আইআইটি ছাত্রছাত্রীরা তাদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তির অসাধারণ দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এক প্রদর্শনীতে দেখালেন শতাধিক মডেল। কথা বলা রোবট থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনে চলা বাতি—প্রতিটি প্রকল্পই নজর কেড়েছে দর্শকদের, তুলে ধরেছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সম্ভাবনা।
আইআইটি-র ছাত্রছাত্রীদের উদ্ভাবনী শক্তি এবং বৈজ্ঞানিক দক্ষতা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলে। নানা সময়ে তাঁরা প্রযুক্তির নিত্যনতুন দিক আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে গবেষক মহল পর্যন্ত। সম্প্রতি একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে আইআইটি-র ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের তৈরি করা শতাধিক উদ্ভাবনী প্রকল্প প্রদর্শন করে আবারও প্রমাণ করল যে আগামী দিনের বিজ্ঞানচর্চার মূল নেতৃত্ব তাঁদের হাতেই। এই প্রদর্শনীতে যে পরিমাণ বৈচিত্র্য দেখা গেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। কখনো কথা বলা রোবট, কখনো মোবাইল ফোনে চলা বাতি, কখনো আবার অটোমেটেড হোম সিস্টেম—প্রতিটি মডেলই এমনভাবে তৈরি যে সাধারণ মানুষও সহজেই বুঝতে পারেন বিজ্ঞান কীভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে আলোচিত মডেল ছিল কথাবলা রোবট। এই রোবটটির বিশেষত্ব হলো এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের সাথে কথা বলতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এবং পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। রোবটটির সফটওয়্যার এমনভাবে উন্নত করা হয়েছে যাতে এটি মানুষের কণ্ঠস্বর, আবেগ এবং মুখভঙ্গি বুঝতে পারে এবং সেভাবেই তার প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি বয়স্ক মানুষদের সঙ্গ দেওয়া, রোগীর দেখাশোনা করা বা বাড়ির সিকিউরিটি সিস্টেমের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই রোবট তৈরি করতে তাঁদের দীর্ঘ কয়েক মাস লেগেছে এবং সফটওয়্যার থেকে হার্ডওয়্যার—সব কিছুই ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব গবেষণার ফল।
এছাড়াও প্রদর্শনীতে বিশেষ নজর কেড়েছে এমন একটি বাতি যা সম্পূর্ণরূপে মোবাইল ফোনের শক্তিতে চলে। সাধারণত মোবাইল ফোন থেকে চার্জ নেওয়া যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু মোবাইলের ব্যাটারির অল্প শক্তিকে ব্যবহার করে পুরো ঘর আলোকিত করার মতো ক্ষমতা সম্পন্ন বাতি বানানো সত্যিই অভিনব। ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছেন, এই বাতিটি খুব কম বিদ্যুৎ খরচ করে তাই জরুরি অবস্থায়, বিদ্যুৎ না থাকলে কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। তাঁরা আশা করছেন যে এই প্রকল্পটি ভবিষ্যতে বৃহত্তর পরিসরে উন্নত করা সম্ভব হবে এবং গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
প্রদর্শনীতে আরও দেখা গেছে বিভিন্ন প্রকার স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম। যেমন এমন একটি স্মার্ট হোম মডেল যেখানে বাড়ির সব লাইট, ফ্যান, দরজা, সিকিউরিটি অ্যালার্ম—সবই মোবাইল অ্যাপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই প্রযুক্তিটি স্মার্ট সিটি প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আগামী দিনে শহুরে জীবনে এর ব্যবহার আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছেন, তাঁরা চান এমন প্রযুক্তিগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে যাতে আধুনিক সুবিধা সবাই উপভোগ করতে পারেন।
একটি মডেল ছিল পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস নিয়ে। ছাত্রছাত্রীরা এমন একটি যন্ত্র বানিয়েছেন যা বাতাসের গতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে এবং সেটিও খুব কম খরচে। বড় উইন্ড টারবাইনের মতো না হয়ে এটি খুব ছোট আকারের এবং সহজে বহনযোগ্য। এই যন্ত্রটির উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা বা দুর্যোগের সময় দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। তাঁরা বলেন, দেশের অনেক জায়গায় এখনো বিদ্যুতের অভাব রয়েছে; সেই অভাব মেটাতে এ ধরনের ছোট শক্তির উৎস কতটা কার্যকর তা এই মডেল স্পষ্ট করে দেয়।
আরেকটি মডেল ছিল স্মার্ট হেলথ মনিটরিং সিস্টেম। এই যন্ত্রটি মানুষের শরীরের বিভিন্ন প্রাথমিক তথ্য যেমন হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, শরীরের তাপমাত্রা ইত্যাদি মাপতে পারে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। বিশেষ করে বয়স্ক নাগরিক বা যাঁরা একা থাকেন তাঁদের জন্য এই সিস্টেম অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। যন্ত্রটি অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট পরিবারের সদস্য বা চিকিৎসকের কাছে বার্তা পাঠিয়ে দেবে। ছাত্ররা জানিয়েছেন, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে এই ধরনের প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে আরও নিরাপদ করে তুলতে পারে।
এই প্রদর্শনীর আরেকটি আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন ধরনের রোবোটিক মডেল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি রোবট ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য তৈরি। এটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে ভারী জিনিস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে। ভবিষ্যতে হাসপাতাল, ফ্যাক্টরি বা গুদামঘরে এই রোবট অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ছাত্রছাত্রীরা জানান, দেশের বহু শিল্পক্ষেত্রে এখনো মানবশ্রমই প্রধান ভরসা। সেই প্রেক্ষাপটে যদি এই ধরনের অটোমেশন যুক্ত হয় তাহলে কাজ হবে দ্রুত, নিরাপদ এবং কম খরচে।
প্রদর্শনীতে উপস্থিত দর্শকদের মন্তব্য ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। অনেকেই বলেছেন যে এত কম বয়সে, এত সীমিত সময় এবং সম্পদ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যে মানের প্রযুক্তি তৈরি করেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। শিক্ষকদেরও বলা হয়েছে যে ছাত্রদের এই আগ্রহ এবং প্রচেষ্টাই ভবিষ্যতে ভারতকে প্রযুক্তিগত ভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। তাঁরা মনে করেন, এই ধরনের প্রদর্শনী ছাত্রদের গবেষণার আগ্রহ বাড়ায় এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে।
এই ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে আইআইটি-র ছাত্রছাত্রীরা শুধু নিজেদের প্রতিভাই প্রমাণ করছেন না, বরং দেশের প্রযুক্তি খাতে নতুন দিশা দেখাচ্ছেন। তাঁদের প্রকল্পগুলো প্রমাণ করছে যে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা এবং উদ্ভাবনে সক্ষম। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে যে ধরনের প্রযুক্তি তৈরি হয়, ভারতের ছাত্ররাও সেই মান বজায় রাখতে পারছে এবং অনেক ক্ষেত্রে আরও অভিনব কিছু তৈরি করছে।
এমনকি প্রদর্শনীতে দেখা গেছে কৃষিক্ষেত্র সম্পর্কিত কিছু প্রযুক্তি। যেমন এমন একটি স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা যা মাটির আর্দ্রতার ওপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেচ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে কৃষকের সময় ও শ্রম দুটিই বাঁচে। পাশাপাশি জলের অপব্যবহারও কম হয়। ছাত্ররা জানিয়েছেন, ভারতের কৃষি এখনো প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তাই এই ধরনের প্রযুক্তি কৃষিতে বিপ্লব আনতে পারে।
সব মিলিয়ে এই প্রদর্শনীটি প্রযুক্তি-নির্ভর ভারতের ভবিষ্যতের একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। দেশজুড়ে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বাড়ছে, তেমনি ছাত্রছাত্রীরাও উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসছেন গবেষণা ও উদ্ভাবনের কাজে। তাঁদের তৈরি প্রতিটি মডেলই প্রমাণ করছে যে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং অধ্যবসায় থাকলে বিশ্বমানের প্রযুক্তি তৈরি করাও সম্ভব।
আইআইটি-র এই উদ্যোগ দেশে একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে—বিজ্ঞান আজ শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা শুধুমাত্র পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি; তাঁরা নিজেদের কল্পনা ও গবেষণাকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। আগামী দিনে এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগুলো আরও উন্নত হবে এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে—এটাই প্রত্যা
অন্ধ্রপ্রদেশের ভান্তাসর মন্দিরকে ঘিরে বহুদিন ধরেই একটি রহস্যময় আভা কাজ করে। দেবভূমি অন্ধ্রের বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে এই মন্দিরের পরিচিতি তুলনামূলকভাবে কম হলেও এর অন্তর্গত ইতিহাস, আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস একে এক অনন্য গন্তব্যে পরিণত করেছে। ভান্তাসর মন্দিরের নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই শোনা যায় সেই বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসা কিংবদন্তি, যা এই মন্দিরকে ঘিরে মানুষের হৃদয়ে আলাদা একটি স্থান তৈরি করেছে। মন্দিরটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় এর পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত, নির্জন এবং ধ্যানের জন্য উপযোগী। ভোরবেলা মন্দির চত্বরে দাঁড়ালে সূর্যের আলো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসে মন্দিরের গম্বুজে পড়ার যে দৃশ্য তৈরি করে, তা শুধু চোখে নয়, মনে গেঁথে থাকে অনেকদিন।
এই অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করেন, বহু শতাব্দী আগে এক যোগী গভীর তপস্যার পর এখানে দেবতার উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন এবং সেই অলৌকিক ঘটনার স্মরণে একটি ছোট কাঠের মন্দির নির্মাণ করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কাঠের মন্দির পরে পাথরের নির্মাণে রূপ পায় এবং আজ যে ভান্তাসর মন্দির দাঁড়িয়ে আছে, তা সেই বহু পরিবর্তনেরই ফল। মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবমূর্তির সাজসজ্জা, ধূপের গন্ধ, ঘণ্টার ধ্বনি আর ভক্তদের শান্ত প্রার্থনার শব্দ মিলিয়ে একটি এমন তীব্র আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়—যা এখানে প্রথমবার আসা মানুষকেও আবেগে আচ্ছন্ন করে।
ভান্তাসর মন্দির শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে নানা উৎসব পালিত হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বার্ষিক রথযাত্রা ও দীপোৎসব। উৎসবের দিনে মন্দির এলাকার রাস্তাগুলি রঙিন আলোয় সাজানো হয়, দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে প্রার্থনা করেন এবং পুরো অঞ্চলে এক ধরনের আনন্দের আবহ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় দুধ-ঘি দিয়ে তৈরি প্রাসাদ বা প্রসাদ মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ, যেটি ভক্তরা দূর দেশ থেকেও এসে পাওয়ার চেষ্টা করেন। উৎসব চলাকালীন দিনে ভান্তাসর মন্দির যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে—সংগীত, নৃত্য, ভক্তিগান এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুরো এলাকা এক উৎসবমুখর পরিবেশ ধারণ করে।
এখানে আসার আরেকটি কারণ হলো মনোরম প্রকৃতি। মন্দিরের চারপাশে ঘন সবুজ, দূরে পাহাড়ের সারি ও হালকা বাতাসের স্পর্শ—সব মিলিয়ে এখানে এসে মনে হয় যেন শরীর এবং মন দুটোই নতুন করে পুনর্জীবন লাভ করছে। পর্যটকদের জন্য এখানে বিশেষ বিশ্রামাগার, আধুনিক সু-ব্যবস্থা এবং মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা হয়। ফলে প্রতিদিন বহু ভক্ত ও পর্যটক এখানে এসে শান্তির অনুভূতি নিয়ে ফিরে যান।
সব মিলিয়ে ভান্তাসর মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, কিংবদন্তি, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আজও যারা ব্যস্ত জীবনে একটু শান্তির সন্ধান করছেন, নিজেদের মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হতে চান বা প্রাচীন ঐতিহ্যকে কাছ থেকে অনুভব করতে চান—তাদের জন্য ভান্তাসর মন্দির একটি আদর্শ গন্তব্য। এখানে এসে প্রতিটি মানুষ এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করেন, যা কোথাও থেকেও ভিন্ন এবং অপরিবর্তনীয়। তাই অন্ধ্রপ্রদেশ সফরে ভান্তাসর মন্দিরকে অন্তত একবার না দেখলে সেই যাত্রা সম্পূর্ণ হবে না।