ভেটকি বা ইলিশ নয় চাইলেই কাতলা মাছ দিয়েও তৈরি করা যায় এক অনন্য পাতুরি। সর্ষে–পোস্ত নয়, বরং একেবারে ভিন্ন স্বাদের এক বরিশালির রেসিপি। শীতের দিনে মধ্যাহ্নভোজে একটু স্বাদবদল চাইলে এই বরিশালের কাতল পাতুরি আপনার টেবিলে এনে দেবে নতুনত্ব আর অতুলনীয় ঘ্রাণের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
পাতুরি বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভেটকি মাছ। সুগন্ধি কলাপাতায় মোড়া নরম তুলতুলে সেই মাছের টুকরো, ঘন সর্ষে বাটা আর কাঁচালঙ্কার মিশেলে তৈরি হয়ে যায় এক অনন্য স্বাদের স্মৃতি। ওপরে আবার ধোঁয়া ওঠা ভাত—এই পাতুরির জনপ্রিয়তা বহুদিনের। একইভাবে পাতুরি বলতেই ইলিশকেও অনেকে আলাদা করে মনে করেন। ইলিশের তেলে পাক দেওয়া পাতুরি খেতে যেমন অসাধারণ, তেমনই এটি বাঙালির রান্নার পরম ঐতিহ্যের একটি অংশ। তবে ভেটকি–ইলিশ ছাড়াও পাতুরির তালিকায় যে আরও একটি মাছ সহজেই জায়গা করে নিতে পারে, তা অনেকেই ভাবেন না—সে মাছটি হল কাতলা।
কাতলা মাছ সাধারণত ঝোল, কালিয়া বা ভুনাতেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বরিশালের ঐতিহ্যবাহী রান্নাঘরে কাতলা পাতুরির বিশেষ এক স্থান আছে। সর্ষে-পোস্ত ছাড়াই তৈরি এই পাতুরির স্বাদ একেবারে ভিন্ন ধাঁচের। বরিশালের রান্নায় যেমন মশলার সহজ ব্যবহার, তেমনই থাকে সবজির স্বাভাবিক মিষ্টতা। এই পাতুরিতে তাই মিশে যায় আলু, পেঁয়াজ, টম্যাটো, আদা-রসুনের অনন্য স্বাদ, যা কাতলা মাছের সঙ্গে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পায়। শীতের দুপুরে একটু স্বাদবদল চাইলে এই কাতল পাতুরি কিন্তু আপনার জন্য এক আদর্শ রেসিপি হতে পারে।
শীতকালে বাজারে যখন বড় বড় কাতলা মাছ সহজেই পাওয়া যায়, তখন এই পাতুরি বানানো আরও সহজ হয়ে ওঠে। কাতলার পেটির টুকরোগুলো এই রেসিপির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। পেটির নরম অংশ মশলার সঙ্গে মিশে যেভাবে পরিণত হয়, তা সর্ষের পাতুরি থেকেও আলাদা এক ঘ্রাণ ফুটিয়ে তোলে।
অন্যদিকে বরিশালের রান্নায় সর্ষে বা পোস্তের ব্যবহার কম হলেও সবজির ভূমিকা অনেক বেশি। তাই এই পাতুরিতে আলু, পেঁয়াজ ও টম্যাটোর ঝিরি-ঝিরি কাটা মিশ্রণ মাছকে শুধু নরম করে না, এক আলাদা রসাল ভাবও এনে দেয়। মশলার গন্ধ কলাপাতার সুবাসে ভর করে মাছের মাংসে এমনভাবে মিশে যায় যে প্রথম কামড়েই বুঝতে পারবেন—এটি একেবারেই প্রচলিত পাতুরি নয়, বরং বরিশালের নিজস্ব অবদান।
এই রেসিপিটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল—এর উপকরণ প্রায় সবটাই ঘরে পাওয়া যায়। দরকার কেবল—
৪ টুকরো বড় মাপের কাতলা পেটি
১ কাপ আলু কুচি
১ কাপ পেঁয়াজ কুচি
১ কাপ টম্যাটো কুচি
১ টেবিল চামচ হলুদ বাটা
১ চা চামচ শুকনো লঙ্কা বাটা
১ চা চামচ কাঁচালঙ্কা বাটা
স্বাদ অনুযায়ী নুন
১ টেবিল চামচ জিরে গুঁড়ো
প্রয়োজন মতো সর্ষের তেল
১ টেবিল চামচ রসুনকুচি
১ চা চামচ আদাকুচি
৪টি চেরা কাঁচালঙ্কা
এ ছাড়া প্রয়োজন হবে কলাপাতা ও সুতো।
এত সাধারণ উপকরণ দিয়েই যে এমন অসাধারণ একটি পদ তৈরি করা যায়, সেটাই এই রেসিপির বিশেষত্ব।
একটি পাত্রে কাতলার টুকরোগুলো নিয়ে তাতে দিন—নুন, হলুদ বাটা, শুকনো লঙ্কা বাটা, রসুনকুচি, আদাকুচি ও সর্ষের তেল। খুব ভাল করে মেখে অন্তত আধ ঘণ্টা রেখে দিন।
এই পর্যায়ে মাছ মশলা শুষে নেয়, যা পাতুরি তৈরি হলে দারুণ স্বাদ দেয়।
অন্য একটি বড় বাটিতে আলু কুচি, পেঁয়াজ কুচি, টম্যাটো কুচি, হলুদ বাটা, শুকনো লঙ্কা বাটা, কাঁচালঙ্কা বাটা, জিরে গুঁড়ো ও নুন দিয়ে দিন। সঙ্গে সামান্য সর্ষের তেল ছড়িয়ে ভালভাবে মেখে নিন।
এই মিশ্রণই কাতলা পাতুরির মূল চরিত্র—একেবারে বরিশালির সুবাস।
কলাপাতা চৌকো করে কেটে গ্যাসের ওপর হালকা সেঁকে নিন। এতে পাতা নরম হবে এবং ভাঁজ করতে সুবিধা হবে।
একটি কলাপাতা নিয়ে তার ওপর প্রথমে কিছু সবজির মিশ্রণ বিছিয়ে দিন। তার ওপর একটি কাতলার টুকরো রাখুন। উপরে আবারও সবজির মিশ্রণ দিন এবং শেষে একটি চেরা কাঁচালঙ্কা রাখুন।
এবার কলাপাতা চার দিক থেকে ভাঁজ করে সুতো দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দিন।
একটি কড়াইতে জল গরম করুন। তার ওপর একটি স্ট্যান্ড রেখে তার ওপর ছিদ্রযুক্ত স্টিমার পাত্র বসান। সাজানো পাতুরিগুলো স্টিমারে রাখুন।
কড়াইয়ের ঢাকনা ভালভাবে লাগিয়ে দিন এবং ১৫ মিনিট স্টিম করুন।
সময় শেষ হলে গ্যাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঢাকা অবস্থাতেই থাকতে দিন।
একেবারে তৈরি বরিশালের কাতল পাতুরি—গন্ধেই বুঝতে পারবেন এর স্বাদ কতটা অনন্য।
এই পাতুরিতে সর্ষে-পোস্ত নেই, কিন্তু আলু–পেঁয়াজ–টম্যাটোর বিশেষ মিশ্রণ একটি ব্যালান্সড মিষ্টতা এনে দেয়।
কাতলার পেটির নরম অংশ মশলার সঙ্গে মিশে অন্যরকম জুসি টেক্সচার তৈরি করে।
কলাপাতার ধোঁয়াটে সুবাস মাছের ভেতরে ঢুকে একেবারে বরিশালের রান্নার আসল চরিত্র ফুটিয়ে তোলে।
খেতে হালকা, কিন্তু ঘ্রাণে ও স্বাদে অতি সমৃদ্ধ।
কোন ভোজে সবচেয়ে উপযুক্ত?
শীতের দুপুরে ভাত, ডাল, ভাজা—সবকিছুর সঙ্গে দারুণ মানিয়ে যায় এই পাতুরি। অতিথি আপ্যায়নে, উৎসবের দিনে বা সপ্তাহান্তে একটু ভিন্ন স্বাদ চাইলে এটি অত্যন্ত উপযুক্ত পদ। রেসিপিটি খুব সহজ হলেও এর স্বাদ কিন্তু রেস্তোরাঁ-মানের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়।
পাতুরি মানেই আমাদের মনে প্রথমেই ভেসে ওঠে সর্ষে-মাখা ভেটকি বা ইলিশের ছবি। বহুদিন ধরে বাঙালির রান্নাঘরে এই দুটি পাতুরিই সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয়। কিন্তু রান্নার জগতে নতুনত্বের কোনও শেষ নেই। তাই প্রচলিত ধারনা ভেঙে বরিশালের কাতল পাতুরি আমাদের সামনে তুলে ধরে এক সম্পূর্ণ আলাদা ও চমকপ্রদ স্বাদ। সর্ষে বা পোস্ত ছাড়াই যে পাতুরি এত অসাধারণ হতে পারে, তা অনেকের ধারণাতেই নেই। কাতলার পেটির টুকরো, সরল মশলা, আলু–পেঁয়াজ–টম্যাটোর ঝিরি ঝিরি কুচি আর কলাপাতার মনোরম সুবাস—সব মিলিয়ে এই রেসিপিটি যেন একেবারে অন্যধারার পাতুরি, যার প্রতিটি কামড়ে পাওয়া যায় এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
বরিশালের রান্নায় যে সরলতা এবং স্বাদের ভারসাম্য দেখা যায়, তা এই পাতুরিতেও স্পষ্ট। এখানে কোনও জটিল মশলা নেই, নেই অতিরিক্ত ঝাঁঝাল ভাব। তবুও মাছের মাংসে যে গভীর স্বাদ মিশে যায়, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। কলাপাতায় ভাঁজ করে স্টিমে রান্না করার ফলে মশলার গন্ধ মাছের ভেতরে পুরোপুরি ঢুকে পড়ে, আর পাতার ধোঁয়াটে সুবাস মাছকে আরও নরম, রসালো ও সুস্বাদু করে তোলে। বিশেষ করে কাতলার পেটির অংশ এই রান্নায় অসাধারণভাবে মানিয়ে যায়—এর নরম টেক্সচার ও সামান্য তেলের পরিমাণ পাতুরির মশলার সঙ্গে এক অপূর্ব সামঞ্জস্য তৈরি করে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল—এই পাতুরি তৈরি করতে সময় অত্যন্ত কম লাগে। আধ ঘণ্টার মতো মেরিনেশন, তারপর মাত্র ১৫ মিনিট স্টিমিং—এই দুই ধাপেই পুরো রান্না শেষ। কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই, খুব অল্প সময়ে, সাধারণ উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় এমন একটি পদ, যা অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে বিশেষ দিনের ভোজ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই প্রশংসা কুড়োতে বাধ্য। যারা অফিস বা কাজের চাপে তাড়াহুড়োর মধ্যে রান্না করেন, তাঁদের জন্যও এটি একটি চমৎকার রেসিপি।
যারা মাছ ভালবাসেন কিন্তু সবসময় একই স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাঁদের জন্য বরিশালের এই কাতল পাতুরি এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এখানে নেই সেই পরিচিত সর্ষের তীব্র ঘ্রাণ, নেই পোস্তর নরম টেক্সচার—বরং আছে সম্পূর্ণ আলাদা এক ঘরানার পরিমিত স্বাদ। আলু–পেঁয়াজ–টম্যাটোর স্নিগ্ধতা মাছকে দেয় কোমলতা, আর হালকা লঙ্কার ঝাঁজ খাবারে নিয়ে আসে পরিমিত উত্তেজনা। ফলে এটি তাঁদের জন্য আদর্শ, যারা তীব্র ঝাল বা অতিরিক্ত মশলায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
শীতের দুপুরে রোদ পোহাতে পোহাতে গরম ভাত, ডাল আর পাশে এই কাতল পাতুরি—ভাবলেই জিভে জল এসে যায়। অতিথি এলে, বিশেষ দিন এলে বা স্রেফ নিজের পরিবারের জন্য একটু অন্য স্বাদ পরিবেশন করতে চাইলে এই রেসিপি নিঃসন্দেহে আপনাকে নিরাশ করবে না। বরং যারা খাবার ভালোবাসেন ও নতুন কিছু চেষ্টা করতে চান, তাঁদের কাছে এটি হয়ে উঠবে এক স্মরণীয় রান্নার অভিজ্ঞতা।
সত্যিই, আপনি একবার তৈরি করেই দেখুন—পরিবারের সবার প্রশংসা আপনার হাতেই ফিরে আসবে। শুধু স্বাদ নয়, রান্নার এই সরলতা ও সৌন্দর্য আপনাকেও আনন্দ দেবে।