Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

নিজ দেশের গোয়েন্দা রিপোর্ট ঘিরে প্রশ্ন তুললেন ট্রাম্প সৌদি যুবরাজের অজ্ঞতার দাবিতে আলোচনার ঝড়

সাংবাদিক খাসোগি হত্যার সাত বছর পর সৌদি যুবরাজ সলমন মঙ্গলবার আমেরিকা সফরে যান এবং হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন

নিজ দেশের গোয়েন্দা রিপোর্ট ঘিরে প্রশ্ন তুললেন ট্রাম্প সৌদি যুবরাজের অজ্ঞতার দাবিতে আলোচনার ঝড়
International Relations

২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড বিশ্বব্যাপী এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে উঠে আসে। খাসোগি তখন সৌদি আরবের এক কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং আমেরিকার এক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর, তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের সৌদি দূতাবাসে প্রবেশের পর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান এবং পরে জানা যায় যে, তাকে দূতাবাসের ভিতরেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। খাসোগির মৃত্যু বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিবাদের সৃষ্টি করে এবং সৌদি রাজপরিবার বিশেষ করে যুবরাজ মহম্মদ বিল সলমন বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। সৌদি সরকার প্রথম থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অস্বীকার করে এবং বিভিন্ন তথ্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি সরকারের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেই ঘটনার পর প্রায় তিন বছর পর, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদির যুবরাজের পাশে এসে দাঁড়িয়ে এক নতুন দাবির প্রেক্ষাপটে আলোচনায় আসেন। ট্রাম্পের মন্তব্যের পর, এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সৌদি যুবরাজের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সহানুভূতি এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে ট্রাম্প এমন দাবি করেছিলেন। এই দাবির ফলে নতুন করে বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরবের ভূমিকা এবং ট্রাম্পের নীতি নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়ে ওঠে।

সোমবার (১১ নভেম্বর ২০২৫) হোয়াইট হাউসে সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিল সলমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকের সময়, খাসোগি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ উঠলে, ট্রাম্প এক নতুন দাবি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সৌদি যুবরাজ সলমন খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। যদিও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি খাসোগির হত্যাকাণ্ডের সাথে সৌদি যুবরাজের নাম যুক্ত করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, তাতে সৌদির যুবরাজের শক্রতা এবং খাসোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাঁর যোগসাজশ থাকার সম্ভাবনা সন্দেহের মধ্যে ছিল।

২০১৮ সালের খাসোগি হত্যাকাণ্ডের সময়, যখন বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে, সৌদি রাজপরিবার ও বিশেষ করে যুবরাজ সলমনকে ঘিরে নানা ধরনের অভিযোগ তৈরি হয়। এমনকি আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ২০২১ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে দাবি করা হয় যে, খাসোগি হত্যার পেছনে সৌদি যুবরাজের অনুমতি ছাড়া কিছুই সম্ভব ছিল না। ওই রিপোর্টের অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে সৌদি আরবের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলির পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবরাজ সলমনের হাতে, ফলে যুবরাজের সম্মতি ছাড়া কোনও অভিযানের অনুমতি পাওয়া কঠিন ছিল। এই দাবির সঙ্গে আরও যুক্ত ছিল, সৌদি যুবরাজের ব্যক্তিগত নির্দেশেই খাসোগির উপর আক্রমণ হতে পারে।

এমন এক সময়ে, যখন সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠে, ট্রাম্পের এমন মন্তব্য আমেরিকার রাজনৈতিক মঞ্চে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের দাবি ছিল, "এমন একজন ব্যক্তির সম্পর্কে প্রশ্ন করা হচ্ছে, যিনি অত্যন্ত বিতর্কিত।" তিনি আরও বলেন, "খাসোগি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না, তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল, সুতরাং এটা নতুন কিছু নয়।" ট্রাম্প এই সব কথা বলার পর, সাংবাদিকরা যখন যুবরাজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন ট্রাম্প উত্তেজিত হয়ে সোজাসুজি বলেন, "আপনারা মিথ্যা বলছেন"।

এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ট্রাম্পের বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার তাগিদ ছিল। বিশেষত, সৌদির যুবরাজ সলমনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সৌদির সঙ্গে মার্কিন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার দিকে গুরুত্ব দেন ট্রাম্প। এই মন্তব্যে, ট্রাম্পের প্রশাসন সাফ জানিয়ে দেয় যে, সৌদি যুবরাজের প্রতি মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পূর্বের মতই বন্ধুত্বপূর্ণ।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করার সময়, সৌদি যুবরাজ সলমন তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করেন খাসোগি হত্যার ব্যাপারে। ট্রাম্পের মন্তব্যের পর, সলমন তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, "আমি কিছু জানতাম না, এবং আমি এমন কিছু করিনি যা খাসোগির হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।" এর পরেই ট্রাম্প বলেন, "এই বিষয়টি এখানেই বন্ধ করা উচিত এবং আমাদের অতিথিকে বিব্রত করা উচিত নয়।"

news image
আরও খবর

এটি সৌদি যুবরাজের পরিস্কার অস্বীকার, যেখানে তিনি নিজেকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত দাবি করেন। তবে, এই অস্বীকারের পেছনে সৌদি সরকারের প্রচেষ্টা থাকতে পারে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সুনাম পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং খাসোগি হত্যাকাণ্ডের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

খাসোগি হত্যার পর বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে আমেরিকা তুরস্ক এবং ইউরোপে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছিল। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং মানবাধিকার সংগঠন সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছিল। বিশেষ করে আমেরিকার অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিকরা খাসোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য সৌদি রাজপরিবারকে দায়ী করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল এবং অনেক দেশ সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। তবে সৌদি আরব বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে এবং খাসোগির হত্যাকাণ্ডকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয়েছে যে খাসোগি হত্যার সঙ্গে যুবরাজের কোনও সম্পর্ক নেই এবং এটি ছিল কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সিদ্ধান্তের ফল। সৌদি আরবের এই অস্বীকার এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে হত্যাকাণ্ডকে তুলে ধরার চেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এবং এটি সৌদি সরকারের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

২০২১ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা একটি প্রকাশ্য রিপোর্টে দাবি করেছিল যে খাসোগি হত্যার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে সৌদি যুবরাজের অনুমতি ছিল। তবে ট্রাম্প প্রশাসন সেই সময় সৌদির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এবং সৌদি আরবের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে ছিল। এর ফলে সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকার প্রশাসন সৌদি আরবকে নিজেদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে দেখেছিল। ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এমন অবস্থান নেয় যা বিশ্ব রাজনীতিতে এক ধরনের কৌশলগত সম্পর্কের সৃষ্টি করে। এই অবস্থান নৈতিক প্রশ্ন উঠিয়েছিল যেহেতু খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পেছনে সৌদি যুবরাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার অনুমতির বিষয়টি স্পষ্ট হলেও, আমেরিকা সৌদির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। সৌদি আরবের কাছে আমেরিকার আর্থিক এবং সামরিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর ঘটনার পরও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বজায় রাখা একটি বড় বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং সৌদি যুবরাজের প্রতি তার আস্থার প্রকাশ একদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের গুরুত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে অন্যদিকে এটি আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষত ট্রাম্পের বক্তব্য অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে দেখছেন যেখানে সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে তিনি যুবরাজ সলমনের দিকে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছেন। এই মন্তব্যটি বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে যা শুধুমাত্র সৌদি আরবের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের মজবুতির প্রতীক নয় বরং তা গোটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি জটিল সমীকরণকেও প্রভাবিত করে। ট্রাম্পের এই মতামত অনেকের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে বিশেষ করে যখন তিনি খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদির যুবরাজের দোষী হওয়া কিংবা তার পরিণতির বিষয়ে কিছু না বলেই সৌদি যুবরাজকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেয়েছেন। একদিকে সৌদির সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখতে চাওয়া অন্যদিকে ট্রাম্পের এমন বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আমেরিকার নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

খাসোগি হত্যাকাণ্ড আজও একটি অন্যতম গুরুত্বপূৰ্ণ বিষয়। এটি শুধু একটি সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ড নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বেরও প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে মানবাধিকার, রাজনীতি, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সব দিকই জড়িত। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে যে, সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে গেলে কিছু নীতিগত আপোষের প্রয়োজন হয়। তবে, এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া এসেছে, এবং আগামী দিনে এটি আরও গভীর আলোচনা এবং বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

Preview image