Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

দীর্ঘক্ষণ ডেস্কে কাজ হজম গোলমাল থেকে শরীরব্যথা পুরুষদের যে স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলি জরুরি”

বয়স বাড়ার সঙ্গে পুরুষদের শরীরে নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই বড় রোগ ঘিরে ধরার আগেই কয়েকটি জরুরি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে রাখা সুস্থ জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

বাইরে থেকে একজন পুরুষ যতই শক্ত-সবল, ফিট বা কর্মঠ বলে মনে হোক না কেন, তার শরীরের ভেতরের স্বাস্থ্য কতটা সঠিকভাবে কাজ করছে—তা জানা অত্যন্ত জরুরি। কর্মজীবী পুরুষদের ক্ষেত্রে তো স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়ে, কারণ আধুনিক জীবনে অনিয়মিত সময়সূচি, দীর্ঘক্ষণ ডেস্কে বসে কাজ, রাত জাগা, ধূমপানের মতো অভ্যাস, মানসিক চাপ, ঘুমের অনিয়ম এবং নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব সবকিছু মিলিয়ে শরীরকে ক্রমাগত দুর্বল করে তোলে। কম বয়সে এ সবের প্রভাব সহজে বোঝা না গেলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নানান সমস্যা ধরা পড়তে শুরু করে। তাই বড় কোনও রোগ থাবা বসানোর আগে কয়েকটি জরুরি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নেওয়া পুরুষদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

জীবনযাপনের ধরন ও পুরুষদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

আধুনিক পুরুষের জীবন অত্যন্ত ব্যস্ত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মচাপ, ডেডলাইন, পারফরম্যান্সের চাপ, পরিবারের দায়িত্ব—সব মিলিয়ে মানসিক ও শারীরিক স্ট্রেস এখন প্রতিদিনের সঙ্গী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লিফট-নির্ভরতা, কম হাঁটা, জাঙ্ক ফুড খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া এবং নিয়মিত শরীরচর্চার অভাব। কাজের জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ারে বসে থাকার ফলে পেশিতে টান পড়ে, কোমর-ঘাড়ে ব্যথা শুরু হয়, মেদ জমতে থাকে এবং বিপাকক্রিয়া শ্লথ হয়ে যায়। এর সঙ্গে যদি ধূমপান বা অ্যালকোহলের অভ্যাস যোগ হয়, তাহলে ঝুঁকি আরও বাড়ে।

বহু পুরুষই ব্যস্ততার কারণে শরীরকে গুরুত্ব দেন না। শরীর খারাপ না হলে তাঁরা মনে করেন পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ রোগই প্রথম অবস্থায় ধরা পড়ে না। ডায়াবিটিস, হার্টের ব্যাধি, কোলেস্টেরল বাড়া, হরমোনের সমস্যা, লিভারের জটিলতা, কিডনির অসুখ—এসবই প্রথমে নিঃশব্দে শরীরে বাসা বাঁধে। যখন উপসর্গ দেখা দেয়, তখন অনেক সময়ই রোগ মাঝারি বা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা পুরুষদের জন্য অপরিহার্য।


প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কেন এগুলি জরুরি

নিচে পুরুষদের যে পরীক্ষাগুলি অবশ্যই বছর বছর করা উচিত, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হল:


 ১. ডায়াবিটিস পরীক্ষাঃ HbA1c, Fasting Blood Sugar, Glucose Tolerance Test

পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত যেটি বাড়ছে, তা হল ডায়াবিটিসের ঝুঁকি। অনিয়মিত খাওয়া, ব্যায়াম না করা, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, মানসিক চাপ—এসবের কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকে।

  • HbA1c টেস্ট
    এই পরীক্ষা গত ২–৩ মাসে রক্তে শর্করার গড়মাত্রা কত ছিল, তা জানায়। ডায়াবিটিস আছে কি না, থাকলে কতটা নিয়ন্ত্রণে—এটি সবচেয়ে নির্ভুলভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

  • Fasting Blood Sugar Test
    ৮–১০ ঘণ্টা উপোস থেকে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তি হলে তাৎক্ষণিক সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

  • Glucose Tolerance Test (GTT)
    শরীর কতটা গ্লুকোজ সহ্য করতে পারছে, তা জানায়। প্রি-ডায়াবিটিস ধরা পড়ার ক্ষেত্রে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়াবিটিসের প্রাথমিক লক্ষণ অনেক সময় বোঝা যায় না। তাই বয়স ৩০ পার হওয়া মাত্রিই পুরুষদের বছরে একবার এই তিনটি পরীক্ষা করা উচিত।


 ২. ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাম: হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমাতে

ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে পুরুষরা নারীদের তুলনায় হার্টের রোগে বেশি আক্রান্ত হন। বিশেষ করে অফিসের কাজ, স্ট্রেস এবং অনিয়মিত লাইফস্টাইলের কারণে হৃদ্‌রোগের আশঙ্কা বাড়ে।

  • ECG (Electrocardiogram)
    হৃদ্‌যন্ত্রের বৈদ্যুতিক কাজকর্ম ঠিক আছে কি না দেখায়। হার্ট অ্যাটাক, হার্টবিটের অনিয়ম বা ব্লক ধরা পড়ে।

  • Echocardiography (ECHO)
    হৃদ্‌যন্ত্রের পাম্পিং ক্ষমতা, ভালভের অবস্থা, হার্টে চর্বি বা তরল জমা হচ্ছে কি না—এসব বিস্তারিত দেখা যায়।

যাঁদের পরিবারে হার্টের অসুখের ইতিহাস আছে অথবা যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের জন্য ইসিজি ও ইকো করানো আরও বেশি জরুরি।


৩. লিভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা: SGPT, LFT, আলট্রাসাউন্ড

খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম, অ্যালকোহল সেবন, দূষণ এবং অনিদ্রার কারণে আজকাল পুরুষদের মধ্যে লিভার ফ্যাট বা ফ্যাটি লিভার অত্যন্ত সাধারণ।

  • SGPT (ALT)
    এই এনজাইম বেড়ে গেলে বুঝতে হবে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত তেল-মশলা, চর্বিজাত খাবার বা মদ্যপানের কারণে SGPT বেড়ে যেতে পারে।

  • Liver Function Test (LFT)
    লিভারের বিভিন্ন এনজাইম, বিলিরুবিন, প্রোটিন লেভেল—সব কিছু বিশদে দেখা হয়।

  • Liver Ultrasound
    লিভারে মেদ জমেছে কি না বা লিভারের গঠন বদলাচ্ছে কি না তা জানতে সাহায্য করে।

বছরে অন্তত একবার এই পরীক্ষা করা জরুরি।


৪. লিপিড প্রোফাইল: কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে

উচ্চ কোলেস্টেরল মানেই উচ্চ ঝুঁকি। এটি হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, ব্লকেজ—সবকিছুর সাথে সরাসরি যুক্ত।

লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষায় দেখা হয়

  • ভালো কোলেস্টেরল (HDL)

  • খারাপ কোলেস্টেরল (LDL)

  • ট্রাইগ্লিসারাইড

  • মোট কোলেস্টেরল

যদি LDL বেড়ে যায়, তাহলে তা ধমনীতে চর্বি জমিয়ে ব্লক তৈরি করতে পারে। পুরুষদের বছরে অন্তত একবার লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করানো জরুরি।

news image
আরও খবর

৫. পিএসএ টেস্ট: প্রস্টেটের সুস্থতা জানতে

Prostate Specific Antigen (PSA)’ টেস্ট মূলত প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বোঝাতে সাহায্য করে।

৫০ বছরের পর পুরুষদের মধ্যে প্রস্টেট বড় হওয়া বা প্রস্টেট ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

রক্তে পিএসএর স্বাভাবিক মাত্রা
১ থেকে ৪

৪-এর উপরে গেলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে ডাক্তার Digital Rectal Examination (DRE) করাতে বলেন।

মূত্রত্যাগে সমস্যা, রাতে বারবার বাথরুমে যাওয়া, প্রস্রাব কম বের হওয়া—এসব উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে পরীক্ষা করাতে হবে।


৬. ইউরিন কালচার অ্যান্ড সেন্সিটিভিটি: মূত্রনালির সংক্রমণ এড়াতে

ইউরিন কালচারের মাধ্যমে ধরা পড়ে—

  • প্রস্রাবে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ আছে কি না

  • কোন অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হবে

  • কিডনিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কি না।

বয়স ৩০ থেকে পুরুষদের মূত্রনালির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তাই বছরে একবার পরীক্ষা করানো শ্রেয়।


৭. কিডনি ফাংশন টেস্ট (KFT)

কিডনি শরীরের বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে ফেলে। কিন্তু কিডনি খারাপ হলে প্রথমদিকে তেমন উপসর্গ থাকে না। তাই রক্তে ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, সোডিয়াম, পটাশিয়াম পরীক্ষা করা জরুরি।

ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি হলে বুঝতে হবে কিডনির কাজে সমস্যা হচ্ছে।

ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া—এসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি।


শরীরচর্চা, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা—স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি যা জরুরি

স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুধু রোগ নির্ণয় করে। কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে দৈনন্দিন জীবনেও কিছু পরিবর্তন করা জরুরি—

১. নিয়মিত ব্যায়াম

  • প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০–৪০ মিনিট হাঁটা

  • সপ্তাহে ৩ দিন স্ট্রেংথ ট্রেনিং

  • লম্বা সময় বসে থাকলে প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর ২–৩ মিনিট দাঁড়িয়ে হাঁটা

২. সুষম খাদ্যাভ্যাস

  • তৈলাক্ত খাবার কমানো

  • পর্যাপ্ত ফাইবার

  • চিনি কমানো

  • ফল ও শাকসবজি বেশি

৩. পর্যাপ্ত ঘুম

৭–৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরের হরমোন ঠিক রাখে।

৪. মানসিক চাপ কমানো

ধ্যান, যোগব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

৫. ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়ানো

লিভার, ফুসফুস, হার্ট—সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


উপসংহার

পুরুষদের ক্ষেত্রে কর্মচাপ, পরিশ্রম, মানসিক চাপ ও অনিয়মিত জীবনযাপনের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি দ্রুত বাড়ে। অথচ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে বহু রোগের আগাম সতর্কতা পাওয়া যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা হলে ঝুঁকি অনেকটাই কমে। ডায়াবিটিস, হৃদ্‌রোগ, লিভার-সমস্যা, কোলেস্টেরল, কিডনি বা প্রস্টেটের সমস্যা—সবই নিয়মিত চেক-আপে খুব সহজে ধরা পড়ে। তাই প্রতি বছর অন্তত একবার পুরো শরীরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা পুরুষদের জন্য আজ অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়াও সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম এবং ধূমপান-অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা শরীরকে আরও সুরক্ষিত রাখে। ব্যস্ত জীবনে নিজের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজন। তাই সময় বের করে নিয়মিত পরীক্ষার পাশাপাশি জীবনযাপনেও সচেতন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এ সব অভ্যাস রক্তচাপ, স্ট্রেস হরমোন এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ করতেও বড় ভূমিকা রাখে, যা দীর্ঘমেয়াদি অসুখের ঝুঁকি কমায়। সুস্থ শরীরই কর্মক্ষমতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি, তাই নিজের যত্ন নেওয়াই হওয়া উচিত প্রতিটি পুরুষের প্রথম অগ্রাধিকার। 

Preview image