Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

ইডি পৌঁছাতেই উন্মত্ত কুকুর কয়লা ব্যবসায়ীর কাণ্ডে তোলপাড়

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, কয়লা চুরি ও পাচার চক্রের অনুসন্ধানেই এই তল্লাশি অভিযান চলছে। অনিল গোয়ল, সঞ্জয় উদ্যোগ, এল বি সিংহ-সহ একাধিক কয়লা ব্যবসায়ীর বিভিন্ন ঠিকানা ও দফতরে একযোগে তল্লাশি শুরু করেছে তদন্তকারীরা।

কয়লা ব্যবসায়ীর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর আধিকারিকদের। কয়লা পাচার, আর্থিক তছরুপ এবং বেআইনি আর্থিক লেনদেন–এই তিনটি অভিযোগের সূত্র ধরেই শুক্রবার সকাল থেকে ইডি ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের একাধিক কয়লা ব্যবসায়ীর ৪০টি ঠিকানায় হানা দেয়। এদিনের অভিযান ছিল বৃহৎ পরিসরে—একযোগে একাধিক রাজ্যে তল্লাশি, আইনি নথিপত্র জোগাড়, সন্দেহভাজনদের বিবৃতি সংগ্রহ এবং অর্থ-লেনদেনের ডিজিটাল ট্রেইল খুঁজে বের করাই ছিল সংস্থার লক্ষ্য।

বহুরাজ্যে তল্লাশি অভিযান


তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কয়লা পাচার চক্রের উপর বিশেষ নজরদারি শুরু করে। ধানবাদ, আসানসোল, রাণীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী বিসিসিএল অঞ্চলের বিভিন্ন কয়লাখনি এলাকায় সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন, অনুমতি ছাড়া কয়লা উত্তোলন এবং অপরাধচক্রের সঙ্গে যুক্ত পরিবহণকারীদের গতিবিধি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছিল। নজরদারির সময় বেশ কয়েকটি স্থানে অস্বাভাবিক পরিমাণ কয়লা সরানোর ইঙ্গিত মেলে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক লেনদেনে অসঙ্গতি, তহবিল ঘোরানোর চক্র এবং ভুয়ো ইনভয়েসের মাধ্যমে বিপুল টাকা সাদা করার প্রমাণও নজরে আসে।

এই তথ্য মিলতেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইডি তাদের প্রাথমিক তদন্ত আরও জোরদার করে। তদন্তকারীরা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক নথি, পরিবহণ সংক্রান্ত কাগজপত্র, খনি এলাকার প্রবেশ-নির্গমনের রেকর্ড এবং সন্দেহভাজন কয়েকটি সংস্থার আর্থিক হিসেব খতিয়ে দেখেন। এই সবকিছু একত্র করেই ইডি সিদ্ধান্ত নেয় বৃহৎ পরিসরে তল্লাশি চালানোর। এরপরেই শুক্রবার ভোর থেকে অনিল গোয়ল, সঞ্জয় উদ্যোগ, এল বি সিংহ-সহ প্রভাবশালী কয়লা ব্যবসায়ীদের বাড়ি, গুদাম, অফিস, সেফ হাউস এবং সংশ্লিষ্ট কয়েক ডজন ঠিকানায় একযোগে অভিযান চালানো হয়। তল্লাশি চলার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পরিবারের সদস্য, কর্মচারী এবং অফিস স্টাফদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

ইডি কর্মকর্তাদের মতে, এই চক্র বহুদিন ধরেই অবৈধভাবে কয়লা উত্তোলন এবং পাচার করে বিপুল অঙ্কের আয় করছিল। সেই টাকাই বিভিন্ন ভুয়ো সংস্থা তৈরি করে বা শেল কোম্পানির মাধ্যমে সাদা করার চেষ্টা হতো। ভুয়ো বিল-ভাউচার, কৃত্রিম ব্যাঙ্ক লেনদেন এবং ফেক লজিস্টিক রেকর্ডের মাধ্যমে টাকা গন্তব্যে পৌঁছত। তদন্তকারীদের দাবি, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এলাকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, পরিবহণকারী, এমনকি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দালালচক্রও।

ইডি সূত্রে আরও জানা গেছে, বেশ কয়েকটি সংস্থার হিসেব মেলেনি বলেই সন্দেহ আরও ঘনিয়েছে। একাধিক লেনদেন ‘অস্বাভাবিক’ মনে হওয়ায় তদন্তকারীরা ধরে নিচ্ছেন, এই চক্রটি যথেষ্ট বড় এবং বহুজন এতে যুক্ত। ব্যবসায়ীদের বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালাতে গিয়েই ইডির হাতে আসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং ডিজিটাল ডিভাইস, যা তদন্তে নতুন দিশা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইডি আধিকারিকেরা জানান, কয়লা চুরি, বেআইনি পাচার, ভুয়ো বিল-ভাউচার এবং বিপুল ব্যাঙ্ক লেনদেনের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার অভিযোগে কয়েক জন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আগেই প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই শুরু হয় এই অভিযানের পরিকল্পনা। তাঁদের কথায়, “আগের তদন্তে যে তথ্য মিলেছিল, তা থেকে পরিষ্কার ছিল—এই চক্রটি শুধুমাত্র কয়লা চুরি নয়, আর্থিক অপরাধের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেই কারণেই এবার বৃহৎ তল্লাশির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

ইডির ধারণা, প্রাপ্ত নথি ও জব্দ করা ডিভাইস বিশ্লেষণ করলে এই পাচার চক্রের আরও একাধিক স্তর সামনে আসতে পারে। প্রয়োজন হলে অভিযুক্তদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোটা তদন্ত এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে—এমনটাই জানিয়েছে ইডি।

ঝাড়খণ্ডে তল্লাশি এবং ‘বিপজ্জনক পরিস্থিতি’

এই সমস্ত তল্লাশি চলাকালীনই ঝাড়খণ্ডের কয়লা ব্যবসায়ী এল বি সিংহের বাড়িতে গিয়ে এক ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হন ইডি-র আধিকারিকেরা। ইডি সূত্রের দাবি, তাঁরা নিয়মমাফিক নোটিশ দেখিয়ে বাড়িতে প্রবেশের পরই তল্লাশি চালানোয় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রথমে মৌখিকভাবে আপত্তি জানানো হলেও তার কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতির মোড় বদলায়।

অভিযোগ অনুযায়ী, ব্যবসায়ী এল বি সিংহ ইডি টিমকে ভয় দেখাতে নিজের পোষ্য কুকুর লেলিয়ে দেন। ঘটনাটি ঘটে প্রবেশপথেই। বাড়িতে ওই সময় উপস্থিত ছিল একটি বড় আকৃতির পোষ্য কুকুর—যে সাধারণত বাড়ির ভেতরে ঘুরে বেড়াত। ইডির টিম বাড়িতে ঢুকেছে জানতে পেরে নাকি তিনি কুকুরটিকে আক্রমণাত্মকভাবে আধিকারিকদের দিকে ধোঁকা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

ইডি-র এক আধিকারিক বলেন,
“আমরা নিয়ম মেনে প্রবেশ করি। প্রথমে আপত্তি তোলা হলেও আমরা নোটিশ দেখালে পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎই পোষ্য কুকুরটিকে আমাদের দিকে তেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সৌভাগ্যবশত আমাদের টিম সতর্ক ছিল।”

ইডির তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ

পোষা কুকুরের হামলার চেষ্টা থেকে বাঁচতে তদন্তকারীরা সাময়িকভাবে পিছিয়ে যান। এরপরই তাঁরা স্থানীয় পুলিশকে খবর দেন। আইনি সহায়তা নিশ্চিত করে ইডি পুনরায় তল্লাশি চালানোর প্রস্তুতি নেয়। আধিকারিকদের দাবি, বাধা সত্ত্বেও তল্লাশি আইনসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় তিনি বাধ্য।

তদন্তকারীরা পরস্পরের সমন্বয়ে বাড়ির বাইরের এলাকা, সিসিটিভি ফুটেজ, গ্যারেজ এবং নথির সম্ভাব্য জায়গাগুলোর প্রাথমিক খোঁজ নেন। বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে স্থানীয় থানার প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ইডি আধিকারিকেরা আবারও তল্লাশির জন্য প্রস্তুতি নেন।

কেন এত বড় অভিযান?

ইডি সূত্র জানায়, কয়লা চুরি এবং পাচার চক্র দীর্ঘদিন ধরেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির ক্ষতি করছে। বেআইনি খনি, অনুমতি ছাড়া কয়লা উত্তোলন, ভুয়ো রেকর্ড, ওজন কম দেখিয়ে বিল তৈরি, এবং তার সঙ্গে যুক্ত বেআইনি আর্থিক লেনদেন—সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

এই চক্রে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সিবিআই, আয়কর দফতর এবং রাজ্যের বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। তবে টাকা সাদা করার দিকটি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব ইডির। আর সেই কারণেই আর্থিক অনিয়মের তদন্তে ইডি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কয়লা ব্যবসায়ীদের নথি এবং ব্যাংক হিসাবের উপর।

news image
আরও খবর

এল বি সিংহ: আগের অভিযোগ, পুরনো ইতিহাস

উল্লেখ্য, প্রায় এক দশক আগে বিসিসিএল (Bharat Coking Coal Limited)-এ দরপত্র বা টেন্ডার নিয়ে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এল বি সিংহের বিরুদ্ধে। সেই সময় সিবিআই তাঁর বাড়ি এবং অফিসে তল্লাশি চালায়। তদন্তকারীদের অভিযোগ ছিল, সরকারি সংস্থার কাজে দুর্নীতি এবং অনুমতি ছাড়া লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেনের প্রমাণ মিলেছিল।

মাত্র এইটুকুই নয়—সেই সময় নাকি সিবিআই কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটে। যদিও ব্যবসায়ী পক্ষ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। কিন্তু সেই ঘটনার পর দীর্ঘদিন তিনি তদন্তের আওতায় ছিলেন। কয়েক বছর পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও নতুন করে আবারও তাঁর নামে তদন্ত শুরু করল ইডি।

এই ধরনের আগের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও, এবারও তদন্তে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় ইডি কঠোর রুখ দেখাতে পারে বলে আইনি মহলের ধারণা।

স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া

ইডির এই তল্লাশি অভিযান এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ব্যবসায়ীর বাসভবনের সামনে কৌতূহলী মানুষজন ভিড় করেন। কেউ কেউ বলেন—

“আমরা শুধু শব্দ শুনলাম। পরে বুঝলাম ইডির টিম এসেছে। হঠাৎই এত পুলিশ দেখা গেল।”

অনেকে আবার মন্তব্য করেন—

“এলাকায় ওঁনার পরিচিতি অনেক। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটবে, ভাবিনি।”

স্থানীয়দের দাবি, এল বি সিংহের বিরুদ্ধে আগেও নানা অভিযোগ শোনা গেলেও সরাসরি এমন নাটকীয় পরিস্থিতি তাঁরা আগে দেখেননি।

তদন্তের পরবর্তী ধাপ

ইডি এখন বাড়ির ভেতর থেকে আর্থিক নথি, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ডিজিটাল ডিভাইস, লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য এবং সন্দেহভাজন ফাইল সংগ্রহ করছে। এছাড়া, কয়লা উত্তোলন, পরিবহণ ও বিক্রি সংক্রান্ত নথিও খতিয়ে দেখা হবে। ইডির এক আধিকারিক জানান—

“এই তদন্ত শুধু দুষ্কৃতীদের শনাক্ত করা নয়—বরং কয়লা পাচারের পুরো ইউনিয়ন-করণের পথটি বোঝাই মূল লক্ষ্য।”

প্রয়োজনে এল বি সিংহকে সমন পাঠানো হতে পারে। অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাঁদের আর্থিক সহযোগী, ট্রানজিট পয়েন্ট, পরিবহণকারী, এবং ভুয়ো কাগজ তৈরি করা চক্রেরও রেকর্ড খতিয়ে দেখছে ইডি।

গোটা কয়লা শিল্পে আতঙ্ক

অনেক কয়লা ব্যবসায়ীই এদিনের তল্লাশির পর নিজেদের অফিসে বাড়তি নজরদারি এবং নথি পরীক্ষা শুরু করেছেন। ব্যবসা মহলে শোনা যাচ্ছে—এটাই কেবল শুরু, সামনের দিনগুলোতে আরও কয়েক দফা তদন্ত চালাতে পারে ইডি। কারণ কয়লা চক্রের আর্থিক পরিমাণ এত বিশাল যে তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে চলার সম্ভাবনা রয়েছে।

সমাপনী মন্তব্য

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, কয়লা শিল্পে আর্থিক দুর্নীতি এবং পাচারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের তদন্ত সংস্থাগুলি অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তল্লাশি অভিযানে বাধা, পোষ্য কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, আগের তদন্তে গুলি চালানোর অভিযোগ—সব মিলিয়ে এল বি সিংহ আবার তদন্তের কেন্দ্রে।

এখন দেখার বিষয়, এই অভিযানের পর কয়লা পাচার চক্রের আরও কোন অসঙ্গতি সামনে আসে এবং তদন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায়।

Preview image