হুড়মুড়িয়ে নামল পারদ, কুয়াশার চাদরে ঢাকল অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম। শীতের আগমনী সুর যেন রাতারাতি বদলে দিল পশ্চিম মেদিনীপুরের এই শান্ত, সবুজে মোড়া জেলার সকালবেলার চেনা দৃশ্য। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই চারদিক ঢেকে গেল ঘন কুয়াশায় যেন কোনো এক অদৃশ্য শিল্পী সাদা তুলি দিয়ে আঁকছে ঝাড়গ্রামের রূপকথার মতো অরণ্যভূমি। শীতের কামড় এবার বেশ তীব্র, আর সেই কারণেই দিনের শুরুতেই মানুষজনের হিমশীতল অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির এই অদ্ভুত আবহ। ঝাড়গ্রামের জঙ্গল ঘেরা পথ, সাঁওতালি গ্রাম আর নদীর তীর সব মিলিয়ে কুয়াশায় মোড়া এক স্বপ্নিল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সকালবেলায় রাস্তায় বেরোলে পাঁচ হাত দূরেই কিছু দেখা যায় না চা দোকানে গরম চায়ের ধোঁয়া আর মানুষের নিঃশ্বাস থেকে বেরোনো বাষ্প মিশে এক অন্যরকম আবেশ তৈরি করছে। স্থানীয় কৃষকদের ক্ষেত খামারেও কুয়াশার আচ্ছাদন স্পষ্ট, যদিও দিনের তাপমাত্রা কিছুটা উঠলেও সকালের ঠান্ডা আবার নেমে আসে সন্ধ্যার পরপরই। জঙ্গলের ভেতর পাখিদের ডাকও যেন বদলে গেছে, কুয়াশার ঘনত্বে তাদের উড়ান যেন আরও সাবধানী। বনবিভাগের কর্মীরা জানাচ্ছেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণীর আচরণেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশাপাশি কুলডিহা, লোধাশুলি, গোপীবল্লভপুরের মতো অরণ্যাঞ্চলগুলোতে মাঝে মধ্যেই কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় পর্যটকদের সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এদিকে পর্যটকদের ভিড়ও বাড়তে শুরু করেছে। শীতের মুখে ঝাড়গ্রামের অরণ্য, জলাশয়, পাহাড়ি পথ আর গ্রামের নিসর্গ যেন আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। অনেকেই পরিবারের সঙ্গে শহরের কোলাহল ছেড়ে এই শান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন। হোটেল, হোমস্টে, ইকো রিসর্টগুলোতেও বুকিং ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাপমাত্রা হঠাৎ নেমে গিয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও এসেছে কিছুটা ধীরগতি। সকালের স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে অফিসপাড়ার মানুষেরও এখন গায়ে চাদর তুলে বেরোতে হয়। রাস্তার পাশের বিক্রেতাদের দোকানে গরম পিঠে, তিলকূট, চিনেবাদাম, খেজুরের গুড়ের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। সব মিলিয়ে শীতের কুয়াশায় মোড়া ঝাড়গ্রাম এখন এক ছবির মতো সুন্দর নরম আলো, শীতল হাওয়া আর প্রকৃতির মোহনীয় নিঃশব্দতা মিলে তৈরি করেছে এক অপরূপ পরিবেশ। শীতের এই চেনা, তবে মনোমুগ্ধকর রূপই যেন আবার নতুন করে প্রেমে পড়তে বাধ্য করছে অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রামের।
হুড়মুড়িয়ে নামল পারদ, কুয়াশার চাদরে ঢাকল অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম। শীতের আগমনী সুর যেন হঠাৎই এক রাতের ভেতর বদলে দিল পশ্চিম মেদিনীপুরের এই সবুজে ঘেরা জেলার প্রতিটি পরিচিত দৃশ্য। বছরের অন্য সময় যে ঝাড়গ্রাম প্রাণবন্ত, তপ্ত, রৌদ্রোজ্জ্বল আর চঞ্চল থাকে শীতের ছোঁয়ায় সেই জায়গাই হয়ে ওঠে রহস্যময়, শান্ত, নিস্তব্ধ, আর নিবিড় প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এক আশ্চর্য মায়াবী ভূমি। ভোরের আলো ফোটার আগেই আসমান থেকে নেমে আসা অসংখ্য সাদা তুলোর মতো কুয়াশা ঢেকে দেয় রাস্তা, গাছপালা, পল্লি, নদীতীর, বনভূমি, পাহাড়ি পথ, সবকিছু। যেন এক অদৃশ্য ছবি-শিল্পী সবার ওপর একই তুলি বুলিয়ে দিয়েছে, সবকিছু মিশে গেছে এক স্নিগ্ধ, নরম, আর্দ্র আবরণে, যেখানে শীতের কামড় থাকলেও আছে এক অদ্ভুত উষ্ণতার আমেজ।
ঝাড়গ্রামের শীত মানেই ভোরবেলার সেই বিশেষ গন্ধ ভেজা মাটির গন্ধ, শুকনো পাতার ওপর জমে থাকা শিশিরের গন্ধ, ধানের গোলার ভেতরে থাকা ধান আর খড়ের তীব্র মাটির গন্ধ, গ্রাম্য চুল্লিতে জ্বাল দেওয়া কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ, আর সবশেষে বনের গভীর থেকে বয়ে আসা এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতার গন্ধ। এই গন্ধগুলো এমনভাবে মিশে যায় যে তাকে আলাদা করে চেনা যায় না, তবে চোখ বন্ধ করলেই বোঝা যায় এ ঝাড়গ্রামের বিশেষ শীতের সুবাস। শহরের কোলাহল, যানজট, ধোঁয়া, কৃত্রিম শব্দ, সবকিছুকে মুছে দিয়ে এই সুবাস যেন ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে প্রকৃতি আবার নতুন করে বেঁচে উঠেছে।
ভোরের অরণ্য তখন ঘুম ঘুম চোখে জেগে ওঠে। সূর্যের আলো প্রথম যখন গাছের ফাঁক দিয়ে পড়ে, তখন কুয়াশা ঠিক সোনালি রঙের নরম আলোকছটায় ভেসে ওঠে। বনের মাঝ দিয়ে হাঁটলে মনে হয় কারও অদৃশ্য স্পর্শ শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে এটা হাওয়া, কিন্তু কেমন যেন এক উষ্ণতার সঙ্গীও। পাখিরা তখনো পুরোপুরি জাগেনি। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসে টিয়ে পাখির ডাক, শালিক, বুলবুল, রাবনদাস, এমনকি কোথাও কোথাও জঙ্গলের আরও গভীরের ডাক যা শীত ছাড়া অন্য সময়ে কম শোনা যায়। জঙ্গলের এই নীরবতা শীতের কুয়াশায় আরও ঘন হয়ে ওঠে। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলো টুপটাপ শব্দ করে পড়ে, আর তার সঙ্গে মিশে থাকে বনজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হরিণ, গাইরাল, খরগোশের সতর্ক পদধ্বনি। সকালবেলার কুয়াশায় প্রাণীরা নিজেদের চলাফেরাও অনেক সময় পরিবর্তন করে নেয় ঝোপের আড়াল থেকে দেখা যায় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা এক-একটি হরিণ পরিবার, বা কচিকাঁচা বানরছানাদের ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে মা বানরের বুকে আশ্রয় নেওয়া।
যখন রাস্তা দিয়ে মানুষজন বেরোতে শুরু করে, তখনো কুয়াশা পুরোপুরি কাটে না। বিশেষ করে ঝাড়গ্রামের অরণ্য ঘেরা পথগুলিতে কুয়াশা যেন স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। কয়েক হাত দূরেও কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। ট্রাক, বাস, বাইক সবাই হেডলাইট জ্বালিয়ে, খুব ধীর গতিতে এগিয়ে চলে। গ্রামের মানুষ একে বলে কুয়াশার দেয়াল যেন কুয়াশাই একটি ঘন, শক্ত, অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে যার ভেতর দিয়ে সাবধানে না চললে পথ হারিয়ে ফেলাও সম্ভব। এই সময় স্কুলমুখী ছোটো ছেলে মেয়েরা গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে, কেউ কেউ উলের টুপি পরে, নাক-মুখ ঢেকে বেরোয়। তাদের ছোটো ছোটো শ্বাসের বাষ্প খুব দ্রুত কুয়াশার সঙ্গে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। কেউ আবার সাইকেলের ক্যারিয়ারে স্কুলব্যাগ বেঁধে, মোটা সোয়েটার পরে সাইকেল চালায় যেন শীতের সঙ্গে লড়াই করেও নতুন দিনের পথে এগিয়ে চলা।
গ্রামের চায়ের দোকানগুলো তখন জমজমাট। ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীল বা সবুজ টিনের দোকান থেকে ভেসে আসে গরম চায়ের উষ্ণ ঘ্রাণ। দোকানি বড়ো হাঁড়িতে দুধ জ্বালাচ্ছেন, আর সেই দুধমেশানো চায়ের ধোঁয়া যেন কুয়াশার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। চায়ের কাপে কাপ লাগলে ঠকঠক শব্দ হয়, আর তার সঙ্গে মিশে যায় মানুষের কথাবার্তা আজ খুব ঠান্ডা পড়েছে, কাল আরও পড়বে কি না, ধান ঠিকমতো শুকোবে কি না, খেজুরের রস কবে নামবে, এবার পাটালি ভালো হবে কি না এসব আলোচনা গ্রামবাংলার শীতের চিরচেনা রূপ।
ঝাড়গ্রামের অরণ্যাঞ্চলের ভেতর ঘুরতে গেলে বোঝা যায় শীত আসলে শুধু তাপমাত্রা কমিয়ে দেয় না এটি পুরো পরিবেশকে, প্রকৃতিকে, মানুষের জীবনধারাকে একেবারে বদলে দেয়। লোধাশুলি, কুলডিহা, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি সংলগ্ন অরণ্য, গোপীবল্লভপুরের জঙ্গল, বিনপুর, বেলপাহাড়ি সব জায়গাতেই একই ছবি। কুয়াশা গাছের ডালে-মগডালে চেপে বসে থাকে। শুকনো সেগুনপাতা, শিরিষপাতা কিংবা শালপাতা শিশিরে ভিজে ভারী হয়ে যায়। হাঁটতে গেলে পায়ের নিচে সেই ভেজা পাতার মৃদু কচমচে শব্দ তৈরি হয়। বনের পথে যে রোদ দুপুরবেলা সরাসরি এসে পড়ে, শীতে সেই রোদও অনেক সময় কুয়াশার চাদর ভেদ করে খুব কমই নেমে আসে। ফলে বিকেলবেলাও শীতের স্বাদ বেশ তীব্র থাকে।
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়গ্রামের খেজুরগাছগুলোতে শুরু হয় রস সংগ্রহের কাজ। ভোরবেলা কুয়াশার মধ্যে যখন গাছের মাথা থেকে নামিয়ে আনা হয় নলেন গুড় তৈরির জন্য অপরূপ মিষ্টি খেজুরের রস, তখন তার স্বাদ, গন্ধ, রূপ সবকিছুতেই থাকে শীতের অনন্যতা। গ্রামের মানুষ রস সংগ্রহকারীদের চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ায়; গরম গরম পাটালি, নলেন গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়। ঝাড়গ্রামের শীত মানেই খেজুরের রস আর তার ঘ্রাণে ভরা ভোর এটি এমন এক স্মৃতি যা বছরের অন্য সময় অনেকেই মনে করতে পারেন না।
এ সময়ে পর্যটকদেরও ভিড় বাড়তে থাকে। শহরের ব্যস্ত মানুষজন ছুটি পেলেই ছুটে আসেন এই সবুজ অরণ্যের কোলে কিছুটা শান্ত সময় কাটাতে। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, ডেয়ারপার্ক, কনকপুর, কেশিয়াড়ি, কানকাবতি নদী, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রামের অরণ্য ট্রেইল সব জায়গাতেই শীতের আমেজ যেন পর্যটকদের জন্য আরও বিশেষ হয়ে ওঠে। কুয়াশা যখন ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকে, তখন বনের ভেতরের সূর্যালোক, শাল-সেগুনের গন্ধ, মাটির স্নিগ্ধতা সবকিছুই পর্যটকদের মনকে অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে দেয়। অনেকে আবার সকালে জঙ্গল সাফারি করতে বেরোন, তখন কুয়াশায় ঘেরা বনভূমির মধ্যে চলার অভিজ্ঞতা এমনই যে মনে হয় পৃথিবীর অন্য কোথাও এর পুনরাবৃত্তি হয় না।
ঝাড়গ্রামের মানুষের জীবনেও শীতের এমন আগমন একদিকে নিয়ে আসে আরামদায়ক পরিবেশ, অন্যদিকে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে কিছু কঠিন সময়ও তৈরি করে। খেত খামারের কাজ করতে বেরোনো কৃষকদের ভোরবেলায় ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তবে কুয়াশা ভিজে থাকা জমিতে সকালের আলো পড়ে যখন জমিকে নতুন রূপে সাজিয়ে দেয়, তখন কৃষকেরা সেই দৃশ্য দেখে দিনের প্রথম ক্লান্তিও ভুলে যান। শীতে ধানের কাটাকাটি, ধান শুকানো, শস্যগোলা ভর্তি করা এগুলোই গ্রামীণ জীবনের পরিচিত দৃশ্য। মহিলারা ঘরে বসে শীতের পোশাক সেলাই করেন, পিঠে তৈরি করেন, শুকনো মাছ ভাজে, কেউ খেজুরগুড়ের পিঠে বানান। সমস্ত গৃহস্থালি কাজের আড়ালেও থাকে শীতের সেই বিশেষ ছোঁয়া যা গ্রামবাংলাকে আরও ঘরোয়া, আরও উষ্ণ, আরও মানবিক করে তোলে।
শীতের সন্ধ্যা নেমে আসতে আসতেই ঝাড়গ্রাম আরও এক অন্য রূপে সেজে ওঠে। কুয়াশা আবার ঘন হতে থাকে, দূরে কোথাও লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো দেখা যায় গ্রাম্য মাঠের মধ্য দিয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথটি সেই আলোকে আরও রহস্যময় করে তোলে। শিশুরা তখন ঘরোয়া উনুনের পাশে বসে গল্প শোনে, বড়রা গরম চা আর পিঠে নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দেয়। কেউ পালা গান গায়, কেউ গল্প করে, কেউ আবার রেডিও চালিয়ে রাখে। শীত যেন মানুষকে কাছাকাছি এনে দেয় সমাজকে আরও উষ্ণ করে তোলে।
এইভাবে কুয়াশার চাদরে মোড়া ঝাড়গ্রাম হয়ে ওঠে বাংলার এক নিখুঁত শীতের শহর। প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য, মানুষের সহজ-সরল জীবন, অরণ্যের গা ছমছমে বিস্তার, ভোরের শিশির, সন্ধ্যার কুয়াশা, গরম পিঠে, খেজুররস এসব মিলিয়ে শীতের ঝাড়গ্রাম যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। এখানে শীত শুধু ঋতু নয়, এটি অনুভূতি, এটি স্মৃতি, এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধনের এক অনন্য অধ্যায়। পারদ যতই নামুক, হিম যতই বাড়ুক, এই কুয়াশার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে ঝাড়গ্রামের সত্যিকারের সৌন্দর্য যা প্রতি বছর শীত নামলেই এক নতুন পরতের রূপে ফুটে ওঠে।