান সাম্রাজ্যের নামে নামকরণ হওয়া এই খাবারটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে “উল্টো বিরিয়ানি” হিসেবেও পরিচিত। কারণ এর গঠন এবং পরিবেশনার ধরন বিরিয়ানির সঙ্গে যেমন মিল রাখে, তেমনই তার স্বাদের বিন্যাস পুরোপুরি আলাদা। এক কামড়ে পাওয়া যায় মাংসের কোমলতা, মশলায় ভাজা ভাতের উষ্ণতা আর কিশমিশ–কাজুর হালকা মিষ্টতা—এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
টোপকাপির জন্ম তুরস্কের বিখ্যাত টোপকাপি প্যালেসের রাজকীয় রান্নাঘরে। সুলতানদের ভোজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হতো এই খাবার, তাই এর মধ্যে আছে রাজকীয়তা, নিখুঁততা এবং রন্ধন–শৈলীর এক অপূর্ব মিশ্রণ। মুরগির বুকের মাংস পাতলা করে পিটিয়ে তার মধ্যে মশলাদার ভাত ভরা—এই কৌশল তুর্কি রন্ধনশৈলীর সূক্ষ্মতা তুলে ধরে। যেখানে ভারতীয় বিরিয়ানি রান্না হয় হাঁড়িতে স্তর করে, সেখানে তোপকাপি তৈরি হয় ছোট ছোট বলের আকারে, প্রতিটি আলাদা ও নিখুঁত।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থার আয়োজিত আন্তর্জাতিক চিকেন রান্নার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বিভিন্ন দেশের সিগনেচার চিকেন রেসিপিগুলি। সেখানে ভারতের বিশ্ববিখ্যাত বাটার চিকেন পেয়েছে পঞ্চম স্থান। আর একদম শীর্ষে উঠে এসেছে তুরস্কের এই ঐতিহ্যবাহী তোপকাপি। বিচারকদের মতে, এই ডিশে আছে এক বিরল স্বাদের ভারসাম্য—মৃদু মশলার সুগন্ধ, নরম চিকেনের স্তর এবং ভিতরের ভাতের বহুস্তরীয় স্বাদ একসঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করে এক গভীর, সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতা। সেই কারণেই এটি অন্যান্য জনপ্রিয় ডিশকে পিছনে ফেলে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন—টোপকাপিতে এমন কী আছে যে এটি বাটার চিকেনের মতো ক্রিমি, রিচ, বিশ্বখ্যাত খাবারকেও হার মানাতে পারে? আসলে বাটার চিকেন মূলত টমেটো–বাটারের নরম, মোলায়েম গ্রেভির উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তোপকাপির শক্তি এর নির্মাণশৈলীতে—এতে আছে টেক্সচারের খেলা, মশলার সংযত ব্যবহার এবং গঠনগত অভিনবত্ব। বাইরে চিকেনের নরম স্তর, ভিতরে দারচিনি–গোলমরিচ–কিশমিশ–কাজুর মিশ্রণে রান্না করা সুগন্ধি ভাত—এমন রন্ধন কাঠামো বিরল।
টোপকাপি শুধু একটি রেসিপি নয়, বরং একটি রন্ধন–নাটক। কাটার মুহূর্তে দেখা যায়—চিকেনের ভেতর থেকে গরম ভাত বেরিয়ে আসছে, যেন ছোট্ট এক বিরিয়ানির বিস্ময়। এই ভিজ্যুয়াল আকর্ষণই একে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।
সর্বোপরি বলা যায়, তোপকাপি বিরিয়ানির মতো ঘরোয়া স্বাদের সঙ্গে অটোমান দরবারের আভিজাত্যের এক অনন্য সংযোগ তৈরি করে। তাই এটিকে ‘উল্টো বিরিয়ানি’ বলা হলেও, আসলে এটি নিজস্ব স্বাদ–পরিচয়ে এতটাই স্বতন্ত্র যে একে আলাদা শ্রেণিতে রাখাই উচিত। আর যেহেতু এটি এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও স্বীকৃতি পেয়েছে—রন্ধনপ্রেমীদের তালিকায় তোপকাপির স্থান নিশ্চিতভাবেই শীর্ষে।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত টোপকাপি প্যালেস ছিল উসমানীয় সুলতানদের বসবাস। এই প্রাসাদের রন্ধনশালা ছিল মধ্যযুগের অন্যতম বৃহৎ কিচেন, যেখানে রান্না হতো রাজকীয়ভাবে—ধারণা করা হয়, এখানেই জন্ম নিয়েছে এই অসাধারণ খাবারটির।
চিকেনের ভিতরে সুগন্ধি ভাত ভরে রান্না করা—এই কৌশলটি তুর্কি-অটোমান রান্নার ঐতিহ্যকে বহন করে। রান্নাটি যেমন অভিনব, তেমনি শ্রমসাধ্য। সুলতানদের ভোজে পরিবেশন করার মতোই এলিগ্যান্স ও গভীরতা রয়েছে এর প্রতিটি স্তরে।
বাংলাদেশ–ভারত–পাকিস্তানের মানুষের কাছে বিরিয়ানি মানে ভাত–মাংসের সমন্বয়ে তৈরি বহুস্তরীয় স্বাদের বিস্ফোরণ।
কিন্তু তোপকাপিতে—
ভাত থাকে ভিতরে, মশলায় ভাজা, কিশমিশ ও কাজু দিয়ে সমৃদ্ধ
মাংস থাকে বাইরে, পাতলা, মসৃণ এক ধরনের মোড়ক হিসেবে
অর্থাৎ বিরিয়ানিতে যা বাইরের স্তর, তোপকাপিতে তা ভিতরের অংশ। আর বিরিয়ানির যা কেন্দ্রে, তা এখানে বাইরের আবরণ।
এই উল্টো বিন্যাসই তৈরি করেছে “উল্টো বিরিয়ানি” নামের মজাদার উপমা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ফুড জরিপে যখন বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত চিকেন রেসিপির স্বাদ মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে বিচারকদের নজর কাড়ে তুরস্কের এই তোপকাপি।
কারণ—
মশলা কম, কিন্তু গভীর ও সুগন্ধি
মাংসের স্তর নরম, সরস এবং রসালো
ভিতরের ভাতটি লেয়ারড, টেক্সচারে সমৃদ্ধ
এক কামড়েই পাওয়া যায় মাংস–ভাত–মশলার একত্র অভিজ্ঞতা
বাটার চিকেনের মতো রিচ, ক্রিমি, টমেটো–বাটারের সমন্বয় তো পরিচিতই। কিন্তু তোপকাপির স্বাদ একেবারে অন্য রকম—এটি অটোমান দরবারি সৌরভ আর মধ্যপ্রাচ্যের মশলার সূক্ষ্ম সমন্বয়। বিচারকদের একটাই মন্তব্য ছিল—এই ডিশটি স্মার্ট, ব্যালান্সড এবং ডেলিকেটলি ফ্লেভারড।
নিচে দেওয়া হলো তোপকাপির পূর্ণ রেসিপি—তুরস্কে যেভাবে তৈরি হয়, সেই ধারায় সাজানো।
হাড়হীন মুরগির বুকের মাংস—৫টি
লেবুর রস — ১ টেবিল চামচ
নুন — ১ চা চামচ
চিলি ফ্লেক্স — ১ চা চামচ
গোলমরিচগুঁড়ো — ১ চা চামচ
বাসমতি চাল — ১ কাপ (ধুয়ে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখা)
তেল — ১ টেবিল চামচ
পেঁয়াজকুচি — ১টি
কাজুবাদাম কুচানো — ২ টেবিল চামচ
কালো কিশমিশ — ১ টেবিল চামচ (ভিজিয়ে রাখা)
গোলমরিচ, দারচিনি, চিলি ফ্লেক্স — আধ চা চামচ করে
নুন — ১ চা চামচ
গরম জল — আধ কাপ
গরম জল — ১ কাপ
টমেটো বাটা — ১ টেবিল চামচ
রসুনকুচি
পেঁয়াজবাটা
চিলি ফ্লেক্স
নুন ও তেল পরিমাণমতো
মুরগির বুকের মাংস লম্বা করে আড়াআড়ি কাটুন
হালকা চাপ দিয়ে পাতলা ও চওড়া পিস তৈরি করুন
একটি বাটিতে মাংসের টুকরোগুলো লেবুর রস, নুন, গোলমরিচ ও চিলি ফ্লেক্স দিয়ে ১–২ ঘণ্টা মেরিনেট করুন
এতে মাংস হবে নরম, রসালো এবং ভাঁজ করা সহজ।
১. প্যানে তেল গরম করে পেঁয়াজকুচি দিন
2. হালকা সোনালি হলে ভেজানো চাল ঢেলে নাড়ুন
3. কিশমিশ, কাজু, গোলমরিচ, দারচিনি ও চিলি ফ্লেক্স দিন
4. আরও কিছুক্ষণ ভাজুন
5. গরম জল ঢেলে মাঝারি আঁচে রান্না করুন
6. পুরোপুরি জল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আঁচ বন্ধ করুন
ভাত বেশি সেদ্ধ হলে গুটিয়ে যাবে, তাই ৭০–৮০% রান্না হলেই যথেষ্ট।
১. একটি ছোট বাটি নিন
২. তার ভেতরে একটি মাংসের টুকরো বিছিয়ে বাটির মতো আকার করুন
৩. ভিতরে তৈরি ভাতের পুর ভরুন
৪. চারদিক থেকে মাংস মুড়ে পুরোপুরি বলের মতো বানান
এটাই তোপকাপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ—মাংসের কোমল মোড়ক যেন ছিঁড়ে না যায়।
১. প্যানে সামান্য তেল গরম করে রসুন দিন
২. কাঁচা গন্ধ চলে গেলে পেঁয়াজবাটা দিন
৩. তারপরে টমেটো বাটা ও চিলি ফ্লেক্স দিয়ে কষাতে থাকুন
৪. তেল ছাড়লে গরম জল দিন
৫. গ্রেভি ঘন হলে নামিয়ে রাখুন
বেকিং ট্রেতে মাংস–ভাতের বল সাজান
ওপর থেকে গ্রেভি ছড়িয়ে দিন
২০০° C তাপমাত্রায় প্রিহিটেড ওভেনে বেক করুন ৪০ মিনিট
উপরে বাদামি রং এলে বুঝবেন তৈরি হয়ে গেছে আসল তোপকাপি!
১. ভাত ৮০% সেদ্ধ করে নিন
২. মাংস ৩০ মিনিট মেরিনেট রাখলে আরও নরম হবে
৩. প্যানে তেল একটু বেশি দিন
৪. খুব সাবধানে বলগুলো ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ভাজুন
৫. কম আঁচে ঢেকে রান্না করলে ভিতর–বাহির সমানভাবে সেদ্ধ হবে
কিশমিশের মিষ্টতা
কাজুর ক্রাঞ্চ
দারচিনি ও গোলমরিচের মনমাতানো গন্ধ
ভাতের উষ্ণ নরম টেক্সচার
উপরে রোস্ট করা চিকেনের হালকা স্মোকি ফ্লেভার
সব মিলিয়ে এটি তৈরি করে এক অনন্য, সূক্ষ্ম, রাজকীয় স্বাদের স্তর—যা সাধারণ কোনো চিকেন–রাইস ডিশের সাথে তুলনা করা যায় না।
একদিকে আমাদের চেনা বিরিয়ানির ঘরোয়া পরিচিতি—অন্যদিকে তুরস্কের তোপকাপির রাজকীয় নাটকীয়তা। ভাত আর মাংসের এই উল্টো বিন্যাসই তৈরি করেছে এক অবিশ্বাস্য স্বাদ–জাদু, যা বিশ্বজুড়ে ফুড ক্রিটিকদের হৃদয় কাড়ছে।
এতই অনন্য যে আন্তর্জাতিক স্বাদ–তালিকায় বাটার চিকেনের মতো জনপ্রিয় আইটেমকেও পিছনে ফেলেছে।
যারা রান্না করতে ভালোবাসেন বা নতুন কিছু চেষ্টা করতে চান—তাদের জন্য তোপকাপি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে।
আপনি চাইলে চাইলে আমি—
নিউজ–স্টাইলে সংক্ষিপ্ত ভার্সন
সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাপশন
ইউটিউব ভিডিও স্ক্রিপ্ট
বা আর্টিকেলের SEO–অপটিমাইজ করা সংস্করণ