Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

ইমপস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন অভিনেত্রী শেফালি শাহ কী এই রোগ ও সমস্যা

শেফালি শাহ ইমপস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন, যা একটি মানসিক সমস্যা যেখানে ব্যক্তি নিজের কাজ বা যোগ্যতা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেন না

শেফালি শাহ এবং ইমপোস্টার সিনড্রোম: একটি গভীর বিশ্লেষণ

পর্দায় দেখলে মনে হতে পারে অভিনেত্রী শেফালি শাহের অভিনয় নিখুঁত, দাপুটে এবং এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক। তিনি এমনভাবে প্রতিটি চরিত্রে ঢোকে যে দর্শক সহজেই ভাবতে পারেন, তাঁর মনের ভিতরে কোনও দ্বিধা বা ভীতি নেই। অথচ বাস্তবের দুনিয়ায় শেফালির মন সেই ধারার নয়। তাঁর মনের গভীরে অদ্ভুত সব ভাবনা, সন্দেহ এবং আত্ম-প্রত্যয়ের অভাব ডালপালা মেলে বেড়ায়। এই ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং মানসিক চাপ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যেমন প্রভাব ফেলছে, তেমনই তাঁর অভিনয় জীবনেও তার ছাপ রয়েছে। এই এককথায় বলা যায় যে, শেফালি শাহ একদিকে পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয় ও প্রশংসা ভোগ করছেন, অন্যদিকে নিজের কাজের মান নিয়ে ক্রমাগত দ্বিধার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রকাশ করেছেন, “আমি সর্বক্ষণ ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগতে থাকি।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি যে মানসিক সমস্যার সঙ্গে লড়ছেন, তা আজকের সমাজে অত্যন্ত পরিচিত কিন্তু প্রায়ই উপেক্ষিত একটি বিষয়।

ইমপোস্টার সিনড্রোম মূলত একটি মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যেখানে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা এবং অর্জনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। যাঁরা এই সমস্যায় ভুগছেন, তাঁরা নিয়মিত মনে করেন যে তাঁদের কাজ পর্যাপ্ত নয়, তাঁরা সাফল্য পাননি, অথবা যা অর্জন করেছেন তা কেবল ভাগ্য বা অন্যান্য বাহ্যিক কারণে সম্ভব হয়েছে। শেফালি শাহের উদাহরণে দেখা যায়, তিনি জাতীয় পুরস্কারও জিতেছেন, কিন্তু প্রতিটি নতুন কাজ শুরু করার সময় নিজের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান থাকেন। তাঁর জন্য কোনও কাজ কখনও সহজ বা স্বাভাবিক মনে হয় না। কাজটি শেষ করলেও তৃপ্তি আসে সীমিত মাত্রায়, এবং প্রায়শই মনে হয় যে তিনি যথেষ্ট কিছু করতে পারেননি। এ ধরনের অভিজ্ঞতা যেকোনও পেশাজীবী ব্যক্তির জন্য চাপের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যখন সেই ব্যক্তি জনসাধারণের সামনে ক্রমাগত যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, যেমন একজন অভিনেত্রী বা শিল্পী।

শেফালির এই অভিজ্ঞতা অনেক মানুষের জন্য পরিচিত। ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগা মানুষজন প্রায়শই নিজেকে অতিরিক্ত সমালোচনামূলক এবং খুঁতখুঁতে মনে করেন। তাঁরা নিজের কাজকে কখনই সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেন না এবং প্রায়শই নিজের অর্জনকে অবমূল্যায়ন করেন। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা বাইরে থেকে নিখুঁত বা দক্ষ দেখালেও ভিতরে ক্রমাগত আত্ম-সন্দেহের জালে আটকে থাকে। এটি একধরনের মানসিক চাপ, যা দিনের পর দিন কাজের মান, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং সাধারণ আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের সমস্যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে নয়, পেশাগত জীবনেও বড় প্রভাব ফেলে। একজন অভিনেত্রী যেমন শেফালি, যার কাজ প্রায়শই লেন্সের সামনে এবং দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তার ক্ষেত্রে এই চাপ আরও গভীর এবং প্রতিদিনের কাজকে জটিল করে তোলে। কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম বা নিখুঁততা অর্জনের চেষ্টা করতে হয়, যা মানসিক ও শারীরিক উভয় দিকেই চাপ তৈরি করে।

শেফালি জানান যে, ইমপোস্টার সিনড্রোমের কারণে তিনি নিজের প্রতিটি কাজের সময় অতিরিক্ত যত্নশীল হন। তিনি আরও ভাল করার চাপ অনুভব করেন এবং চেষ্টা করেন যে তাঁর অভিনয় সর্বোচ্চ মানের হোক। এই চাপকে তিনি ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “যে দিন কোনও কাজ দেখে মনে হবে, এটা তো আমি সহজেই করে ফেলব, সেই দিন বুঝব, আমার আর নতুন কিছু দেওয়ার নেই।” অর্থাৎ, নিজের ক্ষমতা নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ের অভাব তাঁকে আরও ভাল করার প্রেরণা জুগিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, ইমপোস্টার সিনড্রোমের নেতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও সঠিক মানসিক রূপান্তর করলে এটি একটি মোটিভেশনাল উৎস হিসেবেও কাজ করতে পারে। তবে এটি সবাই সহজভাবে করতে পারেন না। কারণ ভেতরের আত্ম-সন্দেহের চাপ অনেকের জন্য মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ এবং ক্রমাগত চাপের জন্ম দেয়।

বিশ্বব্যাপী ইমপোস্টার সিনড্রোম একটি পরিচিত সমস্যা। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের এক সমীক্ষায় ১১,৪৮৩ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৬২ শতাংশ এই সমস্যায় ভুগছেন। অর্থাৎ আধা বিশ্বের বেশি মানুষ এই মানসিক সমস্যার সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যারা ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন, তাদের আত্মপ্রত্যয়ের অভাব কাজের স্বাভাবিক ছন্দকে প্রভাবিত করে। এটি কেবল পেশাগত জীবন নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা প্রায়শই নিজের অর্জনকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারেন না এবং মনে করেন যে তারা অন্যদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। এই ধরণের সমস্যায় ভোগা মানুষজনকে প্রায়শই খুঁতখুঁতে বা নিখুঁতত্ত্ববাদী বলা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি মানসিক দ্বন্দ্ব এবং আত্ম-সন্দেহের ফল। তাদের জন্য প্রতিটি কাজের প্রতি সন্তুষ্টি অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সাফল্য উপভোগ করা প্রায় অসম্ভব হয়।

অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বিশেষভাবে জটিল। কারণ তাদের কাজ প্রায়ই জনসম্মুখে এবং মানুষের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়। শেফালি শাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভেতরের সন্দেহ তাঁর কাজের প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল করে তোলে। এটি কখনও কখনও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণ হয়। তাঁকে প্রতিটি দৃশ্যে নিখুঁত হতে হয়, যাতে কোনও দোষ বা ত্রুটি দর্শকের কাছে স্পষ্ট না হয়। এই চাপ অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে, যেমন উদ্বেগ, চাপ বা হতাশা। তাই বিশেষজ্ঞরা ইমপোস্টার সিনড্রোমকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেন, যা সময়মতো সমাধান না হলে পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।

news image
আরও খবর

শেফালি শাহের মতো অভিজ্ঞ ও পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীরাও এই সমস্যার সম্মুখীন হন। এটি প্রমাণ করে যে, ইমপোস্টার সিনড্রোম নির্দিষ্ট বয়স বা অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধ নয়। এটি যে কারও জীবনে দেখা দিতে পারে। এমনকি সাফল্য, পরিচিতি বা স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও, ভেতরের সন্দেহ অব্যাহত থাকে। তাই এটি কেবল ব্যক্তিগত স্বীকৃতি বা আত্মবিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং একটি মানসিক সমস্যা যা পেশাগত দক্ষতা এবং মানসিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, এই ধরনের সমস্যায় ভোগা মানুষজনকে প্রথমে নিজেদের অনুভূতি স্বীকার করতে হবে। এটি লুকানো বা উপেক্ষা করা উচিত নয়। তাদের কাছে মানসিক পরামর্শ, থেরাপি এবং আত্ম-স্বীকৃতির প্রক্রিয়া গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, সামাজিক সমর্থনও জরুরি। পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীদের সমর্থন থাকলে ইমপোস্টার সিনড্রোমের নেতিবাচক প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব। থেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আত্ম-সন্দেহ কমানো যায় এবং কাজের প্রতি বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এটি পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন এবং মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

শেফালি শাহের উদাহরণ থেকে দেখা যায়, ইমপোস্টার সিনড্রোম থাকা সত্ত্বেও কেউ তাদের কাজের সেরা মান প্রদর্শন করতে পারেন। শেফালি নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন যে, আত্ম-সন্দেহের চাপ তাঁকে আরও ভাল কাজ করতে প্রেরণা জুগিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, ইমপোস্টার সিনড্রোম সবসময় নেতিবাচক নয়। সঠিক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে, এটি ব্যক্তিকে আরও উজ্জীবিত এবং সৃজনশীল হতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই সচেতনতা অপরিহার্য।

এ ধরনের মানসিক সমস্যার প্রতিক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আত্ম-প্রত্যয় বৃদ্ধি করা। যারা ইমপোস্টার সিনড্রোমে ভুগছেন, তাঁরা প্রায়শই নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকেন। শেফালির অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, নিজের সীমাবদ্ধতা এবং দক্ষতার প্রতি সতর্ক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও, তারা সাফল্য অর্জন করতে পারেন এবং পেশাগত জীবনে দারুণ মানের কাজ উপস্থাপন করতে পারেন। এটি প্রমাণ করে যে, ইমপোস্টার সিনড্রোম থাকা মানেই ব্যক্তির কাজ বা প্রতিভা কম নয়। বরং এটি প্রায়শই তাদের আরও নিখুঁত এবং যত্নশীল হতে প্ররোচিত করে।

বিশ্বব্যাপী অর্ধেকের বেশি মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন, যা দেখায় যে এটি একটি সাধারণ মানসিক সমস্যা। এটি কেবল অভিনয় বা সৃজনশীল পেশায় নয়, ব্যবসা, শিক্ষা, প্রযুক্তি বা যে কোনও পেশায় দেখা যায়। তাই সচেতনতা বাড়ানো, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান এবং প্রয়োজনে থেরাপি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এটি শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, পেশাগত জীবনেও মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।

সংক্ষেপে, শেফালি শাহের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ইমপোস্টার সিনড্রোম থাকা সত্ত্বেও কেউ তার সেরা কাজ করতে পারেন। এটি একটি মানসিক সমস্যার চিত্র হলেও, সঠিক দিকনির্দেশনা, সচেতনতা এবং প্রেরণা থাকলে এটি ব্যক্তিকে আরও সৃজনশীল এবং দক্ষ হতে সাহায্য করে। তবে এটি উপেক্ষা করলে কাজের প্রতি স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হতে পারে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ইমপোস্টার সিনড্রোমকে যথাযথভাবে বুঝে, সচেতনভাবে মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

Preview image