Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

রো–কো জুটিকে রাগিও না কাকে সতর্কবার্তা দিলেন রবি শাস্ত্রী

ভারতীয় ক্রিকেটে রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি যাদের একত্রে বলা হয় রো কো জুটি শুধু বর্তমান সময়ের নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী যুগল। তাদের ব্যাটিং দক্ষতা, নেতৃত্বগুণ এবং ম্যাচ ঘোরানোর ক্ষমতা বহুবার ভারতকে জয়ের পথে নিয়ে গেছে। আর এই দুই সুপারস্টারকে কেন্দ্র করেই এসেছে সাবেক ভারতীয় হেড কোচ রবি শাস্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন রোহিত ও কোহলিকে বিরক্ত করা বা তাদের মনোযোগ নষ্ট করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ, এই দুই তারকা যখন রেগে যান বা চ্যালেঞ্জ অনুভব করেন, তখন তারা আরও দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেন। শাস্ত্রী বহু বছর রোহিত ও কোহলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি জানেন, বড় ম্যাচে কিংবা চাপের মুহূর্তে তাদের মানসিক শক্তি ও দায়িত্ববোধ কতটা তীক্ষ্ণ। মাঠে তারা যেভাবে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখান, তেমনই দলের প্রতি তাদের অঙ্গীকারও গভীর। তাই শাস্ত্রীর মতে, ক্রিকেটের যেকোনো দল বা বিশ্লেষকের উচিত এই দুই তারকার মানসিকতা বুঝে কথা বলা, কারণ তাদের উদ্দীপিত করলে ফলাফল উল্টোও হতে পারে আর সেটি প্রতিপক্ষের জন্য মোটেই সুখকর না। রোহিত কোহলির ব্যাটিং সামর্থ্য বিশ্বের সেরা বোলারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সক্ষম। রোহিতের নির্ভার অথচ বিধ্বংসী স্ট্রোকপ্লে আর কোহলির ধারাবাহিকতা ও আগ্রাসন মিলে তাদের জুটিকে এক প্রকার নাইটমেয়ার বানিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের জন্য। শাস্ত্রী উল্লেখ করেন, এই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার সমন্বয় এতটাই ভয়ঙ্কর যে যখন তারা কোনো সমালোচনা বা চ্যালেঞ্জ দ্বারা উদ্দীপিত হন, তখন তারা আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় রান বর্ষণ করেন।

ভারতীয় ক্রিকেটে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি নাম দুটি শুধু প্রতিভা, সফলতা বা পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই দুটি নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হলে যে ভাবনাটি জন্ম নেয়, সেটি হলো আধুনিক ক্রিকেটের এক অপ্রতিরোধ্য যুগ। ভক্তরা আদর করে যাকে ডাকেন রো–কো জুটি, সেই জুটিকে ঘিরেই ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সবচেয়ে আগ্রাসী অধ্যায়গুলো রচিত হয়েছে। এই দুই মহাতারকাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ভারতের সাবেক প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তা দেশে বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তার বক্তব্য রো–কো জুটিকে রাগিও না একটি সাধারণ সতর্কবার্তা মনে হলেও আসলে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর অর্থ, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এবং ক্রিকেট মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ।

রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি দুজনেই প্রায় একই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। শুরুটা দুজনেরই প্রতিশ্রুতিশীল ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতি রূপ নেয় মহত্ত্বে। তারা নিজেদের নামের পাশে যুক্ত করেন অসংখ্য রেকর্ড, ট্রফি, ম্যাচ উইনিং ইনিংস এবং বিশ্বমঞ্চে ভারতকে তুলে ধরার অনন্য কীর্তি। একজন নিখুঁত টাইমিংয়ের ওস্তাদ, অন্যজন ফিটনেস, ধারাবাহিকতা এবং আগ্রাসনের প্রতিমূর্তি। কিন্তু এই দুই ভিন্ন ধাঁচের ব্যাটার যখন একই দলে, একই ড্রেসিংরুমে, একই লক্ষ্যে যুক্ত হন তখন যে শক্তি সৃষ্টি হয় তা প্রতিপক্ষের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ইতিহাস বলে, যখন রোহিত এবং কোহলি ভালো খেলেন, ভারত প্রায় সব সময় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে।

এই দুই তারকাকে নিয়ে সর্বদাই মিডিয়ার আগ্রহ তুঙ্গে থাকে। কখনো তাদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন, কখনো নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক, কখনো বা তাদের ফর্ম নিয়ে অযথা সমালোচনা সবই চলতে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা গঠনমূলক হলেও অধিকাংশই হয় অযৌক্তিক এবং আবেগনির্ভর। আর এ কারণেই রবি শাস্ত্রীর সতর্কবার্তা এত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বহু বছর ভারতীয় দলের সঙ্গে থেকেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন রোহিত ও কোহলির ব্যক্তিত্ব, চাপের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া, সমালোচনার মুখে তাদের মানসিক দৃঢ়তা। তাই তিনি জানেন, রো–কো জুটিকে উত্তেজিত করা মানে তাদের আরও বিপজ্জনক করে তোলা।

শাস্ত্রী বরাবরই সরাসরি কথা বলেন। তার কথায় কূটনীতির আভাস থাকে না, বরং অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে সত্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন রোহিত আর বিরাট যখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তারা ভেঙে পড়ে না। বরং তাদের চোখে তখন অন্য আলো দেখা যায়। যে আলো বলছে দেখে নাও, কী করতে পারি।কোহলির ক্রিকেট জীবনের অনেক মুহূর্তেই দেখা গেছে সমালোচনার পরই তিনি দুর্দান্তভাবে ফর্মে ফিরে এসেছেন। ২০২১–২২ মৌসুমে দীর্ঘদিন শতক না পাওয়ার পর তাকে নিয়ে যত কথা হয়েছে, ঠিক সেই সময়ই তিনি ফিরে এসেছেন আরও শক্তি নিয়ে। তার ফিটনেস, দৃঢ়তা এবং রান তাড়ানোর ক্ষমতা আবারও জ্বলে উঠেছে। রোহিতের ক্ষেত্রেও ইতিহাস একই কথা বলে। তাকে যখন ধীর ব্যাটসম্যান বলা হয়েছে, তখন তিনি বিশ্বকাপে দেখিয়েছেন পাওয়ারপ্লেতে কীভাবে আগ্রাসী ব্যাটিং করতে হয়। সমালোচনার পর তিনি যেন আরও মনোযোগী হন, আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেন, প্রতিপক্ষের উপর নেমে আসেন এক ঝড়ের মতো।

রোহিত এবং কোহলির মধ্যে সম্পর্কও অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুঁজতে চেয়েছেন, এমনকি মিডিয়ার একটি অংশ বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে। কিন্তু মাঠে এবং মাঠের বাইরে তাদের আচরণ বলে তারা দুইজন পেশাদার, যারা ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতি সমানভাবে নিবেদিত। তারা পরস্পরের সাফল্যে আনন্দিত হন, পরস্পরের ভুলে পরামর্শ দেন, এবং যে ক’বারই একসঙ্গে ব্যাট করেছেন প্রতিবারই দেখা গেছে চমৎকার বোঝাপড়া। শাস্ত্রী এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি জানেন দলের পরিবেশ কেমনভাবে একটি মন্তব্যে বদলে যেতে পারে। অযথা বিতর্ক তৈরি হলে তা শুধু খেলোয়াড়দেরই নয়, পুরো দলকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই তিনি স্পষ্ট বলেন এই দুই সিনিয়র ক্রিকেটারকে সম্মান করতে শিখতে হবে। তারা ভারতের সার্ভিসে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

মাঠে রোহিত কোহলির প্রভাব এমন যে প্রতিপক্ষ দলও জানে তাদের উত্তেজিত করা বিপজ্জনক। ক্রিকেটে অনেক সময় মনস্তাত্ত্বিক খেলা চলে। প্রতিপক্ষ দল চায় একজন সেরা ব্যাটারকে চাপে ফেলে তার স্বাভাবিক রিদম নষ্ট করতে। কিন্তু রোহিত–কোহলির ক্ষেত্রে হিসাবটা উল্টো। তাদের চাপ দিলে তারা আরও শান্ত হয়ে যায়, আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে এবং পরিণতিতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বড় টুর্নামেন্টগুলোতে এটি একাধিকবার দেখা গেছে। ২০১৯ বিশ্বকাপ, ২০২৩ এশিয়া কাপ, ২০২৩ বিশ্বকাপ যেখানে যেখানেই তারা সুযোগ পেয়েছেন, তারা দেখিয়েছেন আধুনিক ক্রিকেটে অভিজ্ঞতা কত বড় সম্পদ।

news image
আরও খবর

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য দলের তরুণ সদস্যদের উপর তাদের প্রভাব। গিল, জাইসওয়াল, রাহুল, সূর্যকুমারের মতো নতুন প্রজন্ম রোহিত ও কোহলির কাছ থেকে শুধু ব্যাটিং শেখেন না, শেখেন চাপ মোকাবেলা করতে, শেখেন জয়ের জন্য কঠোর মানসিকতা তৈরি করতে, শেখেন দেশের হয়ে খেলার দায়িত্ববোধ। শাস্ত্রী নিজেও স্বীকার করেন তরুণরা এমন দুই ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেলে তারা দ্রুত পরিণত হয়ে ওঠে। তাই রো কো জুটিকে সম্মান করা শুধু সিনিয়রদের প্রতি সৌজন্য নয় এটি ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতকে আরও শক্তিশালী করে।

শাস্ত্রীর সতর্কবার্তায় আরও একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে দল নির্বাচনের রাজনীতি। অনেক সময় শোনা যায়, নতুন কম্বিনেশন তৈরি করার নামে সিনিয়রদের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেখানো হয়। কিন্তু শাস্ত্রী মনে করিয়ে দেন রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি শুধু খেলোয়াড় নয়; তারা ম্যাচ পড়তে জানেন, পরিস্থিতি বুঝতে পারেন, দরকারে অধিনায়কের মতো চিন্তা করে মাঠে সিদ্ধান্ত নেন। এই অভিজ্ঞতা কোনও বিশ্লেষণ বা ডেটা দিয়ে মাপা যায় না। যারা তাদের অবমূল্যায়ন করেন, তারা আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের মূল শক্তিকে দুর্বল করার ঝুঁকি তৈরি করেন।

মজার বিষয় হলো, রোহিত কোহলি সম্পর্কে শাস্ত্রীর বার্তা শুধু ভারতীয় সমালোচকদের জন্য নয় বিদেশি প্রতিপক্ষদের জন্যও এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড সব দলেই এমন খেলোয়াড় আছেন যারা সংবাদমাধ্যমে আগুন ধরানোর মতো মন্তব্য করেন। তাদের উদ্দেশ্য মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করা। কিন্তু শাস্ত্রী বলেন ওদের উত্তেজিত করো, বুঝবে কী ভুল করেছ। কারণ মাঠে রোহিত ও কোহলাইনির্ভীক। তারা প্রতিটা চ্যালেঞ্জকে স্বীকার করে নেন যুদ্ধের মতো। বরাবরের মতোই তারা দেশের জন্য সেরাটাই দিতে চান। তাই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা।

এই দু’জনের ক্রিকেট যাত্রা ঘাঁটলে বোঝা যায় তাদের সাফল্যের গল্প চাপ এবং সমালোচনাকে শক্তিতে রূপান্তর করার গল্প। কোহলির কাছে ফিটনেস ধর্মের মতো, ব্যাটিং হলো ধ্যানের মতো। তিনি মনোযোগী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, এবং নিজের দুর্বলতাকে বারবার শক্তিতে রূপান্তর করেন। রোহিত আবার পুরোপুরি অন্য রকম। তিনি শান্ত, স্বচ্ছন্দ, বন্ধুসুলভ, কিন্তু যথাসময়ে আগ্রাসী। তার শট খেলার নৈপুণ্য এবং তাঁর ম্যাচ পড়ার ক্ষমতা তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। এমন দুই ব্যক্তিত্ব যখন একই ড্রেসিংরুমে থাকে, তখন তাদের ওপর নেতিবাচক মন্তব্য শুধু তাদেরই নয়, দলেরও ক্ষতি করতে পারে।

শাস্ত্রী তাই তার অভিজ্ঞতার আলোকে ভারতীয় ক্রিকেটকে একটি বার্তা দিলেন ওদের রাগিও না। এই কথাটির মধ্যে সতর্কতা যেমন আছে, তেমনি আছে আত্মবিশ্বাসও। তিনি জানেন, রোহিত ও কোহলি এখনো ভারতের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের অভিজ্ঞতা, মেধা, দক্ষতা এবং মানসিক দৃঢ়তা ক্রিকেটের যেকোনো পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট। যারা এই জুটিকে অবমূল্যায়ন করেন, তারা আধুনিক ক্রিকেটের বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হন।

সবশেষে বলা যায়, ক্রিকেটে প্রতিভা জন্মায়, হারিয়েও যায়; নতুন প্রজন্ম আসে, পুরোনোরা বিদায় নেয়। কিন্তু কিছু যুগল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। রোহিত কোহলি সেই তালিকায় অন্যতম। তাদের সম্পর্কে রবি শাস্ত্রীর সতর্কবার্তা তাই শুধু একটি মন্তব্য নয়; এটি ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সারাংশ। রো কো জুটিকে রাগানো মানে ক্রিকেটের একটি অজেয় দানবকে জাগিয়ে তোলা। আর যখন সেই দানব জেগে ওঠে তখন মাঠে উৎপন্ন হয় এক ঝড়, এক অগ্নিগর্ভ শক্তি, যা প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিতে পারে।

Preview image