গায়ক হুমনের শেষ রেকর্ডিংয়ের ভিডিয়ো এখন ঝড় তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ক্যামেরার সামনে মগ্নভাবে গান গাইছিলেন তিনি কেউ ভাবতেই পারেনি সেটিই হবে তাঁর জীবনের শেষ সুর
ওড়িশার সঙ্গীতজগতে শোকের ছায়া। আচমকাই নিভে গেল তরুণ প্রতিভার দীপ। জনপ্রিয় ওড়িয়া গায়ক হুমন সাগর, মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই যিনি লক্ষাধিক শ্রোতার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন তাঁর গভীর আবেগঘন কণ্ঠে, তিনি আর নেই। শিল্পীর অকাল প্রয়াণে ব্যথিত তাঁর অগণিত অনুরাগী, সহশিল্পী, সঙ্গীতপ্রেমী থেকে রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত। তাঁর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন, ব্যথা আর অপূরণীয় শূন্যতা সব মিলিয়ে যেন সঙ্গীতজগতও স্তব্ধ।
দিনকয়েক ধরেই অসুস্থ ছিলেন হুমন সাগর। একাধিক অঙ্গের জটিল অসুখে ভুগছিলেন তিনি। শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ক্লান্তি এমন নানা সমস্যায় দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন। পরিবারের লোকজন প্রথমে বিষয়টিকে ক্লান্তি বা অতিরিক্ত ব্যস্ততার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভেবেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। শেষমেশ তাঁকে ভর্তি করতে হয় ভুবনেশ্বরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায় ফুসফুসে ভয়াবহ সংক্রমণ, যকৃৎ বিকল, হৃদরোগ, কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস, রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা এবং প্লেটলেটের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে তাঁর শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছিল। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শরীরের বহু অঙ্গ একসঙ্গে বিকল হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়।
শেষ পর্যন্ত ১৭ নভেম্বর রাত ৯টা ০৮ মিনিটে সব লড়াই থেমে যায়। হাসপাতাল সূত্রের ভাষায়, “আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু বহু অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার পর তাঁর শরীর আর সাড়া দিচ্ছিল না
পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও বিবৃতি না এলেও, তাঁদের উপর যে কী বিপর্যয় নেমে এসেছে, তা সহজেই অনুমেয়। শিল্পীর বাবা-মা, স্ত্রী, পরিবার সবাই যেন শোকে একেবারে নির্বাক।
হুমন সাগর শুধু একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন ওড়িয়া সঙ্গীতের অন্যতম পরিচিত মুখ। অ্যালবাম, সিনেমা, মঞ্চ সব ক্ষেত্রেই তাঁর গান ছিল জনপ্রিয়। প্রাকৃতিক আবেগ, মেলোডি, ভাঙা গলায় বেদনার ছোঁয়া সব মিলিয়ে তাঁর গলায় ছিল অনন্য একটা জাদু। তাঁর অসংখ্য গান ইউটিউবে মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে। শ্রোতাদের কাছে তিনি ছিলেন সেই পরিচিত কণ্ঠ, যার গান হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তাঁর গান ভালবাসা, ব্যথা, বিচ্ছেদ, আশাবাদ সব কিছুকে স্পর্শ করত। তাই তাঁর প্রয়াণে সাধারণ মানুষ থেকে সাংস্কৃতিক মহল সবাই যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে এত অল্প বয়সে, এত সম্ভাবনাময় একটি কণ্ঠ এভাবে নিভে যেতে পারে।
হুমনের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি। ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন
“নেপথ্যশিল্পী হুমন সাগরের মৃত্যুতে গভীর শোকাহত। ওঁর প্রয়াণে সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র দুনিয়ায় শূন্যতা তৈরি হল। ওঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাই। হুমনের আত্মার শান্তি কামনা করি।”
এছাড়াও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক ও শোকবার্তা জানান। তিনি লেখেন
“হুমন সাগরের মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকস্তব্ধ। তাঁর হৃদয়স্পর্শী অজস্র গান শ্রোতারা মনে রাখবেন। গায়কের আত্মার শান্তিকামনার পাশাপাশি ওঁর পরিবারকেও সমবেদনা জানাচ্ছি
দুই নেতার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হুমন সাগরের জনপ্রিয়তা রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সব সীমা অতিক্রম করেছিল।
হুমনের মৃত্যুর পর তাঁর একটি ভিডিয়ো রীতিমতো ভাইরাল হয়ে পড়েছে। সেই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে—তিনি একটি রেডিয়ো স্টেশনে বসে ‘ভাগ্যরেখা’ গানটি রেকর্ড করছেন। ক্যামেরার সামনে মনোনিবেশ করে হেডফোন পরে তিনি গভীর আবেগে গানটি গাইছেন।
গানটির মূল সংস্করণ প্রকাশ হয়েছিল ২০২৪ সালে, ওড়িয়া অ্যালবাম ‘ভাগ্যরেখা’-য়। কিন্তু যে গান তিনি সেদিন গাইছিলেন, তা তাঁর শেষ রেকর্ডিং এ কথা কেউ জানত না। সে দিন তাঁর অঙ্গভঙ্গি, চোখে শান্তি, গলায় আবেগ সব দেখে তখন কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি।
শ্রোতারা এখন বলছেন
“শেষবারও তিনি মন দিয়ে গেয়েছেন।”
“কে জানত এই গানটাই তাঁর শেষ গান হবে!”
“দেখলে চোখে জল আসে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন সেই ভিডিয়ো ঘুরছে অসংখ্যবার।
একজন শিল্পীর মৃত্যুতে দুঃখ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হুমন সাগরের ক্ষেত্রে যেন ব্যথা আরও গভীর। কেন
১. বয়স মাত্র ৩৪ জীবনের সেরা সময়েই থেমে গেল যাত্রা
তিনি এখনও প্রতিষ্ঠার পথেই ছিলেন, কিন্তু জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। অগণিত স্বপ্ন, নতুন অ্যালবাম, লাইভ শো সব কিছুই ছিল সামনে।
২. শ্রোতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল অনুভূতির যোগ
হুমনের গানে ছিল সরলতা, মানুষের দৈনন্দিন ব্যথা ও আনন্দের প্রতিধ্বনি। তাঁর গান শুনে অনেকেই বলতেন মনে হয় নিজের জীবনের গল্প শুনছি।”
৩. প্রতিভা, আবেগ, সততা সঙ্গীতে ছিল বিশেষ স্বাক্ষর
নকল নয়, যান্ত্রিক নয় হুমন ছিল পুরোটা আবেগ দিয়ে গাওয়া কণ্ঠ
৪. হঠাৎ মৃত্যু মানসিক ধাক্কা আরও বড়
কেউ ভাবতে পারেনি, যার কয়েক দিন আগেই গান রেকর্ডিংয়ের ভিডিয়ো ভাইরাল হচ্ছে, সেই মানুষটি আর নেই।
হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে
ফুসফুসের সংক্রমণ
যকৃৎ বিকল হওয়া (লিভার ফেইলিওর)
হৃদরোগজনিত জটিলতা
কিডনির কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া
রক্তে জমাট বাঁধার সমস্যা (কোয়াগুলেশন ডিসঅর্ডার)
প্লেটলেটের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়া
এই ধরনের অবস্থা সাধারণত ‘মাল্টি-অর্গান ফেলিওর’-এর নির্দেশক।
এমন পরিস্থিতিতে একজন রোগীর শরীর চিকিৎসার প্রতি সাড়া দিতে পারে না
তাই জীবন রক্ষা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে
সহশিল্পীরা বলছেন
“তিনি ছিলেন শিল্পে নিবেদিত প্রাণ
“এত কম বয়সে এমন প্রতিভা চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। “ওড়িয়া মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি আজ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হারাল
জনপ্রিয় সঙ্গীত পরিচালক থেকে মঞ্চ সহকর্মী যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই জানিয়েছেন, হুমন ছিলেন বিনয়ী, পরিশ্রমী এবং অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ
সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর ফ্যানদের পোস্ট দেখলে বোঝা যায় হুমন সাগর মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে কতটা প্রিয় ছিলেন।
কেউ লিখেছেন
“আপনার গান আমাকে বহুবার টেনে তুলেছে। আজও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি নেই।
আরেকজন
“আপনার কণ্ঠ চিরকাল থাকবে। আপনার মতো মানুষ কখনো মরে না।
শ্রোতাদের এই আবেগ দেখলেই বোঝা যায় হুমন সাগর শুধু জনপ্রিয় গায়ক নন, তিনি ছিলেন মানুষের জীবনের অংশ।
হুমনের মৃত্যুর পরও তাঁর গান বাজবে রেডিয়োতে, অনুষ্ঠানে, স্মৃতিতে, মানুষের অনুভূতিতে।
একজন শিল্পীর প্রকৃত পরিচয় তাঁর সৃষ্টিতে।
হুমন সাগরের সৃষ্টি তাঁকে জীবিত রেখেছে এবং রাখবে
তাঁর কণ্ঠে যে ব্যথা, যে ভালোবাসা, যে সরলতা তা শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে বহুদিন
‘ভাগ্যরেখা’ গানের সেই রেকর্ডিং এখন আর শুধুই একটি ভিডিয়ো নয়।
এখন তা এক শিল্পীর শেষ সুর, শেষ মুহূর্ত, শেষ অনুভূতি।
সেই ভিডিওতে তিনি হাসছেন না, দুঃখীও নন শান্ত।
মনে হচ্ছে, যেন কাজ করছেন তাঁর মতো করেই, স্বাভাবিকভাবে।
কেউ জানত না, সেই সুরেই চিরতরে বন্ধ হবে তাঁর জীবন।
হুমন সাগর শুধু একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন ওড়িশার সঙ্গীতের নতুন মুখ, নতুন আশা। অগণিত হিট গান, লাইভ শো অনলাইন জনপ্রিয়তা সব মিলিয়ে তিনি ইতিমধ্যেই নিজস্ব জায়গা তৈরি করেছিলেন।
তাঁর হঠাৎ মৃত্যু শুধু শোক নয় এ যেন সঙ্গীতজগতের এক বড় ক্ষতি
তাঁর মতো কণ্ঠ হয়তো ফিরবে না আর।
একজন শিল্পী যখন চলে যান, তখন শুধু একটি জীবন শেষ হয় না শেষ হয় একটি পথচলা, একটি আবেগ, একটি জগত।
হুমন সাগরের মৃত্যু সেই ধরনেরই ক্ষতি।
যেখানে কথার শেষ নেই, আছে শুধু নীরবতা।
স্মৃতিতে থাকবে তাঁর গান
ভালবাসার, বেদনার, জীবনের গান।
৩৪ বছরের এক তরুণ শিল্পীর অকাল প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা ওড়িশা, শোকস্তব্ধ সঙ্গীতজগত
শেষ রেকর্ডিংয়ের সেই ভিডিয়ো হয়তো সারাজীবন স্মরণ করিয়ে দেবে,
কোনও সুরের শেষ কবে বাজবে তা কেউ জানে না। তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্ন, অনুরাগীদের অশ্রু আর পরিবারের নিঃশব্দ ব্যথা মিলেই যেন তৈরি হয়েছে এক অমোচনীয় শূন্যতা, যা দীর্ঘদিন মনে দাগ রেখে যাবে।