Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

নৈহাটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড মুহূর্তে ছাই হয়ে গেল সব

এই দৃশ্য যেন রাতের অন্ধকার ছিন্ন করে মৃত্যু নীরবতার মতো নেমে এসেছিল পুরো এলাকাজুড়ে। মানুষের চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা আর লাগাতার ধোঁয়ার কুণ্ডলী মুহূর্তেই এলাকাকে আতঙ্কে ঢেকে দেয়। নৈহাটির ব্যস্ত বাজারসংলগ্ন একটি অংশ থেকে রাতের অল্প সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের দোকান, ঘর ও কাঠামোর দিকে। আগুনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে কয়েক মিনিটের মধ্যে অগ্নিকাণ্ড রূপ নেয় ভয়াবহতায়। স্থানীয়রা প্রথমে নিজ উদ্যোগে জল ও বালতি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের শক্তি ছিল এতই প্রচণ্ড যে তাঁদের সব প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। আগুন আকাশ ছুঁয়ে ওঠার মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। আগুনের তাপে আশপাশের বাড়ির জানলার কাচ ভেঙে যায়, রাস্তা দিয়ে যাওয়া মানুষজন তড়িঘড়ি নিরাপদ স্থানে সরে যান। বাতাসের দিকও আগুনকে আরও উসকে দেয়, ফলে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বড় অংশে। দমকল বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে যথেষ্ট সময় লাগে। দমকল কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে আগুনের মোকাবিলা করেন, অনেকক্ষণ ধরে পানির ফোয়ারা ছুঁড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালান। আগুনের ধোঁয়ায় দমকলকর্মী ও স্থানীয় কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকটি টিম একসঙ্গে কাজ করলেও আগুনের দাপট এতটাই ছিল যে এক পর্যায়ে তাঁদের আরও ইউনিট ডাকতে হয়। অগ্নিকাণ্ডে বহু দোকান, ছোট ব্যবসা এবং কিছু বসতভিটা সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অনেক পরিবারের স্বপ্ন, বছরের পর বছর পরিশ্রমের শেষ সম্বল আগুনের লেলিহান শিখায় মুহূর্তেই হারিয়ে যায়। স্থানীয়দের চোখে মুখে সেই হারানো সবকিছুর বেদনা স্পষ্ট। ব্যবসায়ীরা ভোরের আলোতে যখন তাঁদের দোকানের সামনে দাঁড়ান, তখন শুধু পোড়া ইট, কাঠ আর ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জরুরি পরিষেবার তৎপরতায় আগুন অবশেষে নিয়ন্ত্রণে আসে। আহত কয়েকজনকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব নয় তবে এটি যে বড় ধাক্কা, তা চোখে দেখা ধ্বংসস্তূপই বলে দেয়। এই ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দেয় আগুনের মতো বিপর্যয় কত দ্রুত সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে, আর সচেতনতা, প্রস্তুতি ও দ্রুত পদক্ষেপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

নৈহাটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড মুহূর্তে ছাই হয়ে গেল সব
Accident or Fire Incident)

নৈহাটির আকাশে সেই রাতটা যেন আগুনের কমলা আলোয় রাঙা হয়ে উঠেছিল। চারদিক ছিল অস্বস্তি, উত্তেজনা, আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তিতে ভরা। এলাকার মানুষ কেউই কল্পনা করতে পারেননি যে এত শান্ত রাত হঠাৎ করে এমন এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে যাবে, এমন ঘটনার মুখোমুখি মানুষকে দাড় করিয়ে দেবে, যা মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত স্বপ্ন, পরিশ্রম, জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। নৈহাটি শহরের সেই ব্যস্ততম বাজারসংলগ্ন এলাকা বরাবরই জাগ্রত থাকে, রাত হলেও সেখানে সাধারণত অনেক দোকান বন্ধ থাকলেও কিছু দোকানে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ চলে, কোথাও কোথাও শ্রমিকেরা রাতের ট্রাকে মাল লোড আনলোড করে। তাই রাত একটু গভীর হলেও এলাকা খুব কমই নিস্তব্ধ হয়। কিন্তু সেই দিন, যখন রাত প্রায় ১০টা পেরিয়ে গেল, তখনও পরিবেশ ছিল অস্বস্তিকরভাবে শান্ত। এই শান্ত পরিবেশই যেন ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা।

ঠিক তখনই হঠাৎ করেই এক দোকানের পেছন দিক থেকে প্রথম দেখা গেল কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উঠছে। প্রথমে পড়শিরা ভেবেছিলেন সাধারণ কোনো বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যা, অথবা কেউ হয়তো প্লাস্টিক বা আবর্জনা পুড়াচ্ছে। কিন্তু মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সেই ধোঁয়ার পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে বাড়তে থাকে। ধোঁয়ার সঙ্গে পোড়া রাবার আর কাঠের ঘন গন্ধ পুরো গলিটাকে ভরিয়ে তোলে, আর তখনই মানুষ বুঝতে শুরু করে এটা কোনো সাধারণ কিছু নয়। বিপদ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

দুই-চারজন দোকানদার দৌড়ে গিয়ে দোকানের দরজা খুলে ভেতরে তাকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু ততক্ষণে আগুন ভেতর থেকে এমনভাবে বের হতে শুরু করেছে যে কেউ ভেতরে যাওয়ার সাহস পাননি। বিস্ফোরণের মতো শব্দে দোকানের কাচের জানালা ভেঙে মাটিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর সেই সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা বাইরে বেরিয়ে আসে। সেই শিখা মুহূর্তের মধ্যে পাশের দোকান, তার পাশের দোকান, আরও কয়েকটি দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ একদিকে আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে, অন্যদিকে সাহায্যের জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়।

যাদের দোকান জ্বলতে শুরু করেছে, তারা নিজেদের সামান্য যা পাওয়া যায় তা বাঁচানোর তাগিদে ছুটে যান। কেউ ক্যাশবক্স ধরে দৌড়াচ্ছেন, কেউ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র খুঁজে আনার চেষ্টা করছেন, কেউ আবার ভেতরে রাখা স্টকের কিছু অংশ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগুনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে সেগুলো প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ধোঁয়ার ঘন চাদর মানুষের শ্বাস নিতে অসুবিধা তৈরি করে, চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। বাচ্চারা কাঁদতে শুরু করে, নারীরা আতঙ্কে ছুটোছুটি করছেন, বৃদ্ধেরা দাঁড়িয়ে দেখছেন তাঁদের জীবনভর পরিশ্রমের ফল মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

এই ভয়াবহ অবস্থায় কিছু সাহসী যুবক চেষ্টা করলেন আগুনে পানি ঢেলে ছড়িয়ে পড়া আটকাতে। কেউ পাইপের সংযোগ লাগানোর চেষ্টা করলেন, কেউ বালতি ভর্তি পানি আনলেন। কিন্তু আগুন তখন এতটাই তীব্র যে এই ছোট চেষ্টা কোনোভাবেই কার্যকর হচ্ছিল না। আগুন তার নিজের গতিতে আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। বাতাসের প্রবল স্রোত যেন আগুনকে পাখা মেলে উড়তে সাহায্য করছিল। গোটা এলাকা তখন আগুনের আলোয় লাল হয়ে উঠেছে।

দমকলকে খবর দেওয়া হয় দ্রুত। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দমকলের প্রথম ইউনিট এলেও পরিস্থিতি তখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দমকল কর্মীরা গায়ে ভারী পোশাক, মাথায় হেলমেট, হাতে পাইপ নিয়ে আগুনের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। কিন্তু আগুন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে পানি ছুঁড়েও আগুন থামছিল না। আগুনের শব্দ যেন মৃত্যুর মতো গর্জন করে উঠছিল। দমকল কর্মীরা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে একেকটি জায়গায় আগুন ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন।

দমকলের আরও ইউনিট আসতে শুরু করে, সাথে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের একটি দল। পুলিশ দ্রুত রাস্তা বন্ধ করে দেয় যাতে ভিড় না বাড়ে। ভিড় বাড়লে আবার দমকলের কাজেও সমস্যা হয়। কিন্তু মানুষের মনে যে আতঙ্ক, তা এমন কিছুই ছিল যা নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিই কঠিন। মানুষ তাদের জীবনের সঞ্চয় জ্বলতে দেখছে, তাঁদের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, কান্নায় ভেঙে পড়ছে। এমন অবস্থায় কাউকে শান্ত রাখা কঠিন।

এদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় কিছু ঘরের ভেতর থাকা পরিবার ভয় পেয়ে ওঠে। অনেকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মা বাবা বাচ্চাকে বুকে করে দৌড়াচ্ছে, বৃদ্ধরা লাঠি ধরে ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছেন। ধোঁয়ার স্রোত এতটাই ভয়ংকর ছিল যে কয়েকজনকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।

news image
আরও খবর

এই অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে দমকল কর্মীরাও বিপদে পড়ে যান। কয়েকজন ধোঁয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু কাজ থামানো যায় না। আগুনের দাপট এতটাই ছিল যে দমকলকে আরও সাহায্যের জন্য অতিরিক্ত ইউনিট ডাকতে হয়। ফোম ব্যবহার করা হয় আগুনের বিস্তার রোধে। প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আগুনের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, তখন দেখা যায় এলাকার চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যেখানে একসময় দোকানের সারি ছিল সেখানে এখন কেবল পোড়া কাঠ, কালো হয়ে যাওয়া টিনের শীট, ভাঙা কাচ, গলে যাওয়া প্লাস্টিক আর ধোঁয়ার মৃদু কুণ্ডলী ভাসছে। মানুষ সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক। তাঁদের চোখে জল, মনে শূন্যতা, ঠোঁট কেঁপে উঠছে। তারা নিজেদের পরিশ্রম, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ সব তারাই ধরে রেখেছিল সে দোকানগুলোতে। আজ সেগুলো কিছুই নেই শুধু ছাই।

এক দোকানদার তাঁর পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে বসে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছিলেন। কেউ এসে তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে একটি পরিবার তাঁদের দোকানের ভেতর থেকে পুড়ে যাওয়া একটি টুকরো মূর্তি খুঁজে পেয়ে সেটি বুকে জড়িয়ে ধরেছে। আবার এক যুবকের চোখে জল দেখা গেল, তিনি বলছেন আজ সব শেষ হয়ে গেল দাদা, আর উঠতে পারব কিনা জানি না।

পরিস্থিতি এতটাই দুঃখজনক ছিল যে আশেপাশের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে এসে দাঁড়াতে শুরু করেন। কেউ খাবার দেন, কেউ পানি, কেউ কাপড়। কিছু ক্লাব স্বেচ্ছাসেবীরা এসে তাঁবু খাটিয়ে বসে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এলাকার সাধারণ মানুষ। এই মানবিক সহযোগিতা যদিও আগুনে পোড়া স্বপ্ন ফিরিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু কিছুটা হলেও মনকে সান্ত্বনা দেয়।

পরের দিন সকালে যখন সূর্যের আলো পুরো এলাকায় পড়ে, তখন ধ্বংসস্তূপের বাস্তব চেহারা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসন এসে ক্ষতির হিসাব নিতে শুরু করে। দমকল প্রধান জানান, আগুন দ্রুত ছড়ানোর অন্যতম কারণ ছিল দাহ্য পদার্থের আধিক্য। অনেক দোকানে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা ছিল না। কিছু জায়গায় বৈদ্যুতিক সংযোগও ছিল অনিয়মিত। এই অবস্থায় সামান্য স্ফুলিঙ্গও ভয়াবহ বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।

এই অগ্নিকাণ্ড মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেল। শিখিয়ে গেল আগুনের ভয়াবহতা কেমন হতে পারে, শিখিয়ে গেল সচেতনতার গুরুত্ব, শিখিয়ে গেল দোকান বা ঘরে সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতোটা জরুরি। জীবনে আমরা অনেক সময় ভেবে নিই সমস্যা আসবে না, বিপদ হবে না। কিন্তু বিপদ কখনও বলে আসে না সে আসে হঠাৎ, নির্দয়ভাবে, মানুষকে সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে।

কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনার মধ্যেও একটাই আশার আলো দেখা গেল মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এই মানবিক সম্প্রীতি, এই স্নেহ, এই মমতা এসবই মানুষের আসল শক্তি।                                                                                                                

এই ঘটনা মানুষের মনে মনে করিয়ে দেয় যে সচেতনতা, নিরাপত্তা এবং সহানুভূতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আগুনে সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু মানুষের মানবিকতা, একতা এবং সাহায্যের হাত কখনও হারায় না। ধ্বংসের মাঝেও মানুষ পাশে দাঁড়ায়, মানবিক শক্তি প্রদর্শন করে। এই ঘটনার মাধ্যমে মানুষ শিখেছে, বিপদ আসবে কখনো পূর্বাভাস ছাড়াই, কিন্তু মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ালে সবকিছু মোকাবিলা করা যায়।

Preview image