Lenspedia Bangla Logo
  • কলকাতা
  • 30℃ Purba Bardhaman

“শিক্ষক নিয়োগে প্রতারণা: এসএসসি দাবি করেছে, অনেক প্রার্থী চাকরির জন্য মিথ্যা তথ্য জমা দিয়েছে”

এসএসসির অভিযোগ অনুসারে, অনেক প্রার্থী মিথ্যে তথ্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন — কমিশন এই প্রকৃতিকে ‘নিয়োগ জালিয়াতি’ হিসেবে দেখছেন এবং তদন্ত চালাচ্ছেন।

শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি–কে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক কয়েক বছর ধরেই রাজ্যের শিক্ষাজগতে উত্তাল হয়ে রয়েছে, সেই বিতর্কের নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে কমিশনের সাম্প্রতিক দাবি। কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে যে বহু প্রার্থী নাকি শিক্ষক পদে আবেদন করার সময় তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা অথবা প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভুলভাবে অথবা বিকৃতভাবে জমা দিয়েছেন। এই ভুল তথ্য জমা দেওয়ার ঘটনা শুধুমাত্র সাধারণ ত্রুটি বা অসাবধানতার ফল নয়, বরং প্রার্থীদের একাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে কিংবা চাকরিতে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে এ ধরনের ‘পরিবর্তিত তথ্য’ দিয়েছিলেন—এমনটাই মনে করছে কমিশন। এই ঘটনাই স্বাভাবিকভাবে গোটা শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার সততা, স্বচ্ছতা এবং বিশ্বস্ততা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।

কমিশনের দাবি অনুযায়ী চিহ্নিত এই প্রার্থীদের একটি বড় অংশ নথিপত্র জমা দেওয়ার সময় যে তথ্য লিখেছেন, তা পরে যাচাই-বাছাই পর্বে মিলিয়ে দেখা হলে দেখা যায় যে অনেক তথ্যই বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খায় না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতার সংক্রান্ত তথ্য, যেখানে কিছু আবেদনকারী নিজেদের উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে বলে জানিয়েছেন, অথচ পরে দেখা গেছে তারা সেই ডিগ্রির সঠিক প্রমাণপত্র জমা দিতে পারছেন না বা জমা দেওয়া প্রমাণপত্রে অসঙ্গতি রয়েছে। অনেকে আবার প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির বছর, বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, এমনকি নম্বর বা গ্রেড—এসব বিবরণেও মিলহীনতা রয়েছে। কমিশনের আধিকারিকরা জানিয়েছেন যে এই ধরনের অসঙ্গতির হার উদ্বেগজনক। শিক্ষক নিয়োগের মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রে যেখানে প্রার্থীর যোগ্যতাই মূল ভরসা, সেখানে এই ধরনের ‘মিথ্যে বা ভুল তথ্যের’ উপস্থিতি গোটা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাসকেই নষ্ট করতে পারে।

কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো, সে বিষয়ে প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ বলছে যে প্রতিযোগিতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই নিজেদের আরও যোগ্য প্রমাণ করার প্রবণতায় ভুগছেন। শিক্ষক পদে আবেদনকারীর সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে, কিন্তু শূন্যপদের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় একরকম চাপ তৈরি হয়। এই চাপে কেউ কেউ নথিতে ভুল তথ্য দিয়ে ‘দলে দলে এগিয়ে যাওয়ার’ পথ বেছে নিচ্ছেন। বিশেষত প্রশিক্ষণ সনদের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি বেশি ধরা পড়েছে, কারণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থীর সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে যে কিছু প্রার্থী নাকি প্রশিক্ষণ সমাপ্ত না করেই নিজেদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে দাবি করেছেন, আবার কেউ প্রশিক্ষণের মেয়াদকে বদলে দেখিয়েছেন যেন তারা আগে থেকেই যোগ্য বলে বিবেচিত হন। সব মিলিয়ে নানা স্তরের অসঙ্গতি মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে।

এসএসসি জানিয়েছে যে এই ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে ২৬ জনের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে কমিশনের আশঙ্কা, সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। কারণ একবার অভিযোগ সামনে আসার পর যে ধরনের তথ্যভাণ্ডার ও আবেদনের নথিপত্র খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তা থেকে সম্ভাবনা রয়েছে যে নতুন করে আরও নাম উঠে আসতে পারে। কমিশনের তরফে আরও বলা হয়েছে যে এই তদন্ত কোনওভাবেই ব্যক্তিগত বৈষম্য বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি বৃহত্তর সমস্যার ইঙ্গিত। শিক্ষক নিয়োগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যেখানে যোগ্যতা, সততা, ট্রেনিং এবং শৃঙ্খলা—সব কিছু মিলেই একজন আবেদনকারীর মেধা যাচাই করা হয়, সেখানে ভুল তথ্য দিয়ে সুযোগ পাওয়ার চেষ্টাকে তারা ‘গুরুতর প্রশাসনিক অপরাধ’ হিসেবেই দেখছেন।

এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে চাকরিপ্রার্থীদের মানসিক অবস্থাতেও। যারা সঠিক তথ্য দিয়ে আবেদন করেছেন বা সমস্ত প্রক্রিয়া সততার সঙ্গে পালন করেছেন, তাদের মনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য—কেউ যদি মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করেন, তাহলে তা শুধু ব্যবস্থাকেই কলুষিত করে না, প্রকৃত যোগ্য আবেদনকারীকেও পিছিয়ে দেয়। এই সংক্রান্ত কয়েকজন প্রার্থীর বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, যেখানে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে এতদিন তারা ভেবেছিলেন চূড়ান্ত তালিকায় মেধাকে মূল্যায়ন করা হয়, কিন্তু এই ঘটনা জানার পর তাঁদের মনে হয়েছে যে কেউ কেউ নাকি অবৈধভাবে নিজেদের সুযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কমিশনের এই দাবি সামনে আসার পর সেই বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে।

এদিকে রাজনৈতিক মহলও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। বিরোধী দলগুলো ইতিমধ্যেই অভিযোগ তুলেছে যে শিক্ষক নিয়োগে বহুদিন ধরেই অনিয়ম চলছে, আর এই ঘটনা সেই সন্দেহকে আরও পুষ্ট করছে। বিরোধীদের দাবি, শুধু আবেদনকারী নয়—নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত কিছু স্তরেও নাকি ‘গোপন সমঝোতা’ থাকতে পারে, এবং এই ধরনের ঘটনা তারই ফল। যদিও কমিশনের পক্ষ থেকে এই অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য—ভুল তথ্য জমা দেওয়ার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কর্তাব্যক্তিদের কোনও সম্পর্ক নেই; বরং প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার উপায় খুঁজতে গিয়ে কিছু প্রার্থী একতরফাভাবে ভুল তথ্য দিয়ে আবেদন করেছেন। কমিশন আইনসঙ্গত উপায়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলেই তারা দাবি করেছে।

news image
আরও খবর

তার উপর রয়েছে আদালতে ঝুলে থাকা শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক মামলার চাপ। বিগত কয়েক বছরে নিয়োগ নিয়ে অনেক মামলা উচ্চ আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে, যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে মেধাতালিকা প্রকাশে অনিয়ম, উত্তরপত্রে ভুল মূল্যায়ন, নানা স্তরের সিস্টেম ত্রুটি, এমনকি ঘুষ বা দুর্নীতির অভিযোগও। এরকম পরিস্থিতিতে কমিশন যখন দাবি করছে যে আবেদনকারীরাই মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, তখন আদালতের ওপরও নতুন এক দায়িত্ব তৈরি হয়েছে। বিচারব্যবস্থা যেমন সবসময় প্রমাণ চায়, তেমনি প্রতিটি অভিযোগকে আইনি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ফলে এই ঘটনা আদালতের কার্যপ্রণালীতেও নতুন ঢেউ তুলতে পারে।

এই চিহ্নিত ২৬ জনের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। কমিশন জানিয়েছে যে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে শোকজ নোটিশ পাঠানো হতে পারে, এমনকি যদি প্রমাণিত হয় যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দিয়েছেন, তাহলে তাদের আবেদন বাতিল করা ছাড়াও ভবিষ্যতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও তাদের নিষিদ্ধ করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, যেসব প্রার্থী ইতিমধ্যেই নিয়োগ পেয়ে গেছেন অথচ যাচাইয়ের পরে দেখা যাচ্ছে যে তারা ভুল তথ্য দিয়েছেন, তাদের চাকরিও বাতিল হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কড়া অবস্থান নেওয়ার পক্ষে রয়েছে কমিশনের আধিকারিকেরা, কারণ তারা মনে করেন যে এই নজির ভবিষ্যতে অন্যদেরও সতর্ক করবে।

এই ঘটনার সামাজিক প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক সমাজের অনেকেই মত দিয়েছেন যে একজন শিক্ষক সমাজে জ্ঞানের বাহক, মূল্যবোধের পরিচর্যাকারী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শক। যদি ওই শিক্ষকের নিজস্ব যোগ্যতা নিয়েই সন্দেহ থাকে, তবে তা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। তাই শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও কঠোরতা থাকা জরুরি। এই ধরনের ঘটনাকে শুরুতেই রুখে দেওয়া না গেলে ভবিষ্যতে আরও বড় অনিয়মের সম্ভাবনা থাকে। অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ বলেছেন যে রাষ্ট্রীয় নিয়োগে সততা একধরণের নৈতিক ভিত্তি, যা ভেঙে গেলে পুরো ব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে পড়ে।

সমগ্র ঘটনাটির আরও একটি দিক রয়েছে—তা হলো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার জোরদারকরণ। কমিশন সূত্রের খবর, ভবিষ্যতে নথিপত্র যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আরও কঠোর ডিজিটাল যাচাই প্রক্রিয়া চালু করা হবে। যেমন—যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ এসেছে তা সরাসরি ডিজিটাল পোর্টালে যাচাই করা, প্রশিক্ষণ সনদের কিউআর কোড মিলিয়ে দেখা, নম্বরপত্রে ই-ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করা ইত্যাদি। এসব ব্যবস্থা চালু হলে মিথ্যা নথি দিয়ে আবেদন করার সুযোগ অনেকটাই কমে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে নথির সত্যতা যাচাই করলে পুরো প্রক্রিয়াই সময়সাপেক্ষ কম হবে এবং মানবিক ভুলের সম্ভাবনাও কমে যাবে।

যদিও এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসছে—কেন অনেক প্রার্থী এমন ভুল তথ্য দিতে বাধ্য হলেন? বিশেষজ্ঞদের মতে চাকরি সংকট, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে কম বেতন এবং শিক্ষক পদের আকর্ষণ—সব মিলিয়ে বহু তরুণ-তরুণী সরকারি শিক্ষারক্ষায় চাকরি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ছেন। মরিয়া অবস্থায় অনেকেই হয়তো মনে করছেন যে সামান্য পরিবর্তিত তথ্য দিলে কিছু হবে না। কিন্তু এর ফলাফল যে কত গুরুতর হতে পারে, এই ঘটনাই তা সামনে এনে দিয়েছে। প্রার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি, যাতে তারা ভুল তথ্য দেওয়ার ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত না হন।

কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী এই তদন্ত আরও কিছুদিন চলবে এবং প্রয়োজন হলে বাকি আবেদনগুলিও পুনরায় যাচাই করা হতে পারে। ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগে আরও স্বচ্ছতা আনতে কমিশন নানাবিধ পদক্ষেপ নিতে চলেছে বলেও জানা গেছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রের এই পর্বটি আবার প্রমাণ করল যে স্বচ্ছতা, সততা এবং সঠিক তথ্য ছাড়া কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে বিচার ও জনমত—কোনোটির পরীক্ষাই উত্তীর্ণ হতে পারে না।

Preview image