ভারতীয় রূপি সম্প্রতি আবারও রেকর্ড নিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে রূপির দর নেমে এসেছে প্রায় 89.79 এ, যা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া ছাত্রছাত্রী এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণের পরিকল্পনা করা পরিবারগুলোর জন্য এটি বড় ধাক্কা।
ভারতীয় অর্থনীতি গত কয়েক বছরে বহু বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও স্থির থেকেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রার ওঠানামা এমন এক বাস্তবতা যা ভারতের মত বৃহৎ অর্থনীতিকেও ছাড় দেয় না। গত সপ্তাহে ভারতীয় রূপি আবারও এক কঠিন অবস্থানের মুখোমুখি হয়েছে। রূপি ডলারের বিপরীতে প্রায় ₹89.79–এর কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে—যা কার্যত ভারতীয় মুদ্রার এতদিনের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন মান। বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ভ্রমণপ্রেমী পর্যটক, ব্যবসায়িক যাত্রা, এমনকি অনলাইন ইন্টারন্যাশনাল কেনাকাটায় আগ্রহী সকলের জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে দারুণ উদ্বেগের পরিবেশ।
যদিও সাধারণ মানুষ প্রতিদিন ডলার–রূপির চার্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেয় না, কিন্তু রূপির এই পতন সরাসরি প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে মধ্যবিত্ত, উচ্চ–মধ্যবিত্ত এবং এনআরআই–সম্পর্কিত পরিবারগুলির উপর৷ আন্তর্জাতিক লেনদেন, ফি জমা, হোটেল বুকিং, টিকেট ব্যয়—সবকিছুতে যে বিশাল চাপ তৈরি হচ্ছে, তা দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যকে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রায় বহুমাত্রিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা বিশদভাবে দেখব—
রূপির পতন কেন হচ্ছে
বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের উপর এর সরাসরি কী প্রভাব
আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারী ভারতীয়দের বাজেটে কী পরিবর্তন
মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক পরিকল্পনায় এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে
সাধারণ মানুষের জন্য কী করণীয়
এই ৪০০০ শব্দের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ দেশের অর্থনীতি এবং নাগরিক জীবনের গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরবে।
ভারতীয় রূপি বিগত কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে চাপের মুখে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়ার সম্ভাবনা, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য স্থির না থাকা, ইউরোপ–মার্কিন অর্থনৈতিক মন্দা—এই সব মিলিয়ে একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক বাজারে। ভারত যেহেতু বিশাল পরিমাণ ক্রুড অয়েল আমদানি করে, তাই তেলের দাম বেড়ে গেলে সরাসরি চাপ পড়ে রূপির উপর।
একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের শক্তিশালী অবস্থান রূপিকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে—
ভারত আমদানিনির্ভর দেশ
বিদেশি সংস্থাগুলোর দ্বারা ভারতীয় শেয়ার বাজার থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে
আন্তর্জাতিক সংঘাত তীব্র হওয়ায় ডলার সেফ–হেভেন কারেন্সি হিসেবে শক্তিশালী হচ্ছে
ফলে রূপির উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে।
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার, রিজার্ভ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে রূপি কিছুটা স্থির থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারের ‘শক্ত ডলার’ রূপিকে ঠেলে দিচ্ছে আরও নিচের দিকে। বিশ্লেষকরা বলছেন—রূপি যদি ডলারের বিপরীতে ৯০–এর ধারও অতিক্রম করে, তাহলে এক নতুন অর্থনৈতিক চাপের যুগের সূচনা হবে।
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ‘স্টাডি অ্যাব্রড’ মার্কেট। প্রায় ৮ লাখ ভারতীয় ছাত্রছাত্রী বর্তমানে বিদেশে পড়াশোনা করছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর পরিবার এখন রূপির পতনে দারুণভাবে বিপর্যস্ত।
কারণ বিদেশে পড়াশোনার প্রতিটি খরচ—
টিউশন ফি
হোস্টেল
বইপত্র
মেট্রো/বাস/ট্র্যাভেল
খাবার
রেন্ট
মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স
—সবই বিদেশি মুদ্রায় দিতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ—
যদি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ছাত্রছাত্রীর বার্ষিক টিউশন ফি $30,000 হয়, তবে রূপির ২–৩ টাকার ওঠানামাতেই মোট ফি হাজার হাজার টাকা বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে যখন রূপির মূল্য ছিল প্রতি ডলার ৭০ টাকা, তখন ৩০,০০০ ডলার দিতে লাগত ₹২১,০০,০০০।
আজ রূপি ৮৯.৭৯ ছুঁই–ছুঁই। এখন একই ৩০,০০০ ডলারের জন্য দিতে হচ্ছে প্রায় ₹২৬,৯৩,৭০০।
একদিকে বিদেশে পড়ার স্বপ্ন, অন্যদিকে হঠাৎ আর্থিক চাপ—এ যেন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এক কঠিন সমীকরণ।
শুধু ফি নয়,
বাড়ি ভাড়া
মুদি
যাতায়াত
সব খরচেই রূপির পতনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে ১৫%–৩০% পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—রূপির পতন শুধুই পড়াশোনা নয়, ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের মানসিক চাপও বাড়াচ্ছে। অনেকেই ইতিমধ্যে দূর পাল্লার কোর্স বাদ দিয়ে তুলনামূলক সস্তা দেশ বেছে নেওয়ার কথা ভাবছেন।
ভারত থেকে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ বেড়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বিদেশযাত্রা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠছিল। কিন্তু রূপির পতনে সেই স্বপ্নেও নেমেছে ধাক্কা।
আজ ইউরোপ ট্যুরে ১ ব্যক্তির যে গড় খরচ ছিল—
₹২.২ লক্ষ, তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ₹২.৬ লক্ষ–₹৩ লক্ষ।
যেখানে আগে ১,০০০ ইউরো ফ্লাইট, হোটেল, লোকাল যাতায়াত মিলে ৮০,০০০–৯০,০০০ টাকায় হয়ে যেত, এখন তা ছাড়াচ্ছে ১,১০,০০০–১,২০,০০০ টাকা।
দুবাই, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম বা মালয়েশিয়ার মত জায়গায় কম চাপ থাকলেও ইউরোপ–আমেরিকা–অস্ট্রেলিয়া এখনও ভারতীয় পর্যটকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
একজন পর্যটকের ভাষায়—
“ভিসা, টিকেট, হোটেল—সব মিলিয়ে বিদেশ ভ্রমণ এখন মধ্যবিত্তের পক্ষে আগের মত সম্ভব হচ্ছে না। ডলার–ইউরো দাম আকাশছোঁয়া।”
এই পরিস্থিতিতে অনেক ভ্রমণ সংস্থা বলছে—
গ্রুপ ট্র্যাভেল বাড়বে
অফ–সিজন ট্র্যাভেল জনপ্রিয় হবে
এশিয়ান দেশগুলোকে ভারতীয়রা বেশি বেছে নেবে
ট্র্যাভেল EMI–এর ব্যবহার বাড়বে
ডিজিটাল ফরেক্স ব্যবহারে সচেতনতা বাড়বে
রূপির পতনের একটি বড় প্রভাব দেখা যায় ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে।
যে সমস্ত খরচ মানুষ প্রতিদিন করছে—
Netflix, Amazon Prime, Spotify
Canva, Adobe, AI টুলস
আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে শপিং
গেমিং, ওটিটি সাবস্ক্রিপশন
সবই ডলার–ইউরো ভিত্তিক।
যেমন Adobe Creative Cloud যেখানে ২০১৯ সালে ₹৩৯৯৯ মাসিক ছিল, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ₹৪৫০০–₹৫০০০।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক শিপমেন্ট, কাস্টম ডিউটি, ডেলিভারি চার্জ—সবই বেড়ে যাচ্ছে।
স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোও বিপাকে পড়ছে কারণ সার্ভার, API, ডোমেইন, হোস্টিং—সবই বিদেশি মুদ্রাভিত্তিক।
ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সাধারণত
সন্তানদের পড়াশোনা
ভবিষ্যতের সঞ্চয়
EMI
LIC/মিউচুয়াল ফান্ড
—সব কিছুই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে করে।
রূপির পতন সেই পরিকল্পনায় বড়সড় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
যাদের সন্তান বিদেশে পড়ছে বা পড়ার পরিকল্পনা করছে, তারা এখন দ্বিমুখী সমস্যায়—
ডলার বাড়ছে
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বছরে ৫–১০% বাড়ছে
এতে মোট খরচ প্রায় ২৫–৩০% বেশি হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া রূপি কমে গেলে আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বাড়ে—
ইলেকট্রিক আইটেম
মোবাইল
গাড়ির পার্টস
ল্যাপটপ
কসমেটিকস
ফার্মাসিউটিক্যাল র অস্ত্র–উপাদান
ফলে সাধারণ মানুষের মাসিক খরচও বাড়ছে।
বহু অর্থনীতিবিদের মতে—
যদি বৈশ্বিক অস্থিরতা না কমে, তবে রূপি ৯০-এর দোরগোড়া বা তারও বেশি স্পর্শ করতে পারে।
তবে আশার কথা—
ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী
রিজার্ভ ব্যাংক সময় মতো ডলার বিক্রি করে রূপিকে স্থিতিশীল রাখছে
ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এখনও বিশ্বের অন্যতম দ্রুত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
“রূপির পতন উদ্বেগজনক হলেও আতঙ্কের নয়। এটি স্বল্পমেয়াদি চাপ। ভারত লং টার্মে শক্ত অর্থনীতির দেশ।”
রূপি যেসব দেশের তুলনায় বেশি স্থিতিশীল—
ভিয়েতনাম
নেপাল
বালি (ইন্দোনেশিয়া)
থাইল্যান্ড
শ্রীলঙ্কা
কম্বোডিয়া
কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকা এখন সম্পূর্ণই ব্যয়বহুল।
বিদেশে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুকদের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—
টিউশন ফি আগে ভাগে লক করে দেওয়া
ফরেক্স কার্ডে টাকা রাখা
ডলার রেটে লক–ইন করা
মানি ট্রান্সফারের সেরা সময় বেছে নেওয়া
পার্ট–টাইম কাজের সুযোগ খোঁজা
শেয়ারড অ্যাকমোডেশন নেওয়া
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আগামী ২–৩ বছর রূপি আরও অখণ্ড চাপের মুখে পড়তেও পারে।
আগে থেকে বুকিং
অফ সিজনে যাত্রা
সস্তা দেশ বেছে নেওয়া
মাল্টি–কারেন্সি কার্ড ব্যবহার
ফ্লাইট–হোটেল কম্বো অফার নেওয়া
রূপি দুর্বল হওয়ায় আমদানি ব্যয় বাড়ে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। তবে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভারত যেহেতু সার্ভিস–এক্সপোর্টে বড় দেশ, তাই দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ততটা ক্ষতিকর নয়।
তবে তেলের দাম যদি আবার বাড়ে, তাহলে রূপির উপর আরও বড়সড় ঝড় আসতে পারে।
বর্তমানে ভারতীয় রূপি চরম চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিদেশে পড়াশোনা, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, ডিজিটাল সার্ভিস, আমদানি পণ্য—সব ক্ষেত্রেই বাড়তি খরচ মানুষকে ভাবাচ্ছে। ডলার–ইউরো যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক মাস সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হতে পারে। তবে ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী হলেও বৈশ্বিক সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে সচেতন পরিকল্পনা, খরচ কমানো, বুদ্ধিদীপ্ত আর্থিক সিদ্ধান্ত—সবই এখন অত্যন্ত প্রয়োজন।